প্রফেসর- ড. মোহা: ইয়ামিন হোসেন
ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের প্রধান কাজ হওয়া উচিত শিক্ষা ও গবেষণা। একবিংশ শতাব্দীর দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে, গবেষণা ও উদ্ভাবন একটি দেশের টেকসই উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। উন্নত দেশগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শুধু শিক্ষাদানই নয়, বরং জ্ঞান উৎপাদন এবং সেই জ্ঞানকে মানুষের কল্যাণে প্রয়োগ করার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, বাংলাদেশের বাস্তবতায় গবেষণা ও শিক্ষা নিয়ে যে সংকট বিদ্যমান, তা জাতির অগ্রযাত্রায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার সংকট:
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগ শিক্ষকের গবেষণা করার পর্যাপ্ত সুযোগ নেই। এ সংকটের কারণগুলো হলো:
১. গবেষণার জন্য ফান্ডিংয়ের অভাব:
উন্নত দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার জন্য প্রচুর তহবিল বরাদ্দ করা হয়। গবেষণা প্রকল্পের জন্য সরকারি, বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক উৎস থেকে ফান্ড আসে। কিন্তু বাংলাদেশে গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত তহবিল পাওয়া যায় না। শিক্ষকেরা ব্যক্তিগত অর্থ ব্যয় করেও গবেষণা করতে বাধ্য হন, যা তাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টকর।
উদাহরণ:
বাংলাদেশের কৃষি গবেষণায় অনেক বিজ্ঞানী ব্যক্তিগত উদ্যোগে কাজ করেন। অথচ ভারতের মতো দেশে কৃষি গবেষণায় প্রতি বছর হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। এ কারণেই তারা সবুজ বিপ্লব এনে কৃষি উৎপাদনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে পেরেছে।
২. গবেষণা ল্যাব ও সরঞ্জামের অভাব:
অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ল্যাবরেটরি নেই। এমনকি যেসব ল্যাব আছে, সেগুলোতে পর্যাপ্ত সরঞ্জাম নেই। গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় কেমিক্যালস এবং যন্ত্রপাতি কেনার জন্য অর্থের সংকট রয়েছে।
উদাহরণ:
একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত একজন শিক্ষার্থী জানান, গবেষণার জন্য ব্যবহার করা কেমিক্যাল আমদানি করতে গিয়ে বছরের পর বছর লেগে যায়। এ ধরনের বিলম্বে গবেষণার কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়।
৩. গবেষণায় প্রশিক্ষণের অভাব:
বাংলাদেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যান না। তারা আধুনিক গবেষণা পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত নন। ফলে ছাত্রদেরও মানসম্পন্ন গবেষণার জন্য প্রস্তুত করতে পারেন না।
৪. ক্ষেত্র গবেষণার সুযোগের অভাব:
ফিল্ড লেভেলে গবেষণা করার সুযোগ না থাকার কারণে অনেক প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয় গবেষণা থমকে থাকে। প্রকৃতি বা বাস্তব পরিবেশে কাজ করার অভাব গবেষণার ফলাফলকে সীমাবদ্ধ করে ফেলে।
৫. গবেষকদের জন্য ন্যূনতম সুবিধার অভাব:
গবেষকরা যে পরিশ্রম করেন, তার তুলনায় তারা পর্যাপ্ত সুবিধা পান না। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে তাদের জন্য আবাসন, সম্মানজনক বেতন এবং অন্যান্য প্রণোদনা নিশ্চিত করা হয় না।
কেন গবেষণা জরুরি?
গবেষণা একটি দেশের জন্য অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত উন্নয়নের মূল ভিত্তি। উদাহরণস্বরূপ:
১. অর্থনৈতিক উন্নয়ন:
নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে উৎপাদন খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব। ভারত, চীন, এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোর উদ্ভাবনী গবেষণা তাদের অর্থনীতিকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে গেছে।
২. স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন:
আধুনিক চিকিৎসা গবেষণার মাধ্যমে নতুন রোগের প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা সম্ভব হয়েছে। তবে বাংলাদেশের মতো দেশে এ ধরনের গবেষণার অভাবে স্বাস্থ্য খাতে তেমন অগ্রগতি দেখা যায় না।
৪. শিক্ষার মানোন্নয়ন:
গবেষণা মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের গবেষণায় সম্পৃক্ত করা হলে তারা নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করতে পারে।
গবেষণার উন্নয়নে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে:
১. সরকারি ফান্ডিং বৃদ্ধি:
গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত তহবিল বরাদ্দ করা জরুরি। উন্নত দেশগুলোর মতো গবেষণা ও উন্নয়ন (R&D) খাতে বাজেটের একটি বড় অংশ বরাদ্দ করতে হবে।
২. গবেষণার জন্য ল্যাব সুবিধা নিশ্চিত করা:
প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ল্যাব স্থাপন করা এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও কেমিক্যাল সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
৩. গবেষকদের জন্য প্রণোদনা:
গবেষকদের জন্য উচ্চ বেতন, আবাসন সুবিধা এবং অন্যান্য প্রণোদনা নিশ্চিত করতে হবে।
৪. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা:
আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকল্পে অংশগ্রহণ করে উন্নত দেশগুলোর অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তি কাজে লাগাতে হবে।
৫. শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ:
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
উপসংহার:
গবেষণা একটি জাতির উন্নয়নের মেরুদণ্ড। বাংলাদেশে গবেষণার ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যাগুলো দূর করা গেলে দেশের অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়ন বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। এজন্য প্রয়োজন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা এবং সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ। এখন সময় এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের গবেষণায় সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার।
গবেষণায় সহযোগী প্রতিষ্ঠান:
Institute of Natural Resources Research and Development, Rajshahi
Hi-Tech Fisheries & Agro Limited, Rajshahi
বিদ্র: ফেসবুক থেকে সংগ্রহীত—————–https://www.facebook.com/share/p/1DdAZmCyzk/
Leave a comment