একদিন এক কিশোর ছেলে, নাম তার জেরার্ড, খেলার মাঠে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশ দেখছিল। তার চোখে ছিল এক ধরনের বিস্ময়—প্রতিটি তারা যেন একেকটি রহস্যময় প্রশ্নবোধক চিহ্ন। হঠাৎ তার মনে হলো, এই তারা আর অন্ধকারের মাঝে কোথাও হয়তো লুকিয়ে আছে এমন কোনো নিয়ম, যা পুরো মহাবিশ্বকে চালনা করে। সেই মুহূর্তেই সে অনুভব করল, ভবিষ্যতে এই রহস্যের জবাব খোঁজাই হবে তার জীবনব্রত। অসংখ্য তারা ঝিকমিক করছিল, আর সে ভাবছিল—এই মহাবিশ্বের পেছনে আসল নিয়মগুলো কী? দশকের পর দশক পেরিয়ে, সেই ছেলেটিই হয়ে উঠেছে পৃথিবীর সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ বিজ্ঞান পুরস্কারপ্রাপ্ত এক ব্যক্তি—জেরার্ড ‘ত হুফ্ট।
তাঁর গবেষণা বদলে দিয়েছে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের মানচিত্র। নোবেল, ফ্র্যাঙ্কলিন, ওলফ—পুরস্কার তাঁর ঝুলিতে অনেক। কিন্তু সম্প্রতি তিনি পেলেন ‘Special Breakthrough Prize in Fundamental Physics’। পুরস্কারের অর্থমূল্য তিন মিলিয়ন ডলার, কিন্তু তার চেয়েও বড় বিষয়, তিনি যা বললেন পুরস্কার পাওয়ার পর—“আমরা হয়তো ভুল পথে এগোচ্ছি কোয়ান্টাম ফিজিক্স নিয়ে।”
“সবাই যদি একইভাবে ভাবে, কিছুই বদলায় না”
সাংবাদিক লি বিলিংসের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ‘ত হুফ্ট বলেন, “আজকের বিজ্ঞানীরা সবাই একভাবে চিন্তা করে। এ কারণেই হয়তো বড় কোনো ‘ব্রেকথ্রু’ আসছে না। কনভেনশনাল চিন্তা থেকে বের হতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “১৯৭০-এর দশকে আমরা নতুন কিছু আবিষ্কার করেছিলাম, কারণ আমরা অন্যভাবে চিন্তা করেছিলাম। আজও সেটাই দরকার। মানুষ এখন কেবল তথ্যের উপরে দাঁড়িয়ে, প্রশ্ন করার সাহস হারিয়ে ফেলছে।”
কোয়ান্টাম মেকানিক্স কি তাহলে ভুল?
বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বিপ্লবী বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলোর একটি হলো কোয়ান্টাম মেকানিক্স। এটিই আমাদের দেখিয়েছে, কণামাত্রার জগত কতটা অনির্দেশ্য হতে পারে। কিন্তু ঠিক এখানেই দ্বিধা জাগে। বহু বিজ্ঞানী একে বাস্তবতার নিখুঁত প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখলেও, কিছু বিজ্ঞানী একে দেখেন কেবল একটি পরিসংখ্যানভিত্তিক মডেল হিসেবে। নোবেলজয়ী পদার্থবিদ জেরার্ড ‘ত হুফ্ট সেই দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গির একজন—তাঁর মতে, প্রকৃত বাস্তবতা আরও ক্লাসিক্যাল, আরও সহজবোধ্য।
জেরার্ডের মতে, কোয়ান্টাম মেকানিক্স আসলে ‘স্ট্যাটিস্টিকাল ট্রিক’—একটা গাণিতিক পদ্ধতি মাত্র, বাস্তব নয়। “বিড়ালটি বেঁচে না মৃত—এই প্রশ্নের উত্তরে ‘দুই অবস্থার সুপারপজিশন’ বলাটা ননসেন্স,” তিনি বলেন, যা স্পষ্টতই শ্রোডিঙ্গারের বিখ্যাত চিন্তাধারার প্রতি এক তীব্র প্রশ্ন।
তার দাবি, প্রকৃতি আসলে ‘ক্লাসিক্যাল’ অর্থাৎ পুরোপুরি নির্ধারিত নিয়মে চলে। আমরা এখনো সেসব নিয়ম আবিষ্কার করিনি—এবং সমস্যা হলো, আমরা সেসব খোঁজার চেষ্টা করছি কোয়ান্টাম লেন্স দিয়ে, যেটা বাস্তব নয়।
“কণাগুলো পিয়ানোর মতো আচরণ করে”—কি বোঝাতে চাইলেন তিনি?
তিনি বলেন, “যেভাবে দুটি গ্র্যান্ড পিয়ানো সংঘর্ষে গেলে আমরা তার গতিপথ নির্ধারণ করতে পারি, তেমনি কণাগুলোর আচরণও নির্ধারিত হওয়া উচিত। কিন্তু কোয়ান্টাম তত্ত্ব বলে—না, এটা সম্ভাব্যতার খেলা।”
তিনি এখানেই সন্তুষ্ট নন। তিনি চান, বিজ্ঞানীরা প্রশ্ন করুক—এই নির্দিষ্ট আচরণ ঠিক কীভাবে হয়? কী অভ্যন্তরীণ নিয়ম কাজ করে যে এক কণার সাথে আরেক কণার সংঘর্ষে নির্দিষ্ট আচরণ দেখা যায়?
“নন-লোকালিটি একটি বিজ্ঞান-ধ্বংসকারী ধারণা”
আধুনিক কণার তত্ত্বে “নন-লোকালিটি” বা দূরবর্তী কণার প্রভাব পড়ার ধারণা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু জেরার্ড বলেন, “এই ধারণা বৈজ্ঞানিক নিয়মগুলোর জন্য এক ধরনের বিপর্যয়। প্রকৃত নিয়মগুলো অবশ্যই লোকাল হওয়া উচিত—অর্থাৎ যা ঘটছে, তা ওই স্থানেই নির্ধারিত হবে।”
এই বক্তব্য নিয়ে বিশিষ্ট বিজ্ঞান লেখক ড. অমিতাভ কর, যিনি কোয়ান্টাম ফিজিক্স ও বিজ্ঞানের দর্শন নিয়ে বহু বছর ধরে লিখছেন এবং বাংলাদেশ বিজ্ঞান পরিষদের একজন সম্মানিত সদস্য, বলেন, “জেরার্ড ‘ত হুফ্ট সাহসের সাথে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন—আমরা সম্ভবত এক ফাঁদে আটকে গেছি। এটা ভবিষ্যতের বিজ্ঞানীদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।”
তাহলে কী করণীয়?
‘ত হুফ্ট বলেন, “প্রশ্ন করতে শিখুন। যে ধারণাকে সবাই সত্য বলে ধরে নিয়েছে, সেটার উপরেই প্রশ্ন তোলেন। তখনই আসবে নতুন আবিষ্কার।” তাঁর মতে, আমাদের আবার শুরুতে ফিরে যেতে হবে—ঠিক যেমন ম্যাক্সওয়েল বিদ্যুৎ ও চৌম্বকতা নিয়ে করেছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আলিফা রওশন বলেন, “আমি যখন প্রথম কোয়ান্টাম মেকানিক্স পড়ি, তখন বিষয়টি আমার কাছে বেশ জটিল মনে হয়েছিল। আসলে, পদার্থবিজ্ঞানের সৌন্দর্যটাই হলো নতুন কিছু আবিষ্কারের প্রয়াসে ক্রমাগত প্রশ্ন করার মধ্যে। এই ধরনের বিতর্ক আমাদের শুধু ভাবনার পরিধিই প্রসারিত করে না, বরং আমাদের উৎসাহিত করে প্রচলিত ধারণাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করতে। আমি মনে করি, এটি ভবিষ্যতের পদার্থবিদদের জন্য খুব জরুরি।” “এ ধরনের বিতর্ক আমাদের ভাবনার পরিধিকে প্রসারিত করে। আমরা যদি সবসময় ঠিক ধরা তত্ত্বগুলোকে চ্যালেঞ্জ না করি, তাহলে নতুন কিছু কখনোই আবিষ্কার হবে না।”
শেষ কথা: বৈজ্ঞানিক সাহসের দরকার
বিজ্ঞান সবসময়ই প্রশ্ন করা, পরীক্ষানিরীক্ষা করা, এবং তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করার উপর দাঁড়িয়ে। জেরার্ড ‘ত হুফ্ট আমাদের মনে করিয়ে দিলেন, অবিশ্বাস করাটাও এক ধরনের বিজ্ঞান। এবং সেই সন্দেহ থেকেই বেরিয়ে আসবে ভবিষ্যতের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার।
“কোয়ান্টাম যদি ভুল না-ও হয়, তবুও প্রশ্ন করো। কারণ প্রশ্নই আমাদের এগিয়ে নিয়ে যায়।”—জেরার্ড ‘ত হুফ্ট
Leave a comment