পদার্থবিদ্যামহাকাশ

নিঃশব্দ আগুনের নৃত্য: মহাকাশে এক অচেনা শিখার গল্প

Share
Share

রাত্রি গভীর। জানালার কাঁচে ঠকঠক করে বৃষ্টি পড়ছে। ঘরের এক কোণে একটি মোমবাতি জ্বলছে। সেই আগুনের শিখা—কমলা রঙের, উপরের দিকে টানা, অশ্রুর মতো আকৃতি নিয়ে—চিরচেনা। যেন অন্ধকারের মাঝে কোনো এক রহস্যময় নৃত্যশিল্পী নিঃশব্দে তার শিল্প পরিবেশন করছে। কিন্তু আপনি যদি এই আগুনটিকে পৃথিবী থেকে তুলে নিয়ে মহাশূন্যে পাঠিয়ে দেন? তাহলে আগুনটা কি একই রকম থাকবে?

এই প্রশ্নের উত্তর জানার আগে চলুন আমরা যাই একটি কাল্পনিক যাত্রায়। কল্পনা করুন, আপনি একজন মহাকাশচারী। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের (ISS) ভিতরে একটি পরীক্ষাগারে আপনি একটি ছোট্ট আগুন জ্বালালেন। মুহূর্তেই চোখে পড়বে বিস্ময়কর এক দৃশ্য—আগুন আর আগুনের মতো নেই! কমলা নয়, বরং এক নিখুঁত, নীলচে গোলক। একে দেখে মনে হবে যেন কোনো ছোট নীল জ্যোতিষ্ক ধীরে ধীরে জ্বলছে—কোনো শব্দ নেই, কোনো দোলা নেই, কেবল নিঃশব্দ, নিঃসংকোচ শিখা।

অপরূপ এই পরিবর্তনের পেছনের বৈজ্ঞানিক সত্য

পৃথিবীতে আগুন জ্বলে উঠতে যে চিত্র আমরা দেখি, তার মূল ভিত্তি হল “সংবহন” বা convection। আমাদের চারপাশে থাকা ঠান্ডা, ভারী বাতাস নিচে নেমে আসে এবং আগুনের শিখাকে অক্সিজেন জোগায়। সেই সাথে উত্তপ্ত গ্যাসগুলো উপরের দিকে উঠে যায়। ঠিক যেমন আগুনের ধোঁয়া ওপরের দিকে উড়ে যায়। এই ওঠানামার ফলেই শিখার আকৃতি টানাটানির মতো হয়ে ওঠে।

কিন্তু মহাশূন্যে, যেখানে মাধ্যাকর্ষণ নেই—সেখানে এই সংবহন প্রক্রিয়া কাজ করে না। বাতাস ধীরে ধীরে চারপাশে সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং অক্সিজেন আগুনের চারপাশে সমভাবে পৌঁছায়। এই ধীর ছড়িয়ে পড়ার প্রক্রিয়াকে বলে “diffusion”। ফলে আগুন হয় অনেক বেশি স্থিতিশীল, গাঢ় নীল, এবং প্রায় নিখুঁত গোলাকার।

“এই শিখা দেখে মনে হয়েছিল কোনো জীবন্ত নীলকণা আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে,” বলছিলেন নাসার প্রাক্তন মহাকাশচারী ড. ক্যাথরিন থর্ন, যিনি ২০১৪ সালে মহাকাশে আগুন সংক্রান্ত পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। তিনি আরও যোগ করেন, “সেই অভিজ্ঞতা আমাকে প্রথমবার অনুভব করিয়েছিল, আমরা পৃথিবীর নিয়ম-নীতির কতটা গভীরে আটকে আছি। মহাশূন্যে সবকিছু কত ভিন্ন, কত নতুন!”

মহাশূন্যে আগুন: শুধু চোখের আরাম নয়, বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র

এই অনন্য বৈশিষ্ট্য শুধু বিস্ময়ের উপকরণ নয়, বরং গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক গবেষণার ভিত্তি। মহাশূন্যে আগুনের এই আচরণ বুঝতে পারলে আমরা ভবিষ্যতের মহাকাশযাত্রাকে আরও নিরাপদ করতে পারবো। একই সাথে পৃথিবীতে আরও উন্নত ও পরিচ্ছন্ন জ্বালানী ব্যবস্থার জন্য পথ খুলে যাবে।

“Microgravity পরিবেশে আগুনের আচরণ পর্যবেক্ষণ করে আমরা নতুন ধরনের দহন প্রযুক্তি তৈরি করতে পারি,” বলেন ড. রবার্ট কারসন, Combustion Science Group-এর প্রধান গবেষক। “এমন গবেষণা গ্যাস টারবাইন ইঞ্জিন, পরিবেশবান্ধব জ্বালানী এবং এমনকি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়েও ভূমিকা রাখতে পারে।”

বাংলাদেশের বিজ্ঞানপ্রেমীদের জন্য এক নতুন দৃষ্টিকোণ

এই গবেষণার খবর পড়ে উত্তরা ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জারিন রহমান বলেন, “বিজ্ঞান কেবল বইয়ের থিওরি নয়—এই গল্পগুলো প্রমাণ করে যে গবেষণা মানে বিস্ময়ের জগতে প্রবেশ করা। আমি এখন মহাকাশে দহন নিয়ে নিজেই কিছু গবেষণা করতে আগ্রহী।”

এই ধরনের উৎসাহই তৈরি করে ভবিষ্যতের বিজ্ঞানীদের। বিজ্ঞান যখন কল্পনার সাথে মিলে যায়, তখন সে হয়ে ওঠে গল্পের মতো—যা আমাদের জ্ঞানই শুধু নয়, বরং কল্পনার সীমানাকেও প্রসারিত করে।

শেষ কথায়…

একটি শিখা—পৃথিবীতে যা আমাদের ঘর উষ্ণ রাখে, আলো দেয়, তা-ই মহাশূন্যে গিয়ে প্রকাশ করে এক অভূতপূর্ব রূপ। এই রূপ শুধু রঙেই নয়, বিজ্ঞানে, কার্যকারণে এবং সৌন্দর্যেও অনন্য।

এ যেন আমাদের শেখায়—প্রকৃতি তার নিয়ম সবখানে একভাবে প্রয়োগ করে না। পরিবেশের পরিবর্তনে বাস্তবতাও বদলায়, বদলায় আমাদের উপলব্ধি।

আগুন সেই আগুনই থাকে, কিন্তু পরিবেশ বদলালে তার নৃত্যটাও হয়ে ওঠে এক অনন্য ব্যালে। আপনি কি ভাবছেন, এমন আরও কত অজানা বিস্ময় অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য?

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
পদার্থবিদ্যাবিজ্ঞান বিষয়ক খবর

বিজ্ঞান ভুল পথে? কোয়ান্টাম বলছে ‘হ্যাঁ’—না কি?

কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা কি আমাদের বিপথে ঠেলে দিচ্ছে? নোবেল বিজয়ী জেরার্ড হুফ্ট কোয়ান্টাম...

গল্পে গল্পে বিজ্ঞানমহাকাশ

তারাদের ঠিকানা: কীভাবে এক টুকরো আগুন পৃথিবীর প্রাণের উৎস হয়ে ওঠে?

বিশাল মহাবিশ্বে নক্ষত্ররা কীভাবে জন্মগ্রহণ করে, বেঁচে থাকে এবং মারা যায় তা...

উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সুযোগপদার্থবিদ্যা

ঘূর্ণিপাকে হারানো কণার খোঁজে: নিউট্রিনোর রহস্যময় ওজনের দিকে এগিয়ে চলেছে বিজ্ঞান

মহাবিশ্বের গভীরতম রহস্য বোঝার দিকে এক অগ্রযাত্রা - যুগান্তকারী ক্যাট্রিন পরীক্ষার মাধ্যমে...

গল্পে গল্পে বিজ্ঞানপদার্থবিদ্যা

থিওরি অফ এভরিথিং এর খোঁজে

বাংলায় "The Theory of Everything" এর অনুসন্ধান সম্পর্কে জানুন—কীভাবে বিজ্ঞান এবং দর্শন...

পদার্থবিদ্যা

Superdeterminism

সুপারডিটারমিনিজম হলো একটি ধারণা যেখানে মনে করা হয়, মহাবিশ্বের প্রতিটি ঘটনা এবং...

Three Columns Layout

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact

biggani.org❤️gmail.com

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

যোগাযোগ:

biggani.org@জিমেইল.com

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.