গল্পে গল্পে বিজ্ঞানপরিবেশ ও পৃথিবী

মরুভূমির বুকে হাজার বছরের রহস্যময় গাছ

Share
Share

রোদে পুড়ে যাওয়া মরুভূমির বালির উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বিজ্ঞানী ফ্রিডরিখ ওয়েলউইচ হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। চোখের সামনে অদ্ভুত এক দৃশ্য। বিশাল দুটি পাতার বিশৃঙ্খল এক উদ্ভিদ, যেন ভিনগ্রহ থেকে এসে আছড়ে পড়েছে এই নিষ্প্রাণ ভূমিতে। কৌতূহল, বিস্ময় এবং সামান্য ভয় মিলিয়ে তিনি হাঁটু গেড়ে বসলেন। স্পর্শ করতেও দ্বিধা করলেন—কল্পনার ভুল নয় তো?

১৮৫৯ সালের সেই দিনে আবিষ্কৃত উদ্ভিদটির নাম হয় ওয়েলউইচিয়া মিরাবিলিস (Welwitschia mirabilis)। নামটি ‘মিরাবিলিস’—অর্থাৎ চমৎকার—যার যোগ্য কারণ উদ্ভিদটির আশ্চর্য বৈশিষ্ট্য। আফ্রিকার অ্যাঙ্গোলা এবং নামিবিয়ার মধ্যবর্তী এই মরুভূমিতে জন্মানো উদ্ভিদটি সারা জীবনে মাত্র দুটি পাতাই জন্মায়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, পাতাগুলো মরে না গিয়ে ক্রমাগত বেড়েই চলে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মরুভূমির ধূলি-বালুতে জীর্ণ হয়ে যায় পাতার অগ্রভাগ, কিন্তু গোড়া থেকে বাড়তে থাকে প্রতিনিয়ত।

“প্রকৃতির এই বিস্ময়ের সামনে দাঁড়িয়ে সত্যিই আমি হতবাক হয়েছি,” বলেন তরুণ উদ্ভিদবিজ্ঞানী আফিফা রহমান। তিনি সম্প্রতি এক অভিযানে ওয়েলউইচিয়া গাছটির দেখা পান। তাঁর ভাষ্যে, “এটি জীবন্ত জীবাশ্মের মতো। যেন ইতিহাসের সাক্ষী, যার পাতার ছত্রে লেখা আছে হাজার বছরের জলবায়ু পরিবর্তনের গল্প।”

উদ্ভিদটির বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ বলছে, এর আয়ুষ্কাল সাধারণত ৪০০ থেকে ১৫০০ বছর পর্যন্ত, তবে কিছু প্রাচীন গাছের বয়স ৩০০০ বছর পর্যন্তও হতে পারে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা যায়, ওয়েলউইচিয়ার দীর্ঘায়ুর রহস্য লুকিয়ে রয়েছে এর জিনে। প্রায় ৮৬ মিলিয়ন বছর আগে এক বিশেষ জিনগত পরিবর্তনের ফলে গাছটি মরুভূমির কঠিন পরিবেশে টিকে থাকার সক্ষমতা অর্জন করে। মরুভূমির প্রচণ্ড তাপ এবং শুষ্কতা থেকে বাঁচার জন্য এতে রয়েছে বিশেষ ধরনের জিন, যা উদ্ভিদটিকে অপরিমেয় সহিষ্ণুতা দিয়েছে।

বিশ্ববিখ্যাত কিউ রয়েল বোটানিক গার্ডেনস একবার ওয়েলউইচিয়াকে “বিশ্বের কুৎসিততম উদ্ভিদ” হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। কিন্তু নামিবিয়ার স্থানীয় বাসিন্দা ওয়াল্টার এনগুনের মতে, “আমাদের কাছে এটি কুৎসিত নয়। বরং এই গাছ মরুভূমির প্রাণের প্রতীক। এর পাতা মরুভূমির পশুপাখির আশ্রয়, এবং পানি সংগ্রহের মাধ্যম। এটি আমাদের প্রকৃতির সম্পদ।”

এই উদ্ভিদটির পরিবেশগত গুরুত্বও অপরিসীম। এর বিস্তৃত পাতাগুলো মরুভূমিতে বাতাসের সঙ্গে উড়ে আসা জৈব পদার্থকে আটকে রেখে মৃত ভূমিতে পুষ্টি যোগায়। পাশাপাশি সরীসৃপ, পাখি ও মরুভূমির প্রাণীদের বাসস্থান হিসেবেও কাজ করে ওয়েলউইচিয়া।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান বলেন, “ওয়েলউইচিয়া উদ্ভিদবিজ্ঞানের একটি চমৎকার উদাহরণ, যা আমাদের শেখায়, কঠিন পরিবেশেও জীবনের অভিযোজন কতটা আশ্চর্যজনক হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এমন উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।”

সুতরাং, এক সময় যে উদ্ভিদটিকে বিজ্ঞানীরা ‘ভিনগ্রহের অতিথি’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন, সেটিই আজ পরিবেশ রক্ষার অমূল্য সম্পদ।
হাজার বছর ধরে দাঁড়িয়ে থাকা এই গাছ যেন বলছে,
জীবন আসলে সংগ্রাম এবং অভিযোজনের গল্প।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
পরিবেশ ও পৃথিবী

নদীর প্রাণ কি সত্যিই আছে?

নদী অধিকারের ধারণাটি অন্বেষণ করুন, নদীগুলিকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে স্বীকৃতি দিন যা...

পরিবেশ ও পৃথিবীবিজ্ঞান বিষয়ক খবর

সুন্দরবনের ভৌগোলিক ও পরিবেশগত প্রেক্ষাপট।

সুন্দরবনের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য, জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি এবং রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বেঁচে থাকার...

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাপরিবেশ ও পৃথিবী

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অদৃশ্য বিদ্যুৎ বিল

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা জীবনকে সহজ করে তোলে, কিন্তু প্রতিটি চ্যাটবটের উত্তর এবং ছবি...

পরিবেশ ও পৃথিবীস্বাস্থ্য ও পরিবেশ

বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য ও নীল অর্থনীতি।

বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য এবং নীল অর্থনীতি অন্বেষণ করুন — সুন্দরবন এবং সামুদ্রিক সম্পদ...

পরিবেশ ও পৃথিবীসাধারণ বিজ্ঞান

বাংলাদেশের শহরে পাখির সংখ্যা কমে যাওয়ার পেছনের গবেষণা কি বলে?

বাংলাদেশের শহরগুলিতে পাখির সংখ্যা কেন দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে তা আবিষ্কার করুন। নগর...

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

Copyright 2024 biggani.org