রাতের আকাশে জ্বলজ্বল করা তারা শুধুই সৌন্দর্যের উপাদান নয়—তারা আমাদের অস্তিত্বের উৎসও বটে। কিন্তু তারা কীভাবে তৈরি হয়, কোথা থেকে আসে, আর শেষ হয় কোথায়?
একটা ঠান্ডা রাত। শহরের কোলাহল পেরিয়ে দূরের এক পাহাড়ি গ্রামে বেড়াতে গেছেন নীলার পরিবার। সবুজের মাঝে ছোট্ট একটা কটেজ, তার পাশে একটি খোলা মাঠ। রাতের খাবারের পর ছোট্ট তামিম হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো নীলাকে বাইরে। বলল, “মা, এই যে আকাশে দেখো—এত তারা! এগুলো কি সব সূর্য?”
নীলা কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললো, “হ্যাঁ, কিছুটা তাই। তবে সব সূর্য নয়, কিছু নকল সূর্যও আছে…”
শুধু তামিম না, অনেক বড়রাও ভুল বোঝে তারা মানেই ‘একটা আলো’, অথবা ‘ছোট্ট সূর্য’। কিন্তু তারার পরিচয় যে এতটা জটিল, সেটা বিজ্ঞানীরা বুঝেছেন বহু শতাব্দী ধরে গবেষণা করে।
তারার সংজ্ঞা খোঁজার ইতিহাস
প্রাচীন সভ্যতাগুলো আকাশের তারা দেখে ভবিষ্যদ্বাণী করতো। তবে আধুনিক বিজ্ঞান বলছে, একটি তারা হলো একধরনের আকাশী বস্তু যা নিজে থেকে আলো উৎপন্ন করে—তাও আবার নিউক্লিয়ার ফিউশন নামের এক ভৌত প্রক্রিয়ায়।
যুক্তরাষ্ট্রের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ড. ফিল প্লেইট লিখেছেন, “তারা হলো নিজস্ব মাধ্যাকর্ষণ শক্তিতে গঠিত, উত্তপ্ত, জ্বলন্ত প্লাজমা-পিণ্ড যার কেন্দ্রে নিউক্লিয়ার ফিউশনের মাধ্যমে প্রচুর শক্তি উৎপন্ন হয়।”
এই ফিউশন প্রক্রিয়ায় প্রতিনিয়ত হাইড্রোজেন পরমাণু একত্রিত হয়ে হেলিয়ামে পরিণত হয়, আর সেই সময় তাপ ও আলো ছড়িয়ে দেয়। উদাহরণ হিসেবে আমাদের সূর্য প্রতি সেকেন্ডে ৬২০ মিলিয়ন টন হাইড্রোজেন পুড়িয়ে ফেলে!
“সূর্য প্রতিনিয়ত এমন শক্তি নিঃসরণ করছে যা গোটা সৌরজগতকে আলোকিত ও উষ্ণ করে।” — নাসা সোলার ডায়নামিক্স অবজারভেটরি
কোথায় তারার শুরু, আর কোথায় শেষ?
কিন্তু সব উজ্জ্বল বস্তু কি তারা? জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলেন, না। কোনো বস্তু তখনই তারা বলে গণ্য হয়, যদি তার ভেতরে হাইড্রোজেনের একক প্রোটন ফিউশন ক্রিয়া ঘটে। তার চাইতে ছোট বস্তু, যেমন বৃহস্পতির চেয়ে একটু বড় যেগুলো, তাদের বলে ব্রাউন ডোয়ার্ফ—যাদের ফিউশন সীমিত, স্বল্পমেয়াদি, এবং সম্পূর্ণ নয়।
নাসার বিজ্ঞানী লিসা বেন্টলি ব্যাখ্যা করেন, “ব্রাউন ডোয়ার্ফ হলো একধরনের ‘ব্যর্থ তারা’। এর ভেতরে কিছু ফিউশন হয় ঠিকই, কিন্তু তারার মতো দীর্ঘমেয়াদী নয়।”
আর বড় তারা? তারাও চিরকাল টিকে থাকে না। কোনো কোনো তারার মৃত্যু হয় মহাবিশ্ব কাঁপানো সুপারনোভা বিস্ফোরণে, যার ফলশ্রুতিতে তৈরি হয় নিউট্রন তারা বা ব্ল্যাক হোল। আবার সূর্যের মতো ছোট তারা ধীরে ধীরে তাদের বাইরের স্তর হারিয়ে সাদা বামন রূপে পরিণত হয়।
বিজ্ঞানী সমাজে বিতর্ক ও বাস্তবতা
তারার সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্ক এখনও শেষ হয়নি। আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ইউনিয়ন (IAU) একদিকে যেমন গ্রহের সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়ে, অন্যদিকে তারার ক্ষেত্রেও ‘কেন ব্রাউন ডোয়ার্ফ তারা নয়?’ সেই প্রশ্ন উত্থাপিত হয় বারবার।
তবুও বিজ্ঞান শেখায়, জ্ঞান কখনও চূড়ান্ত নয়—তথ্য আর গবেষণা অনুসারে সংজ্ঞাও বদলায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল মুকিত বলেন, “ছাত্ররা প্রায়ই জিজ্ঞাসা করে, একটা তারা আর গ্রহের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? আমি বলি, বিজ্ঞানের সৌন্দর্য এখানেই—এটা প্রশ্ন করার অনুমতি দেয়, আর উত্তরটা সময়ের সঙ্গে বদলাতেও পারে।”
তারার মাঝে আমাদের সূর্য
সবশেষে, আমাদের সূর্যও কিন্তু একটি সাধারণ তারা। তার বয়স প্রায় ৪.৬ বিলিয়ন বছর এবং ধারণা করা হয়, আরও ৫ বিলিয়ন বছর ধরে সে জ্বলবে।
কিন্তু এই অসংখ্য তারার মাঝে, কিছুটা মাঝারি আয়তনের এক তারা, আমাদের জীবন দিয়েছে, আলো দিয়েছে। তাই আকাশের তারারা শুধু রহস্য নয়, তারাই আমাদের অস্তিত্বের প্রহরী।
“তারা মানে শুধু আলো না, তারা মানে জীবন। আমরা এখানে বেঁচে আছি, কারণ এক তারা ঠিকঠাক জ্বলছে।” — মা নীলা
পরের বার আকাশে তাকিয়ে কোনো তারা দেখলে একবার ভাবুন, সেই আলোটা হয়তো কয়েক হাজার বছর আগে যাত্রা শুরু করেছিল—আপনাকেই বলার জন্য যে আপনি এক বিস্ময়কর মহাবিশ্বের অংশ।
তথ্যসূত্র:
- ফিল প্লেইট, সায়েন্টিফিক আমেরিকান
- NASA Solar Dynamics Observatory
- ড. লিসা বেন্টলি, ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি
- ড. আব্দুল মুকিত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আরও পড়ুন:
- নিউট্রন তারা ও ব্ল্যাক হোলের গল্প
- গ্রহ বনাম তারা: সংজ্ঞার সীমারেখা
- স্মরণীয় সুপারনোভা বিস্ফোরণ: মহাবিশ্বের প্রলয়
Leave a comment