গল্পে গল্পে বিজ্ঞান

গল্পে বিশেষ জ্ঞান – অল্প আলো

Share
Share

সেদিন পড়ন্ত বিকেলে অনামিকা বিশাল সবুজ মাঠটার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে বসেছিল। তার উদাস দৃষ্টি বহুদূরে শূন্যে নিক্ষিপ্ত। হঠাৎ পিছন থেকে কেউ হাতের তালু দিয়ে তার বাঁ কাঁধে দুবার আলতো টোকা দিলো। অনামিকা সম্বিত ফিরে পেয়ে পিছনে কিছুটা উপরের দিকে মুখ তুলে দেখল দ্বিজেন দাঁড়িয়ে। অনামিকা মিষ্টি হেসে উত্তর দিল – “কিরে”। এরপর  দ্বিজেন সঙ্গে সঙ্গে অনামিকার পাশে বসে পড়ে অনামিকার দিকে তাকিয়েই জিজ্ঞাসা করল – “একা একা এরকম বসে আছিস”? অনামিকার হাসিমুখে এখন মিষ্টতার বদলে ঔদাসীন্য কিছুটা জায়গা করে নিয়েছে, সে তার দুই কাঁধ এক মুহূর্তের জন্য কিঞ্চিৎ উঠিয়ে বলল  – “এমনি”। দ্বিজেন বলল – “গতকাল কলেজ এলি না? জুলজির প্র্যাক্টিকাল ক্লাস ছিল তো ! তুই তো প্র্যাক্টিকাল ক্লাস মিস্ করিস্ না ! তাও আবার জুলজি ! বাই দা ওয়ে, কাল আশিষের বার্থডে পার্টিতে আসছিস তো”? অনামিকা বলল – “জানিসই তো দ্বিজেন; ওই লাউড্ মিউজিক, লেজার শো, নাচানাচি আমার খুব একটা পছন্দ নয়”। দ্বিজেন বেশ উত্তেজিত হয়ে বলল – “আরে এটাই তো এনজয়মেন্ট অফ লাইফ”!  এবার দ্বিজেন কিছুটা আশাহত হয়ে বলল – “তুই না একদম অন্য রকম অনামিকা। ছ মাসে ন মাসে একটা পার্টি অ্যাটেন্ড করিস। সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটেও একেবারেই অ্যাক্টিভ থাকিস না। কিছু মনে করিস না, তুই খুব একটা সাজিসও না। জীবনের সব উচ্ছ্বাস-উত্তেজনার দিকগুলো থেকে যেন তুই মুখ ফিরিয়ে থাকিস। কেন“? অনামিকার চোখে-মুখে এক শান্ত ও গভীর হাসি খেলতে লাগল। সে বলল – “অনেক প্রাণী এমন আছে যাদের চোখ রাতে বা অল্প আলোতে ভালোভাবে দেখার পক্ষে উপযুক্ত বলে দিনের উজ্জ্বল আলোয় তারা ভালো দেখতে পায় না”। দ্বিজেন অনামিকার এই কথার প্রাসঙ্গিকতা বুঝল না। সে বলল – “তো”? অনামিকা বলে চলল – “এদের চোখের আইরিস পেশীর কেন্দ্রে অবস্থিত পিউপিল ছিদ্রটা আকারে বেশ বড় হয় যাতে কর্নিয়া-র মধ্য দিয়ে আসা আলোর বেশীর ভাগটাই এই ছিদ্রের মধ্য দিয়ে চোখে প্রবেশ করতে পারে। জানিসই তো যে চোখের কর্নিয়া প্রকৃতপক্ষে আলোকরশ্মিগুলোকে পিউপিল-এ কেন্দ্র্র্রীভূত হতে সাহায্য করে। রাতে চারপাশে লভ্য অল্প সংখ্যক আলোকরশ্মির অধিকাংশটাই যাতে সংগ্রহ করা যায় ও পিউপিল-এ কেন্দ্র্র্রীভূত করা যায়, সেইজন্য এদের চোখের কর্নিয়ার আকারও বড় হতে পারে”। হঠাৎ দ্বিজেন চোখ বড় বড় করে তার মাথাটা অনামিকার দুচোখের দিকে এগিয়ে দিল। অনামিকা তৎক্ষণাৎ নিজের মাথা পিছিয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল – “কি হলো রে”? দ্বিজেন তার মুখমণ্ডলে এক কৌতুক মেশানো গাম্ভীর্য নিয়ে বলে উঠল – “আরে তোর চোখের কর্নিয়া দেখছি”। অনামিকা হো হো করে হেসে উঠে বলল – “তুই জানিস না যে কর্নিয়া স্বচ্ছ কলা দিয়ে তৈরি হয় ? ঐভাবে কখনও কর্নিয়া দেখা যায়“?

সত্যি কথা বলতে কি দ্বিজেন বোঝে, অনামিকা যে মানসিকতার মেয়ে, ওর এত কাছে বসতে গেলে বা ওর মিষ্টি কণ্ঠস্বর অনেকক্ষণ ধরে শোনার সুযোগ পেতে গেলে জীববিদ্যা-আলোচনা একমাত্র কার্যকর পথ। হাসির পর অনামিকা আবার দম নিয়ে বলল – “চোখের সাদা রঙের স্ক্লেরা, কালো রঙের বা বিভিন্ন মানুষের মধ্যে কারও কটা বা কারও নীল – বিভিন্ন রঙের যে আইরিস পেশী পাওয়া যায়, এবং আইরিসের কেন্দ্রে যে পিউপিল বা ‘চোখের তারা’ আছে; অক্ষিগোলকের এই তিনটে অংশকেই সাধারণত দেখা যায়”………’স্ক্লেরা’, ‘আইরিস’, ‘পিউপিল’ – শব্দগুলো উচ্চারণ করার সময় অনামিকার চপল, চওড়া, ও সুমসৃণ ঠোঁটদুটোকে দ্বিজেন মুগ্ধ হয়ে দেখেছে। অনামিকা বলে চলল –“পিউপিল-র ঠিক পিছনে থাকে লেন্স আর চোখের একদম পিছনের দিকে থাকে রেটিনা। ঠিক সিনেমা হলে যেমনটা দেখা যায়, এক্ষেত্রেও আলোকরশ্মি চোখের মধ্যে প্রবেশ করে লেন্সের মধ্য দিয়ে প্রতিসৃত হয়ে রেটিনার উপর গিয়ে পড়ে ও রেটিনায় প্রতিবিম্ব তৈরি করে। এই রেটিনা-কে আমরা সিনেমা হলের ফিল্ম স্ক্রীন-র সাথে তুলনা করতে পারি”। অনামিকা সরল মনে দ্বিজেনকে বুঝিয়ে চলেছিল কিন্তু দ্বিজেনের মন জুড়ে স্থান করে নিয়েছিল কেবল অনামিকার মায়া ময় দুই চোখ যাদেরকে এত কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়ে দ্বিজেন অন্য কিছু ভাবতে পারে নি। “বড় মাপের পিউপিল বা কর্নিয়া ছাড়াও অনেক নিশাচর প্রাণীর দেখার সুবিধার জন্য চোখের মধ্যে লেন্সটা রেটিনার খুব কাছাকাছি থাকে যাতে রেটিনার উপর তৈরি হওয়া প্রতিবিম্বটা অনেক বেশী উজ্জ্বল হয়” – এই বলে অনামিকা একটু থামল। দ্বিজেনের মন তখনও অনামিকার টানা টানা ঐ চোখের স্ক্লেরা-সমুদ্রে ডুবে আছে। অনামিকা বলা থামিয়ে দিয়েছে তা হঠাৎ ঠাওর করতে পেরে দ্বিজেনের বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল ! তার ভয় হলো যে অনামিকা বোধহয় তার মনে কি চলছে তা আঁচ করতে পেরেছে !

               মানুষের চোখের অর্ন্তগঠন

 

 

অনামিকার বলা শেষ কথাগুলো ভাগ্যিস দ্বিজেন আধো আধো শুনেছিল ! নিজকে স্বাভাবিক দেখাতে সে কিঞ্চিৎ তাড়াহুড়োয় বলে উঠল – “রাতের অল্প আলোতেও রেটিনায় উজ্জ্বল প্রতিবিম্ব তৈরি করার জন্য নিশাচর প্রাণীদের চোখে যে এত ধরনের ব্যবস্থাপনা থাকতে পারে তা তো বুঝলাম। কিন্তু সেই ব্যবস্থাপনা দিনের উজ্জ্বল আলোয় দেখতে কিরকম অসুবিধা তৈরি করতে পারে”?

অনামিকা উত্তর দিল – “সেটা বুঝতে গেলে আমাদের আগে বুঝতে হবে যে মস্তিষ্ক রেটিনায় তৈরি হওয়া প্রতিবিম্বটা কিভাবে প্রোসেস্ করে”। অনামিকার উত্তর শুনে দ্বিজেন যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল ! দ্বিজেন স্বগতোক্তি করল – “নাঃ, কিছুই টের পায়নি, নিতান্তই বিজ্ঞান পাগল মেয়ে, অনুভূতির ধাঁধাঁ অত বোঝে না”; একটা ছোট্ট ঢোক গিলে দ্বিজেন এও ভাবল – “কিন্তু এতক্ষণ জুলজি-র পর এখন আবার নিউরোলজি! তবে মস্তিষ্কের ‘ইমেজ প্রোসেসিং’ বোঝায় উৎসাহ না দেখালে অনামিকার কাছে আমার ইমেজ বলে কিচ্ছু থাকবে না”! দ্বিজেন ঠোঁটে একটা কৃত্রিম হাসি নিয়ে বলল – “বল্ বল্ শুনি”। অনামিকা বলল – “তোর ‘ইন্টারনিউরোন’ কি জানা আছে ? বা ‘নিউরাল লুপ’? ‘নিউরাল লুপ’ হলো কতগুলো নিউরোন বা স্নায়ুকোষের সমষ্টি যারা কোন একটা নির্দিষ্ট কাজ করার জন্য একটা সিরিস বা ক্রমে সংযুক্ত থেকে উদ্দীপনাকে স্নায়ুতন্ত্রের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বয়ে নিয়ে যায় আর নিউরাল লুপ-র মধ্যে থাকা এক একটা স্নায়ুকোষকে ‘ইন্টারনিউরোন’ বলে। মস্তিষ্কের সেরিব্রাল কর্টেক্স অংশটা কতগুলো খণ্ড বা লোবে বিভক্ত – ‘ফ্রন্টাল লোব’, ‘প্যারাইটাল লোব’, ‘অকিপিটাল লোব’, ও ‘টেম্পোরাল লোব’। এদের মধ্যে অকিপিটাল লোব-এ অবস্থিত ভিসুয়াল কর্টেক্স ওরকমই নিউরাল লুপ-র সাথে যুক্ত থাকে যা ‘দেখা’ কাজে সাহায্য করে। চোখের রেটিনা-র গায়ে ‘রড্ কোষ’ নামে অসংখ্য ফোটো সেন্সিটিভ বা আলোক সংবেদী কোষ থাকে। এই রড্ কোষগুলোতে আলোকরশ্মি এসে পড়লেই সেগুলো ঐ নিউরাল লুপে-র ইন্টারনিউরোন-এ দৃষ্টি সম্বন্ধীয় উদ্দীপনা বা ভিসুয়াল স্টিমিউলাস পাঠায় এবং রেটিনায় ঐ আলোকরশ্মি যে প্রতিবিম্ব তৈরি করেছে, ভিসুয়াল কর্টেক্স তাকে প্রোসেস্ করে। এইবার তোর প্রশ্নের উত্তরটা বুঝতে সুবিধা হবে। সাধারণত নিশাচর প্রাণীদের রেটিনায় রড্ কোষের সংখ্যা আমাদের থেকে অনেক বেশী হয় এবং একটা ইন্টারনিউরোন একাধিক রড্ কোষ থেকে ভিসুয়াল স্টিমিউলাস গ্রহণ করে যাতে ঐ ইন্টারনিউরোনে একাধিক স্টিমিউলাস মিলিত হয়ে জোরালো একটা ভিসুয়াল স্টিমিউলাস পাওয়া যায় ও ফলস্বরূপ অল্প আলোতেও তারা পরিষ্কার দেখতে পায়। কিন্তু দিনের উজ্জ্বল সূর্যের আলোয় তাদের রেটিনায় উপস্থিত এত বেশী সংখ্যক রড্ কোষের অধিকাংশই সক্রিয় হয়ে ওঠে বা অন্যভাবে বলা যায়, তাদের রেটিনায় তৈরি হওয়া কোন বস্তুর প্রতিবিম্বটি অত্যধিক উজ্জ্বল হয়। ফলস্বরূপ, প্রত্যেকটা ইন্টারনিউরোন প্রয়োজনের থেকেও অনেক বেশী সংখ্যক রড্ কোষ থেকে ভিসুয়াল স্টিমিউলাস গ্রহণ করতে শুরু করে, যার পরিণাম একটাই – রেসোলিউশন্ কমে গিয়ে তাদের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়”।

                   মনুষ্য-মস্তিষ্কের ভিসুয়াল কর্টেক্স

 

দ্বিজেন ঠোঁটে হাসিটুকু রেখেই এবার একবার গলা ঝেড়ে অনামিকাকে বলল – “অনামিকা, বেশ অনেক্ষণ আগে তোকে একটা প্রশ্ন করেছিলাম – জীবনের উচ্ছ্বাস-উত্তেজনার দিকগুলো থেকে কেন তুই মুখ ফিরিয়ে থাকিস। তার উত্তর কিন্তু এখনও পেলাম না”। তখন সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। অনামিকার চোখের হালকা কাজল যেন একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়েছে চারিপাশে। হঠাৎ একটা দম্কা হাওয়ায় অনামিকার খোলা চুল এলোমেলো হয়ে গেল। আচমকা দ্বিজেনকে ছুঁয়ে গেল অনামিকার চঞ্চল কেশরাজির সম্মোহনী সুবাস। ডান হাতের আঙুলে এক গোছা চুল ডান কানের পিছনে রাখতে রাখতে অনামিকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল – “কারও কারও চোখ সহজেই আলো শোষণ করতে পারে বলে ঔজ্জ্বল্যে তাদের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। কারও কারও মন সহজেই আনন্দ খুঁজে নিতে পারে বলে উচ্ছ্বাস তাদের অনুভূতিকে তিক্ত করে দেয়”।

 

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কে আরো নতুন নতুন সংবাদ জানতে সাবস্ক্রাইব করুন।

[mc4wp_form id=”3448″]

Share
Written by
Diganta Paul -

জন্ম: ১৯৮৯ সালে ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হাওড়া জেলায়। শিক্ষা: প্রাথমিক, মাধ্যমিক, ও উচ্চ-মাধ্যমিক শিক্ষা হাওড়া জিলা স্কুলে। এরপর কলকাতার "সেইন্ট থমাস্ কলেজ অফ এঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনলজি" কলেজ থেকে বৈদ্যুতিক কারিগরিবিদ্যা নিয়ে প্রযুক্তিতে স্নাতক (B.Tech. in Electrical Engineering)। পেশা: তথ্যপ্রযুক্তি পেশাদার (IT Professional)। নেশা: বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা নিয়ে পড়াশোনা ও চিন্তাভাবনা। এছাড়াও বিভিন্ন পত্রিকায় বিজ্ঞান প্রবন্ধ, বিজ্ঞান নিবন্ধ, কল্পবিজ্ঞান ভিত্তিক গল্প, কল্পবিজ্ঞান কবিতা, গাণিতিক কল্পকাহিনী, বিজ্ঞান নাটক, ও বিজ্ঞান কবিতা লেখা। উল্লেখযোগ্য পুরস্কার: বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ কর্তৃক প্রদত্ত অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি রৌপ্য পদক। প্রকাশিত বই: উদ্দীপনার খেলাঘর। যোগাযোগ: [email protected]

4 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
গল্পে গল্পে বিজ্ঞান

গল্পে বিশেষ জ্ঞান

বিজ্ঞানের আতস কাঁচে "প্রেম" পর্যবেক্ষণ।

Three Columns Layout

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact

biggani.org❤️gmail.com

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

যোগাযোগ:

biggani.org@জিমেইল.com

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.