বই আলোচনাবিজ্ঞানীদের জীবনী

ওমর খৈয়াম: সাহিত্যের আকাশে এক চিরকালীন নক্ষত্র

Share
Share

ঢাকার এক বিরান সন্ধ্যায় পুরনো বইয়ের দোকানে বসে কাজী আরিফ হঠাৎই যেন এক নতুন জগতের সন্ধান পেলেন।
ধুলোমাখা বইয়ের স্তূপের ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছিল একটি ছোট্ট গ্রন্থ—ওমর খৈয়ামের “রুবাইয়াত।” পাতাগুলো ছিল হলদে, কোনার দিকে জায়গায় জায়গায় ছিঁড়ে যাওয়া। কিন্তু তার মাঝেও যেন লুকিয়ে ছিল এক রহস্যময় আলোর ছোঁয়া। বইটির ভূমিকা পড়ে আরিফ বুঝলেন, এই কবিতা কেবল ভাবনার খোরাকই নয়, বরং জীবনকে নতুনভাবে দেখার অভিজ্ঞতা।

যতই তিনি পৃষ্ঠা উল্টালেন, ততই যেন ডুবে গেলেন একটি অসীম দর্শনের গভীরে।
প্রতিটি কবিতায় ছিল জীবন ও মৃত্যু, প্রেম ও পরম সত্যের অকপট অনুসন্ধান। আরিফ বলেন, “এই রুবাইয়াত শুধু ছন্দের খেলা নয়, এটি আমার মনের দুয়ার খুলে দিয়েছে। মনে হচ্ছে, নিজের অস্তিত্বের বহুদিকে আগ্রহী চোখ মেলে তাকাতে শিখছি।”

ওমর খৈয়াম—যার পুরো নাম গিয়াসউদ্দিন আবুল ফাতাহ ওমর ইবনে ইব্রাহিম আল-খৈয়াম—ছিলেন একাধারে কবি,
গণিতবিদ, দার্শনিক ও জ্যোতির্বিদ। একাদশ শতকের শেষভাগ ও দ্বাদশ শতকের প্রথমভাগে ইরানের নিশাপুরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। তাঁর বিস্ময়কর মেধা ও পাণ্ডিত্য কেবল মধুর কাব্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না; গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানেও তিনি অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, তিনি জালালী বর্ষপঞ্জির সংশোধনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।

আন্তর্জাতিক খ্যাতনামা গবেষক ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. আসমা জাহান বলেন,
“ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াত প্রায়শই প্রেম ও পানীয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হলেও, এর ভেতরে বহুমাত্রিক দর্শন খেলা করে। তিনি একদিকে মানবজীবনের অস্থায়ী ও ক্ষণস্থায়ী প্রকৃতিকে চিহ্নিত করেছেন, অন্যদিকে আবার অনন্ত সত্যের সন্ধানেও মগ্ন ছিলেন।”

তবে ওমর খৈয়ামের খ্যাতির পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন ব্রিটিশ কবি ও অনুবাদক এডোয়ার্ড ফিটজগেরাল্ড।
তার হাতে রুবাইয়াত-এর ইংরেজি অনুবাদ পৌঁছানোর পর থেকেই বিশ্বসাহিত্যের মোড়ে মোড়ে খৈয়ামের নাম ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু খৈয়ামের মূল কবিতার আস্বাদ পেতে অনেকেই আজও পড়েন ফারসি ভাষায় তাঁর রুবাইয়াত। অনেক পাঠক মনে করেন, ইংরেজি অনুবাদে কবিতার শৈল্পিকতা কিছুটা ক্ষুন্ন হয়েছে, তবু সাধারণ পাঠকের কাছে জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে এই অনুবাদই।

অনেকেই ভাবতে পারেন—একজন মধ্যযুগীয় পণ্ডিত,
তিনি কীভাবে আজকের যুগের মানুষের মনে জায়গা করে নিলেন? ভাষাবিশারদ ও কবি আলীম উল্লাহ খান বলেন, “ওমর খৈয়ামের শক্তি ছিল মূলত তার জীবনবোধে। তিনি দেখিয়েছেন, জীবনকে খুব গভীরভাবে বোঝার পাশাপাশি একে উপভোগও করতে হবে। সত্যের সন্ধান যেখানে গভীর মননের ব্যাপার, সেখানে আনন্দের পাঠও ছেড়ে দেওয়া যাবে না। আধুনিক যুগে মানুষ যখন মানসিক চাপ আর যান্ত্রিক জীবনের ফাঁদে বন্দি, তখন খৈয়ামের দর্শন এক পরম মুক্তির বার্তা দিয়ে যায়।”

ঢাকার বইমেলায় কথাসাহিত্যিক মাহমুদা হক স্বচক্ষে দেখেছেন তরুণদের মাঝে খৈয়ামের কবিতা নিয়ে আগ্রহ।
তিনি বলেন, “নবীন পাঠকরা আজ প্রযুক্তিপ্রবণ হলেও, একবার ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াতের স্বাদ পেলে তারা বিস্মিত হয়। জীবনকে নতুন করে ব্যাখ্যা করতে, নিজেকে প্রশ্ন করতে শেখায় এসব কবিতা।”

এই আগ্রহের পেছনে আছে খৈয়ামের লেখা রুবাইয়াতের সহজিয়া ভাষা ও ছোট ছোট চরণে জীবনের মূল সত্যকে ধরবার প্রচেষ্টা।
প্রেম, সময়, মৃত্যু বা ক্ষণিকতা—প্রতিটি রুবাইয়ের পেছনেই তিনি যেন ইঙ্গিত দিয়েছেন এক মরমি উদ্ভাসের। আবার কোথাও কোথাও দেখা যায় কৌতুক বা সংশয়ের সুর, যেখানে ঈশ্বর ও সৃষ্টিকে নিয়ে প্রশ্ন করতেও তিনি দ্বিধা করেননি। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁর এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, “খৈয়ামের দর্শন জীবনকে করে তোলে অকুতোভয়; সে আমাদের স্মরণ করায় যে, মহৎ শিল্পের গুণে মানুষ নিজেই আপন ব্রহ্মাণ্ডের পর্যটক।” যদিও এটি সরাসরি রুবাইয়াতকে ঘিরে লেখা কোনো মন্তব্য নয়, তবু খৈয়ামের কাব্যিক দর্শনের সঙ্গে রবীন্দ্রচেতনার মিল খুঁজে পান অনেকে।

অন্যদিকে,
ধর্মীয়ভাবে রক্ষণশীল অনেকের কাছে ওমর খৈয়ামের বেশ কিছু কবিতার বক্তব্য বিতর্কিত মনে হয়েছে। অতীত ও বর্তমানেও এ বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। তবুও সাহিত্যবোদ্ধারা মনে করেন, খৈয়াম তাঁর সময়ের চেয়ে
অনেক অগ্রগামী ছিলেন এবং চিন্তাচর্চায় যে মুক্তির ধারা এনেছিলেন, সেটির জন্য তাঁকে আজো স্মরণ করা হয়।

এখন প্রশ্ন হলো,
এই জগতজোড়া জনপ্রিয়তার নেপথ্যে কি কেবল তাঁর “রুবাইয়াত”? ইতিহাসের পাতায় চোখ দিলে দেখা যায়, খৈয়াম গণিত আর জ্যোতির্বিজ্ঞানে অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর লেখা গণিতগ্রন্থগুলোতে বাইনারি বা ত্রিভুজের সূত্র ও শূন্য ধারণার মতো গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার ভিত্তি বিদ্যমান ছিল। সেই সময়ে জ্যোতির্বিদ্যাকে আরও নিখুঁত ভাবে বুঝতে ও গ্রহ-নক্ষত্র পর্যবেক্ষণে তিনি এনেছিলেন নানা নতুন পদ্ধতি।

তাঁর বহুমুখী অবদান আজও মানবসমাজকে ভাবায়—কিভাবে একজন মানুষের মধ্যে এত ক্ষেত্রের প্রতি সমান নিবেদন ও দক্ষতা বিকশিত হলো? বর্তমান সময়ের পাঠক ও গবেষকদের কাছে সেজন্যই ওমর খৈয়াম এক অমর উৎসাহের প্রতীক।

জনপ্রিয় পাঠক সুমাইয়া রশীদ জানান,
“বইমেলায় রুবাইয়াতের নতুন সংস্করণ পেয়েছি। খৈয়ামের কবিতার সঙ্গে তাঁর জীবন ও গবেষণা সম্পর্কে খানিকটা আলোচনা ছিল, যার মধ্যে গণিতচর্চার ব্যাপারটাও খুব সুন্দরভাবে উঠে এসেছে। সত্যি বলতে, যতই পড়ি, ততই বিস্মিত হই যে এক মানুষই এত গুণের অধিকারী ছিলেন।”

সর্বশেষে বলা যায়,
খৈয়ামকে ঘিরে যে মুগ্ধতা, তা কেবল তাঁর কবিতায় সীমাবদ্ধ নয়। দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য—সর্বত্রই তাঁর বিচরণ মানুষের মনকে আন্দোলিত করে চলেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। একদিকে সুর আর ছন্দে জেগে ওঠা প্রেম ও সময়ের গল্প, অন্যদিকে জ্যোতির্বিজ্ঞান আর গণিতের সুগভীর সাধনা—এই দুই মেরুর মধ্য দিয়ে তিনি যেন ইতিহাসকে স্পর্শ করেছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন, সৃষ্টির উপাসনা কেবল ধর্ম কিংবা একক কোনো চেতনায় নয়; বরং জ্ঞান, সৌন্দর্য ও স্বাধীন ভাবনায় খুঁজে পাওয়া যায় মানুষের প্রকৃত মুক্তি।


সংবাদপ্রতিবেদক: তাহমিদা রহমান, ঢাকা

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
ইতিহাসের এই দিনেবিজ্ঞানীদের জীবনী

আব্বাস ফারনাস: আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নে ঋদ্ধ এক মুসলিম কিংবদন্তি

নবম শতাব্দীর মুসলিম বহুবিদ্বান আব্বাস ইবনে ফিরনাসের অনুপ্রেরণামূলক গল্পটি আবিষ্কার করুন -...

ইতিহাসের এই দিনেবিজ্ঞানীদের জীবনী

আল বিরুনি: ইতিহাসের ধুলো ঝেড়ে জেগে উঠা এক জ্ঞানযাত্রার নক্ষত্র

আল বিরুনির অসাধারণ জীবন এবং অবদান অন্বেষণ করুন - একজন মধ্যযুগীয় মুসলিম...

চিকিৎসা বিদ্যাবিজ্ঞানীদের জীবনী

আল–রাজি: মধ্যযুগের চিকিৎসাবিদ্যার আলোকবর্তিকা

আল-রাজির অনুপ্রেরণামূলক গল্পটি আবিষ্কার করুন, একজন কিংবদন্তি পারস্যের চিকিৎসক যার যুগান্তকারী অবদান...

বইবই আলোচনা

বিজ্ঞান লেখক: আবদুল গাফফার রনি নতুন কিছু বই

বাংলাতে সহজ ভাষায় বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলি সহজ ভাবে উপস্থাপন করার মতন এক...

Three Columns Layout

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact

biggani.org❤️gmail.com

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

যোগাযোগ:

biggani.org@জিমেইল.com

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.