লেখক: সৈয়দ শামসুল হক
কবিতা লিখি, যেমন আমার অভ্যেস — প্রথমে খাতার পাতায় কলমে, তারপর কম্পিউটারে তাকে তুলি। কম্পিউটারে লিপিবদ্ধ করি কবিতাটি। একদিন এই রকমেই একটি কবিতাকে কম্পিউটারে আমি লিখে উঠেছিলাম। তখনো আমি এ যন্ত্রের ক্রিয়াকর্ম-যোগ্যতার সবটুকু জেনে উঠি নি। নিতান্ত খেয়ালবশেই পুরো কবিতাটিকে আমি পর্দায় হাইলাইট করে টিপে দিই একটি বোতাম। এই বোতামটির কাজ হচ্ছে অক্ষরের আদ্যাক্ষর বুঝে রচনার আগাগোড়া শব্দসকল চোখের নিমেষে নতুন করে সাজিয়ে ফেলা। অবাক হয়ে দেখি বোতাম টিপতেই ঘটে যায় এক ইন্দ্রজাল। দেখি, যে-কবিতাটি আমি লিখেছি তার একটি ভিন্নরূপ দাঁড়িয়ে গেছে। মূল কবিতাটি গদ্যছন্দে লেখা এবং সেটি প্রথমে ছিলো এই :
এই চৈত্রই ছিলো তবে সবচেয়ে প্রশস্তকাল? একজন ও আমাদের জন্যে এই বৃষ্টিহীন গ্রাম্যচিত্রে কাঁটাঝোপের ভেতর দিয়েই ছিল তবে পথ? এইসব হা-খোলা রক্তাক্ত গহ্বর প্রকাশিত প্রান্তরের ওপর দিয়েই তবে ধরা যায় না যে অনবরত দূরে সরে থাকা দিগন্ত, সেই দিগন্তের দিকেই আমাদের তবে শেষ উল্লম্ফন?
আমরা প্রস্তুত ছিলাম— এমত বলা যাবে না; আবার যে একেবারে প্রস্তুতিহীন, এখন, পেছন ফিরে দেখি, তাও ঠিক নয়। এ এক প্রকার প্রস্তুতি ও প্রস্তুতিহীনতার ভেতর, ছায়া এবং আলোর মধ্যবর্তীস্থানে, জল এবং স্থলের ভেজা চুম্বনের দাগে, চিৎকার ও স্তব্ধতার অন্তবর্তী গর্ভাশয়ে আমরা বাস করছিলাম অনেকদিন।
অনেকদিন; সে বড় দীর্ঘদিন; কিন্তু দীর্ঘ যখন বলি তখন হ্রম্বের ধারণাও তো ছিলোই; হ্রস্বতার ভেতর বেড়ে ওঠা রাষ্ট্র এবং গোলাপবাগানে, খর্বতার ভেতর মুখ গুঁজে পড়ে থাকা মাছের ঝাঁকে, অবনতের ভেতরে পা ছড়িয়ে বসে থাকা দুধখোলা রমণীদের যৌথ শীর্ণতায় আমরা বড় বেশি মাতাল হয়ে যেতে যেতে এক সময় পেয়ে গিয়েছিলাম বিজ্ঞানের সকালবেলার এক টুকরো আলো, যেন আমাদের জননীর বুক ঢাকবার একফালি তেনা, ইলিশের জন্যে বেরিয়ে পড়বার নৌকো এবং জাল, রাষ্ট্রঘাতককে চাবকাবার জন্যে শংকর মাছের লেজ, আর গোলাপ থেকে আতর নিংড়ে নেবার জন্যে পেষণকল; সেই তেনা, নৌকো, জাল, শংকরের লেজ আর পেষণকলই ইতিহাসের দীর্ঘতার দিকে ছুড়ে দেয় আমাদের। এ যদি প্রস্তুতি হয়, তবে একে প্রস্তুতি বলেই গ্রহন কোরো।
অতঃপর একে একে বিদায় নিতে লাগলো আমাদের মধ্যে যারা করছিলো ইতঃস্তত, যারা করছিলো মগজ ও চিত্রকল্প ঋণ এবং যাদের শব্দের আঠায় জড়িয়ে যাচ্ছিলো অধর এবং ওষ্ঠ। কেবল তারাই হচ্ছিলো অগ্রসর যাদের পরণে ছিলো না একগজও সুতো, কিন্তু লজ্জিত ছিলো না নগ্নতায়, যাদের ভিক্ষাপাত্রে বারবার উড়ে এসে বসছিলো প্রজাপতি, জননীরা বিদায় নেবার পরও যারা তাঁদের ছায়াকে সঙ্গে রেখে হাঁটছিলো বদ্বীপের প্রসিদ্ধ এবং অখ্যাত সব জনপদের ভেতর দিয়ে সোনালি খড় ছাওয়া একটি কুটিরের দিকে।
হঠাৎ আকাশ বমন করে দিলো অন্ধকার; বৃষ্টি হবার কথা ছিলো; হঠাৎ সারস উড়ে গেলো ফিরে ফের; এখানেই তাদের বাসা করবার কথা ছিলো; আমরা তাকিয়ে দেখলাম আমাদের নিজেদেরই দিকে এবং আমাদেরই ভেতর থেকে একজন আর নেই যে-ছিলো নৌকোর গলুইয়ের ওপর স্থির দাঁড়িয়ে তীরের দিকে চোখ রেখে।
একজন? এমনও একজন হয় কেউ কেউ, ইতিহাসে, হাজার বছরে, একজন, যার মধ্যে শতকোটির হয় সংকুলান। প্রস্তুতি ও প্রস্তুতিহীনতার মধ্যে তাকে আমরা সংবশে ও সম্বপ্নে দাউ দাউ পুড়তে দেখেছি, কিম্বা পুড়িয়েছি আমরাই বস্তুত; আর আমরা এখন সেই আগুনেই হাত সেঁকে নেবার জন্যে লাফিয়ে পড়ছি প্রতিযোগিতায়, কিন্তু আমরা কি জানি, এই আগুনেও আমাদের হাত, এই হাত, এইসব হাত কী হিম ও বরফ?
এই কবিতাটিকেই কম্পিউটার তার নিজের বিজ্ঞানবুদ্ধিতে শব্দ সাজিয়ে নতুন করে লিখলো এই:
ইলিশের জন্যে বেরিয়ে পড়বার নৌকো এবং জাল, রাষ্ট্রঘাতককে চাবকাবার জন্যে শংকর মাছের লেজ, আর গোলাপ থেকে আতর নিংড়ে নেবার জন্যে পেষণকল; এ এক প্রকার প্রস্তুতি ও প্রস্তুতিহীনতার ভেতর, ছায়া এবং আলোর মধ্যবর্তীস্থানে, এই চৈত্রই ছিলো তবে সবচেয়ে প্রশস্তকাল। এইসব হা-খোলা রক্তাক্ত গহ্বর প্রকাশিত প্রান্তরের ওপর দিয়েই তবে ধরা যায় না যে অনবরত দূরে সরে থাকা দিগন্ত, সেই দিগন্তের দিকেই আমাদের তবে শেষ উল্লম্ফন?
একজন ও আমাদের জন্যে এই বৃষ্টিহীন গ্রাম্যচিত্রে কাঁটাঝোপের ভেতর দিয়েই ছিলো তবে পথ? একজন? এমনও একজন হয় কেউ কেউ, ইতিহাসে, হাজার বছরে, একজন, যার মধ্যে শতকোটির হয় সংকুলান। প্রস্তুতি ও প্রস্তুতিহীনতার মধ্যে তাকে আমরা অতঃপর একে একে বিদায় নিতে লাগলো আমাদের মধ্যে যারা করছিলো ইতঃস্তত, যারা করছিলো মগজ ও চিত্রকল্প ঋণ এবং যাদের শব্দের আঠায় জড়িয়ে যাচ্ছিলো অধর এবং ওষ্ঠ। আবার যে একেবারে প্রস্তুতিহীন, এখন, পেছন ফিরে দেখি, তাও ঠিক নয়।
আমরা তাকিয়ে দেখলাম আমাদের নিজেদেরই দিকে এবং আমাদেরই ভেতর থেকে একজন আর নেই যে-ছিলো নৌকোর গলুইয়ের ওপর স্থির দাঁড়িয়ে তীরের দিকে চোখ রেখে। আমরা প্রস্তুত ছিলাম – এমত বলা যাবে না; আমরা বড় বেশি মাতাল হয়ে যেতে যেতে এক সময় পেয়ে গিয়েছিলাম বিজ্ঞানের সকালবেলার এক টুকরো আলো, যেন আমাদের জননীর বুক ঢাকবার একফালি তেনা, অবনতের ভেতরে পা ছড়িয়ে বসে থাকা দুধখোলা রমণীদের যৌথ শীর্ণতায় – অনেকদিন; সে বড় দীর্ঘদিন; কিন্তু দীর্ঘ যখন বলি তখন হ্রম্বের ধারণাও তো ছিলোই; হ্রস্বতার ভেতর বেড়ে ওঠা রাষ্ট্র এবং গোলাপবাগানে, খর্বতার ভেতর মুখ গুঁজে পড়ে থাকা মাছের ঝাঁকে, কিন্তু আমরা কি জানি, এই আগুনেও আমাদের হাত, এই হাত, এইসব হাত কী হিম ও বরফ?
কেবল তারাই হচ্ছিলো অগ্রসর যাদের পরণে ছিলো না একগজও সুতো, কিন্তু লজ্জিত ছিলো না নগ্নতায়, যাদের ভিক্ষাপাত্রে বারবার উড়ে এসে বসছিলো প্রজাপতি, সেই তেনা, নৌকো, জাল, শংকরের লেজ আর পেষণকলই ইতিহাসের দীর্ঘতার দিকে ছুড়ে দেয় আমাদের। এ যদি প্রস্তুতি হয়, তবে একে প্রস্তুতি বলেই গ্রহণ কোরো।
সংবশে ও সম্বপ্নে দাউ দাউ পুড়তে দেখেছি, কিম্বা পুড়িয়েছি আমরাই বস্তুত; আর আমরা এখন সেই আগুনেই হাত সেঁকে নেবার জন্যে লাফিয়ে পড়ছি প্রতিযোগিতায়, হঠাৎ আকাশ বমন করে দিলো অন্ধকার; বৃষ্টি হবার কথা ছিলো; হঠাৎ সারস উড়ে গেলো ফিরে ফের; এখানেই তাদের বাসা করবার কথা ছিলো; জননীরা বিদায় নেবার পরও যারা তাঁদের ছায়াকে সঙ্গে রেখে হাঁটছিলো বদ্বীপের প্রসিদ্ধ এবং অখ্যাত সব জনপদের ভেতর দিয়ে সোনালি খড় ছাওয়া একটি কুটিরের দিকে।
জল এবং স্থলের ভেজা চুম্বনের দাগে, চিৎকার ও স্তব্ধতার অন্তবর্তী গর্ভাশয়ে – আমরা বাস করছিলাম অনেকদিন।
কম্পিউটারের এই রচনা, আমারই প্রত্যক্ষ রচনাকে বদলে দিয়ে। আমি এক নতুন ধরনের সৃষ্টিশীলতার সন্ধান যেন পেলাম এবং আরো একবার চাপ দিলাম ওই একই বোতামে। তৎক্ষণাৎ আমার কম্পিউটার আমারই নির্দেশে আরো একটি রূপ রচনা করলো এই :
ইলিশের জন্যে বেরিয়ে পড়বার নৌকো এ এক প্রকার প্রস্তুতি ও প্রস্তুতিহীনতার ভেতর, এ যদি প্রস্তুতি হয়, তবে একে প্রস্তুতি বলেই গ্রহণ কোরো। এই এবং আমাদেরই ভেতর থেকে একজন আর নেই যে-ছিলো নৌকোর গলুইয়ের ওপর স্থির দাঁড়িয়ে তীরের দিকে চোখ রেখে।
এবং অখ্যাত সব জনপদের ভেতর দিয়ে সোনালি খড় ছাওয়া একটি কুটিরের দিকে। এবং জাল। এমনও একজন হয় কেউ কেউ, ইতিহাসে, হাজার বছরে, একজন, যার মধ্যে শতকোটির হয় সংকুলান। একজন ও আমাদের জন্যে এই বৃষ্টিহীন গ্ৰাম্যচিত্রে কাঁটাঝোপের ভেতর দিয়েই ছিলো তবে পথ? একজন?
আবার যে একেবারে প্রস্তুতিহীন, এখন, পেছন ফিরে দেখি, তাও ঠিক নয়। আমরা তাকিয়ে দেখলাম আমাদের নিজেদেরই দিকে আমরা প্রস্তুত ছিলাম— এমত বলা যাবে না; আমরা বড় বেশি মাতাল হয়ে যেতে যেতে এক সময় পেয়ে গিয়েছিলাম বিজ্ঞানের সকালবেলার এক টুকরো আলো, আর আমরা এখন সেই আগুনেই হাত সেঁকে নেবার জন্যে লাফিয়ে পড়ছি প্রতিযোগিতায়।
হঠাৎ আকাশ বমন করে দিলো অন্ধকার; বৃষ্টি হবার কথা ছিলো; অবনতের ভেতরে পা ছড়িয়ে বসে থাকা দুধখোলা রমণীদের যৌথ শীর্ণতায়— অনেকদিন; কিন্তু আমরা কি জানি, এই আগুনেও আমাদের হাত, এই হাত, এইসব হাত কী হিম ও বরফ?
প্রস্তুতি ও প্রস্তুতিহীনতার মধ্যে আমরা অতঃপর; একে একে বিদায় নিতে লাগলো আমাদের মধ্যে যারা করছিলো ইতঃস্তত, যারা করছিলো মগজ ও চিত্রকল্প ঋণ এবং যাদের শব্দের আঠায় জড়িয়ে যাচ্ছিল অধর এবং ওষ্ঠ।
রাষ্ট্রঘাতককে চাবকাবার জন্যে শংকর মাছের লেজ, আর গোলাপ থেকে আতর নিংড়ে নেবার জন্যে পেষণকল; যেন আমাদের জননীর বুক ঢাকবার একফালি তেনা, কেবল তারাই হচ্ছিলো অগ্রসর যাদের পরণে ছিলো না একগজও সুতো, কিন্তু লজ্জিত ছিলো না নগ্নতায়, যাদের ভিক্ষাপাত্রে বারবার উড়ে এসে বসছিলো প্রজাপতি, সে বড় দীর্ঘদিন; কিন্তু দীর্ঘ যখন বলি তখন হ্রম্বের ধারণাও তো ছিলোই; হ্রস্বতার ভেতর বেড়ে ওঠা রাষ্ট্র এবং গোলাপবাগানে, খর্বতার ভেতর মুখ গুঁজে পড়ে থাকা মাছের ঝাঁকে, সেই তেনা, নৌকো, জাল, শংকরের লেজ আর পেষণকলই ইতিহাসের দীর্ঘতার দিকে ছুড়ে দেয় আমাদের।
তাকে সংবশে ও সম্বপ্নে দাউ দাউ পুড়তে দেখেছি, কিম্বা পুড়িয়েছি আমরাই বস্তুত; হঠাৎ সারস উড়ে গেলো ফিরে ফের; এখানেই তাদের বাসা করবার কথা ছিলো; জননীরা বিদায় নেবার পরও যারা তাঁদের ছায়াকে সঙ্গে রেখে হাঁটছিলো বদ্বীপের প্রসিদ্ধ ছায়া এবং আলোর মধ্যবর্তীস্থানে, জল এবং স্থলের ভেজা চুম্বনের দাগে, চিৎকার ও স্তব্ধতার অন্তবর্তী গর্ভাশয়ে আমরা বাস করছিলাম অনেকদিন।
চৈত্রই ছিলো তবে সবচেয়ে প্রশস্তকাল। এইসব হা-খোলা রক্তাক্ত গহ্বর প্রকাশিত প্রান্তরের ওপর দিয়েই তবে ধরা যায় না যে অনবরত দূরে সরে থাকা দিগন্ত, সেই দিগন্তের দিকেই আমাদের তবে শেষ উল্লম্ফন?
তিনটি রচনাই বারবার পাঠ করে দেখতে পেলাম, আমার কাছে তিনটিই হয়ে দাঁড়িয়েছে গ্রহণযোগ্য কবিতা। প্রথমটির রচয়িতা আমি এবং অপর দুটির রচয়িতা আমি একা নই, আমি এবং আমার যন্ত্র। এমন একটি সময় হয়তো কবির আয়ত্বে এখনই এসে গেছে অথবা আসা সম্ভব যখন কবিতা লিখবে একা কবি নয়, কবি ও তার কম্পিউটার— যুগলে। আমি এখন বিশ্বাস করতে প্রলুব্ধ যে, কবি ও যন্ত্রের এই যুগল-সৃষ্টিশীলতা একদিন না একদিন কবিতা লেখার মাননীয় একটি পদ্ধতি হিসেবে গণ্য হবে।
Leave a comment