২০২৪ সালের এক বিকেলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের ছাত্র তাহসিন আহমেদ ক্যাম্পাসের লাইব্রেরিতে বসে মনবুশো স্কলারশিপ সম্পর্কে পড়ছিলেন। তার স্বপ্ন ছিল বিশ্বমানের গবেষণা করা, কিন্তু অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা এবং বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগের অনিশ্চয়তা তাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। আজ, পাঁচ বছর পর, তাহসিন টোকিও ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি গবেষক হিসেবে কাজ করছেন, মনবুশো স্কলারশিপের বদৌলতে।
এই স্কলারশিপটি কেবল তাহসিনের নয়, বরং বাংলাদেশের শত শত মেধাবী শিক্ষার্থীর স্বপ্ন পূরণের এক সেতুবন্ধন। প্রতিবছর জাপান সরকার ‘মনবুশো’ বা MEXT (Ministry of Education, Culture, Sports, Science, and Technology) Scholarship প্রদান করে, যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মেধাবী শিক্ষার্থীদের জাপানে উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দেয়।
কেন মনবুশো স্কলারশিপ?
জাপান প্রযুক্তি ও গবেষণার ক্ষেত্রে বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর একটি। বিশেষ করে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ, ন্যানোটেকনোলজি, রোবটিক্স এবং সাসটেইনেবল এনার্জি– এসব ক্ষেত্রে জাপানি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার অপার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে যারা এমএসসি বা পিএইচডি করতে চান, তাদের জন্য মনবুশো স্কলারশিপ বিশেষভাবে আকর্ষণীয়, কারণ এটি টিউশন ফি সম্পূর্ণ ফ্রি করে এবং মাসিক ভাতা প্রদান করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, “বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য মনবুশো স্কলারশিপ একটি স্বপ্নপূরণের দরজা। যারা গবেষণা করতে চায়, তাদের জন্য এটি সুবর্ণ সুযোগ, কারণ জাপানে গবেষণার পরিবেশ খুবই উন্নত।”
মনবুশো স্কলারশিপের ধরন ও সুবিধা
মনবুশো স্কলারশিপ কয়েকটি ক্যাটাগরিতে বিভক্ত:
- Research Students (MSc & PhD): মাস্টার্স ও পিএইচডি শিক্ষার্থীদের জন্য।
- Undergraduate Students: স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য।
- Specialized Training College Students: টেকনিক্যাল ট্রেনিং ও ডিপ্লোমা কোর্সের জন্য।
এমএসসি ও পিএইচডি শিক্ষার্থীদের জন্য স্কলারশিপে অন্তর্ভুক্ত সুবিধাসমূহ:
✔ পুরো টিউশন ফি মওকুফ
✔ প্রতি মাসে ১,৪৪,০০০ – ১,৪৮,০০০ ইয়েন (প্রায় ৯০,০০০ – ৯৩,০০০ টাকা) স্টাইপেন্ড
✔ এককালীন ফ্লাইট টিকিট
✔ বিশ্বমানের গবেষণাগারে কাজের সুযোগ
✔ জাপানি ভাষা শিক্ষার সুযোগ (শর্তসাপেক্ষে)
আবেদনের যোগ্যতা ও প্রক্রিয়া
মনবুশো স্কলারশিপের জন্য আবেদন করতে হলে কিছু নির্দিষ্ট যোগ্যতা থাকতে হয়:
✅ বাংলাদেশি নাগরিক হতে হবে।
✅ মাস্টার্সের জন্য আবেদন করলে স্নাতক ডিগ্রি থাকতে হবে, পিএইচডির জন্য আবেদন করলে মাস্টার্স ডিগ্রি প্রয়োজন।
✅ সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে গবেষণার আগ্রহ থাকতে হবে এবং ভালো একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড থাকা উচিত।
✅ জাপানি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসরের অনুমোদন (Letter of Acceptance) নিতে হবে।
আবেদনের ধাপ:
১. Bangladesh Embassy in Japan-এর ওয়েবসাইট থেকে আবেদন ফর্ম ডাউনলোড করুন।
2. প্রয়োজনীয় কাগজপত্র (সনদ, ট্রান্সক্রিপ্ট, গবেষণা প্রস্তাবনা, সুপারিশপত্র) প্রস্তুত করুন।
3. বাংলাদেশে অবস্থিত জাপান দূতাবাসের মাধ্যমে আবেদন করুন।
4. লিখিত পরীক্ষা ও মৌখিক সাক্ষাৎকার দিন।
5. মনোনীত হলে জাপানি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করুন ও প্রফেসরের অনুমোদন নিন।
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা
মনবুশো স্কলারশিপ নিয়ে জাপানে গবেষণা করছেন অনেক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী। ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রোবটিক্স নিয়ে গবেষণা করা রাফসান আহমেদ বলেন, “আমি বাংলাদেশের এক সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। কিন্তু মনবুশো স্কলারশিপ আমাকে জাপানে এনে দিয়েছে, যেখানে আমি বিশ্বমানের গবেষণার সুযোগ পাচ্ছি।”
টোকিও ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ করা নিশাত ফারিয়া বলেন, “জাপানে এসে গবেষণা করার পরিবেশ দেখে আমি অবাক হয়েছি। গবেষণার জন্য আলাদা ল্যাব, ফান্ডিংয়ের বিশাল সুযোগ এবং পেশাদার গবেষকদের সান্নিধ্য – সবকিছুই অনন্য।”
জাপানে উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ ও বাংলাদেশের সম্ভাবনা
জাপানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের আরও বেশি স্বাগত জানাচ্ছে। গবেষণা ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে জাপান-বাংলাদেশ সহযোগিতা ভবিষ্যতে আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ড. ফারহান হোসেন বলেন, “মনবুশো স্কলারশিপ শুধু শিক্ষার্থীদের জন্য নয়, এটি বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এখান থেকে ফিরে আসা গবেষকরা বাংলাদেশের শিক্ষা ও গবেষণা খাতকে সমৃদ্ধ করছেন।”
শেষ কথা
তাহসিন আহমেদের মতো আরও অনেক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী মনবুশো স্কলারশিপের মাধ্যমে নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলছেন। এই স্কলারশিপ শুধু অর্থনৈতিক সহায়তা নয়, এটি একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচনের সুযোগ। যারা গবেষণা ও উচ্চশিক্ষার মাধ্যমে নিজেদের ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে চান, তাদের জন্য জাপানের মনবুশো স্কলারশিপ হতে পারে এক অনন্য পথপ্রদর্শক।
তাই, আপনি কি পরবর্তী মনবুশো স্কলারশিপ বিজয়ী হবেন? এখনই প্রস্তুতি শুরু করুন!
Leave a comment