চৌধুরী ফখরুল আলম,
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক লেখক, গ্যাজেট প্রেমী এবং প্রচন্ড কৌতূহলী একজন মানুষ। ছবি তুলতে আর ঘুরতে ভালবাসি। প্রতিভা নষ্ট হতে দেখলে ব্যথিত হই তাই আমার মূল লক্ষ্য – লেখার মাধ্যমে মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধি করা।
মাহিনের কলেজে রমজানের ছুটি শুরু হয়েছে। তার বহুদিনের ইচ্ছা ছিল ছুটিতে ঢাকায় এসে দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখার। সে বাসে করে ঢাকায় পৌঁছাল, কিন্তু রাস্তায় প্রচণ্ড জ্যাম দেখে তার মাথায় হাত! তবে সে হাল ছাড়ল না। স্মার্টফোন বের করে গুগল ম্যাপ খুলল এবং গন্তব্য হিসেবে আহসানমঞ্জিল ইনপুট করল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে অ্যাপটি অসংখ্য সম্ভাব্য রাস্তা বিশ্লেষণ করে দ্রুততম পথটি দেখিয়ে দিল। সে উবার ডেকে সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছে গেল। প্রযুক্তির কল্যাণে একটি জটিল যাত্রা সহজ হয়ে গেল।
ধরো, মাহিনের সাথে স্মার্টফোন নেই। উত্তরা থেকে আহসানমঞ্জিল যাওয়ার জন্য ১০টি সম্ভাব্য রাস্তা আছে। সবচেয়ে দ্রুত পথটি বেছে নিতে হলে তাকে হয় নিজে প্রতিটি রাস্তা পরীক্ষা করতে হবে—একটি অবাস্তব, ক্লান্তিকর ও সময়সাপেক্ষ কাজ—নয়তো অন্যের পরামর্শের ওপর নির্ভর করতে হবে যা অনেক ক্ষেত্রেই অনির্ভরযোগ্য হয়। কিন্তু একটি কম্পিউটারের জন্য এটি সহজ। গুগলের ক্লাউড সার্ভার অ্যালগরিদম ব্যবহার করে হাজার হাজার রাস্তার মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর পথটি মুহূর্তেই খুঁজে বের করতে পারে। এটিই কম্পিউটিংয়ের শক্তি: জটিল সমস্যাগুলো দ্রুত ও নির্ভুলভাবে সমাধান করা।
তবে এই শক্তিশালী ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারেরও সীমাবদ্ধতা আছে। কিছু সমস্যা এতটাই জটিল যে, সেগুলো সমাধানে এদের বছরের পর বছর লেগে যেতে পারে। এখানেই আসে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং—যা সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে।
ক্লাসিকাল কম্পিউটারের গণন ক্ষমতার একক হচ্ছে – বিট। ০ অথবা ১। ০ মানে একটি ট্রান্সিস্টরের সুইচ বন্ধ আর ১ মানে সুইচ খোলা। এরকম অতি ক্ষুদ্র কয়েক লক্ষ ট্রান্সিস্টর সুইচ নির্দিষ্ট নকশা অনুযায়ী মাকড়শার জালের মত বুনে তৈরী হয় একটি চিপলেট বা চিপের অংশ। এই শত লক্ষ সুইচ ইনপুট এর ভিত্তিতে সয়ংক্রিয় ভাবে লক্ষ লক্ষ গাণিতিক হিসাব করতে থাকে যার আউটপুট হিসেবে বের হয়ে আসে। কিন্তু এমন কিছু সমস্যা রয়েছে যার সমাধান করতে ক্লাসিকাল কম্পিউটারের ক্রমান্বয়ে তথ্য প্রক্রিয়া করার বৈশিষ্ট্যের কারণে হাজার বছর লেগে যেতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, ধরো একজন বিজ্ঞানী যিনি অনু – পরমাণু নিয়ে গবেষণা করেন। গবেষণার খাতিরে তাকে একটি ইলেক্ট্রনের গঠণ, বৈশিষ্ট, আচরণ কম্পিউটারে বাস্তবসম্মত অনুকরণ বা সাদৃশ্যকরণ করার প্রয়োজন পড়ে। ইতোমধ্যে আমরা জেনেছি ক্লাসিক্যাল কম্পিউটার যে কোন কিছু হিসাব করতে গেলে হিসাবের ক্ষুদ্রতম অংশ 0 বা 1 তথা একপ্রকার পরম-দ্বৈত (Absolute Binary) দশার সাহয্যে প্রকাশ করতে হয়। এদিকে, কোয়ান্টাম মেকানিক্স অনুসারে, একটি ইলেক্ট্রনের অবস্থান একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে না থেকে একটি সম্ভাব্যতা বন্টন দ্বারা বর্ণিত হয়, যা অসংখ্য সম্ভাব্য মান ধারণ করে। ফলে এটি কোন পরম-দ্বৈত (Absolute Binary) দ্বারা পরিচালিত কোন হিসাব ব্যবস্থা দ্বারা গাণিতিক ভাবে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কারণ এটি শ্রেণীগত ভাবেই ভিন্ন একটি হিসাব ব্যবস্থা।
একটা উদাহরণ দেই – ধরো, আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করলাম, “এখান থেকে তোমার বাড়ি কতদূর?”
আর বললাম, ”এই প্রশ্নের উত্তরে নিয়ে দুইটা থেকে যেকোন একটা অপশন বেছে নিতে হবে।”
ক) হ্যাঁ
খ)না
আমি কি সঠিক কোন উত্তর পাবো?
বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা নয়, বরং ক্লাসিক্যাল বিটের সীমাবদ্ধতার কারণে—যা শুধু ০ বা ১ হতে পারে—এই কোয়ান্টাম অবস্থাগুলো সঠিকভাবে উপস্থাপন করা যায় না। ফলে, কোয়ান্টাম সিস্টেম (যেমন একটি হাইড্রজেন পরমাণু) সিমুলেট করতে ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের গণনার সময় অসম্ভব দীর্ঘ হয়ে যায়। এছাড়া আবহাওয়া পূর্বাভাস, ঔষধ উন্নয়ন, ডাটা নিরাপত্তা এরকম বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ক্লাসিকাল কম্পিউটার ক্ষমতার দৌড়ে পিছিয়ে পরছে।
মাহিনের উদাহরণে ফিরে যাই। ধরা যাক, উত্তরা থেকে আহসানমঞ্জিল যাওয়ার ১০টি রাস্তা আছে। ক্লাসিক্যাল কম্পিউটার প্রতিটি রাস্তা ধাপে ধাপে পরীক্ষা করে দ্রুততমটি বের করবে। কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটার একই সাথে যুগপৎভাবে সকল সম্ভাব্য রাস্তা বিশ্লেষণ করে সরাসরি সবচেয়ে দ্রুত পথটি খুঁজে দেবে—অনেক দ্রুত ও কার্যকরভাবে।
তবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি এবং তা টেকসই ভাবে পরিচালনা করা কোন সহজ কাজ নয়। এর সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে:
১. কিউবিট স্থিতিশীলতা (Qubit Stability): কোয়ান্টাম কম্পিউটারের তথ্য ধারণ বা প্রক্রিয়া করনের সর্বনিম্ন একক হলো কিউবিট। এগুলো খুব সংবেদনশীল এবং সহজেই পরিবেশের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে তার ভেতরে ধারণকৃত তথ্য গড়মিল করে ফেলে।
২. কোয়ান্টাম অসামাঞ্জশ্যতা (Quantum Decoherence): কিউবিটগুলোর কোয়ান্টাম অবস্থা বেশিক্ষণ ধরে রাখা কঠিন। তারা খুব দ্রুত সাধারণ অবস্থায় ফিরে যায়, এতে গণনা করার ক্ষমতা কমে যায়।
৩. ত্রুটি সংশোধন (Error Correction): কোয়ান্টাম কম্পিউটারে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এই ভুলগুলো চিহ্নিত করে সংশোধন করার জন্য জটিল প্রযুক্তি তৈরি করতে হয়, যা এখনো পুরোপুরি তৈরি নয়।
৪. স্কেলিং (Scaling): কার্যকরী কোয়ান্টাম কম্পিউটারের জন্য অনেক বেশি কিউবিট দরকার। এই সংখ্যা বাড়ানো এবং তাদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
৫. প্রযুক্তিগত জটিলতা (Technological Complexity): কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি এবং পরিচালনা করার জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, যেমন – অতি শীতল তাপমাত্রা এবং জটিল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রয়োজন।
এখন আসি মাইক্রোসফট এর সাম্প্রতিক চমক- মায়োরানা-০১ কোয়ান্টাম চিপের ব্যাপারে। সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে তৈরী এই কোয়ান্টাম চিপ যা তৈরী করতে মাইক্রোসফটকে নতুন এক ধরনের পদার্থের অবস্থা (টপোলজিকাল স্টেট বা দশা) আবিষ্কার করতে হয়েছে। অত্যন্ত জটিল গবেষণা এবং অনেক বছরের নিরলস পরিশ্রমের ফলে এই নতুন ধরনের পদার্থের দশার বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগিয়ে তারা টপোলজিকাল কন্ডাক্টর নামক একধরনের ন্যানো স্কেল রিং তৈরী করতে সক্ষম হয় যা কিউবিট হিসেবে কাজ করতে পারে এবং যা সমসাময়িক তুলনাযোগ্য অন্যান্য কিউবিট প্রযুক্তি থেকে অনেক ধাপ উন্নত এবং কার্যক্ষম। এখন আমরা দেখব, বিশ্বের এই প্রথম টপোলজিকাল কোরের তৈরী Quantum Processing Unit (QPU) কিভাবে পূর্ববর্তী প্রতিবন্ধকতাকে সামলানোর চেষ্টা করে- মাইক্রোসফট “মায়োরানা-১” কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের চ্যালেঞ্জগুলো কীভাবে মোকাবিলা করছে, তা এখানে সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো:
১. কিউবিট স্থিতিশীলতা (Qubit Stability):
মায়োরানা-১ “টপোলজিক্যাল কিউবিট” ব্যবহার করে, যা সাধারণ কিউবিটের তুলনায় বেশি স্থিতিশীল। এই কিউবিটগুলো “Majorana zero modes” নামক বিশেষ কণার মাধ্যমে তৈরি, যা তথ্যকে সুরক্ষিত রাখে এবং ভুলের সম্ভাবনা কমায়।
২. কোয়ান্টাম অসামাঞ্জশ্যতা (Quantum Decoherence):
টপোলজিক্যাল সুরক্ষা কিউবিটগুলোকে পরিবেশের প্রভাব থেকে রক্ষা করে, ফলে তাদের কোয়ান্টাম অবস্থা বেশিক্ষণ টিকে থাকে। এতে De-coherence-এর সমস্যা অনেকটা কমে যায়।
৩. ত্রুটি সংশোধন (Error Correction):
মায়োরানা-১ -এর অন্তর্নিহিত স্থিতিশীলতা ত্রুটি হওয়ার সম্ভাবনা কমায়, তাই ত্রুটি সংশোধন প্রক্রিয়া সহজ হয়। ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতির তুলনায় কম কিউবিট ব্যবহার করে ত্রুটি সংশোধন করা সম্ভব হয়।
৪. স্কেলিং (Scaling):
মাইক্রোসফট দাবি করে যে, এই প্রযুক্তির মাধ্যমে একটি চিপের মধ্যে অনেক বেশি কিউবিট স্থাপন করা সম্ভব। তারা মিলিয়ন কিউবিট পর্যন্ত স্কেল করার লক্ষ্য রেখেছে, যা কার্যকরী কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
৫. প্রযুক্তিগত জটিলতা (Technological Complexity):
টপোলজিক্যাল কিউবিট তৈরি এবং নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নতুন “টপোকন্ডাক্টর” নামক বিশেষ উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে। মাইক্রোসফট এই প্রযুক্তিকে আরও সহজলভ্য করার জন্য কাজ করছে, যদিও এটি এখনও একটি জটিল প্রক্রিয়া।
বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু সমস্যার সমাধান হতে পারে ভবিষ্যতে এই কোয়ান্টাম কম্পিউটারের হাত ধরে যেমন- প্রাকৃতিক দুর্যোগের অধিকতর সঠিক পূর্বাভাস, আরও কার্যকরী অর্থনৈতিক মডেল, ডাটা নিরাপত্তা, চিকিৎসা বিজ্ঞানকে আরও কার্যকরী করে তুলতে ব্যাপক সহযোগিতা করবে।

Image 1: Diagram of Topological Gap
ছবিতে টপোলজিকাল গ্যাপের ধারণা দেখানো হয়েছে, যা সুপারকন্ডাক্টর এবং সেমিকন্ডাক্টরের মধ্যে শক্তির একটি বিশেষ অবস্থা তৈরি করে। এই গ্যাপটি মায়োরানা শূন্য মোডের মাধ্যমে কোয়ান্টাম স্টেটের স্থিতিশীলতা বাড়ায়, যা মাইক্রোসফটের মায়োরানা-১ চিপের মতো প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত হয়।

Image 2: Diagram of Semiconductor Mimicking Superconductor
ইন্ডিয়াম আর্সেনাইড ( semiconductor) এবং অ্যালুমিনিয়াম (-২৭৩.১৫°C-তে superconductor) একসঙ্গে জুড়ে Topoconductor নামে একটি সংকর পদার্থ তৈরি করা হয়। চরম ঠান্ডা এবং চৌম্বক ক্ষেত্র প্রয়োগের মাধ্যমে এটি একটি Topological State তৈরি করে, যেখানে Nanowires-এর প্রান্তে Majorana Zero Modes (MZMs) পাওয়া যায়। এই MZMs মায়োরানা-১ চিপের Topological Qubits-কে স্থিতিশীল করে, Quantum তথ্যকে পারিপার্শ্বিক প্রভাব থেকে রক্ষা করে।

Image 3: Ettore Majorana (1906-1938)
ইটোরে মায়োরানা, যিনি মায়োরানা কণার তত্ত্ব প্রণয়ন করেন। তাঁর এই আবিষ্কার মাইক্রোসফটের মায়োরানা-১ চিপের মূল ভিত্তি।

Image 4: Quantum Computer Hardware
এই ছবিতে একটি কোয়ান্টাম কম্পিউটারের জটিল হার্ডওয়্যার দেখা যাচ্ছে, যেখানে কিউবিটগুলো সুপারপজিশনে কাজ করে। এই হার্ডও্যারের চিপ বাদে প্রায় পুরোটাই চিপটিকে অতি শীতল (-২৭৩.১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর কাছাকাছি) তাপমাত্র বজায় রাখতে ব্যবহৃত হয়।

Image 5: Majorana-1 Quantum Chip
Leave a comment