গল্পে গল্পে বিজ্ঞান

গল্পে বিশেষ জ্ঞান

Share
Share

“গল্পে বিশেষ জ্ঞান” বিভাগে প্রথম গল্পটা লেখার বহুদিন পর দ্বিতীয় গল্পটা লিখছি। যদি প্রথম গল্পটা পড়ে থাকো তবে বুঝবে যে এই দুটো গল্পের স্বাদে সাদৃশ্য থাকলেত্ত এই দ্বিতীয় গল্পের চরিত্র কেবল তুমি আর আমি। আর গল্প করার বিষয়, সকলের ভীষণ পছন্দের কারণ তার স্পর্শেই জীবন ছন্দময়। ক্ষিদে পাওয়া বা ঘুম পাওয়ার মতই তা ভীষণ সহজ ও স্বাভাবিক এক বিষয় কিন্তু বহুক্ষেত্রে মানুষই তাকে জটিল করে তোলে। আর রহস্য রাখব না। আজ গল্প করার বিষয় –

 

                                                                 প্রেম

 

প্রত্যেক মানুষই প্রেমে পড়ে। আশা করি তুমি এর ব্যতিক্রম নও। আমিও নই। “লায়লা ও মজনুন” বা “রোমিও ও জুলিয়েট” আমরা অনেকেই পড়েছি বা শুনেছি। তবে প্রেম মানেই যে দুই মানুষের রসায়ন, সেটা কিন্তু ভাবা ঠিক নয়। ছোট্টবেলা থেকে প্রতিনিয়ত দেখে আসা মা-বাবার অমিল আর ঝগড়া বিষিয়ে দিয়েছিল একটি ছেলের শৈশব, ধ্বংস হয়ে যেত তার কৈশোর যদি না তার জীবনে আসত সংগীত। গিটারে সুর তুলে সে ভুলে থাকত বাস্তবের রূঢ়তা। সেই ছেলেটি আর সংগীতের সম্পর্ক প্রেম নয়ত কি ? আমি যে প্রেমিকের কথা বলছি তিনি “সামার অফ্ সিক্সটিনাইন” গানের স্রষ্টা ব্রায়ান অ্যাডাম্স। শোনা যায় যে বিশ্ব-বিখ্যাত পদার্থবিদ্ রিচার্ড ফেইনম্যানের দ্বিতীয় বিবাহিতা স্ত্রী বিবাহ-বিচ্ছেদ চাওয়ায় তাঁকে যখন বিবাহ-বিচ্ছেদ চাওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তিনি বলেছিলেন, রিচার্ড ফেইনম্যান সকালে ঘুম থেকে উঠলেই তাঁর মস্তিষ্কে ক্যালকুলাস মাথা চাড়া দিয়ে উঠত। এখন ভেবেই দেখো, একজন ব্যক্তি গণিতের প্রতি কতখানি আসক্ত হলে তাঁর স্ত্রী গণিতকে তাঁর সতীন ভাবতে শুরু করেন!

এখন তোমায় একটা প্রশ্ন করি। প্রেমকে কখনও বিজ্ঞানের আতস কাঁচে দেখেছ ? আমি দেখার চেষ্টা করে যতটুকু বুঝেছি তার মর্মার্থ হলো এই যে; প্রেম যদি এক মজাদার চলচ্চিত্র হয়, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তাকে দেখা মানে সেই চলচ্চিত্রের শ্যুটিং দেখা – মজার সিকি ভাগই অবশিষ্ট থাকে ! তবে অবশ্য বিজ্ঞানে অনুরাগ থাকলে অনুসন্ধিৎসু হতে ভালোই লাগে।

কথায় বলে যে মানুষ তার জীবনের প্রথম প্রেম নাকি কোনোদিন ভুলতে পারে না। তোমার প্রথম প্রেম যদি ইতিমধ্যে তোমার জীবনে এসে থাকে, তাকে একবার স্মরণ করো। খুব স্বাভাবিকভাবেই দেখবে যে তোমার অনুভূতিতে লেগে গেলো কিছু ভালো লাগা। এখন যদি নিজেকে প্রশ্ন করো যে কেন এই ভালো লাগা, বুঝবে যে তোমার “প্রেম”-কে বৈজ্ঞানিক উপায়ে বোঝার যাত্রা হলো শুরু !

বাতাসে ভেসে আসা সুবাস আমাদের অনুভূতিকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। কিন্তু আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস? বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া বা শ্বাস-বায়ুর অভাব না ঘটলে, আমাদের সচেতন অনুভূতিতে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের কোন স্থানই নেই। আমরা যাকে অনুভূতি বলি তা হলো মস্তিষ্কের কতগুলো স্নায়ুকোষের একটা ক্রমে বা ছন্দে উদ্দীপিত হয়ে ওঠা। একটি  স্নায়ুকোষ থেকে আরেকটি স্নায়ুকোষে উদ্দীপনা প্রবাহিত হয় “নিউরোট্রান্সমিটার” নামক রাসায়নিক পদার্থসমূহের মাধ্যমে। একটি স্নায়ুকোষ উদ্দীপিত হয়ে নিউরোট্রান্সমিটার ক্ষরণ করে ও আরেকটি স্নায়ুকোষ সেই নিউরোট্রান্সমিটার গ্রহণ করে উদ্দীপিত হয়। আমাদের প্রায় সকল অনুভূতিতেই যে নিউরোট্রান্সমিটারটি পাওয়া যায় তা হলো “সেরাটোনিন”। শ্বাসবায়ুর অভাব ঘটলে সেরাটোনিন নিউরোট্রান্সমিটার-র ক্ষরণ কমে যায়, ফলে আমাদের অনুভূতিতে মিশতে থাকে “সারভাইভাল ক্রাইসিস্”। আবার সুগন্ধে আমাদের মন ভালো হয়ে যাওয়ার কারণ হলো “এন্ডরফিন্স” ও “ডোপামিন” নিউরোট্রান্সমিটার-র ক্ষরণ। বলাই বাহুল্য, সুগন্ধ বা সুবাস হলো আমাদের পছন্দ কিন্তু শ্বাস হলো আমাদের প্রয়োজন। আমাদের মস্তিষ্ক “যৌক্তিকতা”-র উপর ভিত্তি করেই ধারণা করে কি আমাদের প্রয়োজন আর কি আমাদের শুধুই পছন্দ। এখন “যৌক্তিকতা” আসলে কি তা আমাদের বুঝতে হবে।

“যৌক্তিকতা” সরাসরি “ব্যক্ত দীর্ঘ মেয়াদী স্মৃতি” বা “ডিক্ল্যারেটিভ লং টার্ম মেমোরি”-র সাথে সম্পর্কযুক্ত। তুমি তিন-চার বছর বা তারও আগে যে সিনেমাটা দেখেছো তার বিষয়বস্তু অথবা কোথাও বেড়াতে গিয়ে তুমি কি কি করেছো বা কি কি দেখেছো তা স্মরণ করে গরগর করে বলে দিতে পারো “ব্যক্ত দীর্ঘ মেয়াদী স্মৃতি”-র বদান্যতায়। মস্তিষ্ক যে তথ্যগুলোকে এই ব্যক্ত দীর্ঘ মেয়াদী স্মৃতি হিসাবে সঞ্চিত রাখবে বলে ঠিক করে; মস্তিষ্কের টেম্পোরাল লোব-র মধ্যভাগে অবস্থিত হিপ্পোক্যাম্পাস, এন্টোরাইনাল কর্টেক্স, ও পেরিরাইনাল কর্টেক্স অংশ তিনটি সেই তথ্যগুলিকে এনকোড্ (সংকেতাক্ষরে লেখা) করে কিন্তু তথ্যগুলির কনসলিডেশন্ (একত্রীকরণ) ও তারপর তারা সঞ্চিত হয় (স্টোরিং)  সাধারণত টেম্পোরাল কর্টেক্সে। অর্থাৎ অন্যভাবে বলা যায়, মস্তিষ্কে টেম্পোরাল কর্টেক্স অংশটি “ডিক্ল্যারেটিভ লং টার্ম ইনফরমেশন্ বেস্” হিসাবে কাজ করে।

মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাস, এন্টোরাইনাল কর্টেক্স, ও পেরিরাইনাল কর্টেক্স

 

আমাদের ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে পরিপার্শ্ব থেকে তথ্যসমূহ প্রথমে মস্তিষ্কের “শর্ট টার্ম মেমোরি” বা “স্বল্প মেয়াদী স্মৃতি”-তে সংগৃহীত হয়। তারপর তথ্যগুলো এনকোডেড্ (সংকেতাক্ষরে লিখিত)  হয়ে মস্তিষ্কের সেরিব্রাল কর্টেক্স এর ফ্রন্টাল লোব এর সামনের দিকে অবস্থিত “প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স”-এ আসে। “প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স” এর কেন্দ্রীয় নির্বাহী অংশটি (সেন্ট্রাল এক্সিকিউটিভ পার্ট) ঐ এনকোডেড্ তথ্যসমূহকে সার্চ ক্রাইটেরিয়া হিসাবে ব্যবহার করে “ডিক্ল্যারেটিভ লং টার্ম ইনফরমেশন্ বেস্” থেকে  বহু এনকোডেড্ তথ্য উদ্ধার (রিট্রিভ) করে তাকে ডিকোড্ (পাঠোদ্ধার করা) করে – একেই মস্তিষ্কের “কার্য-কারণ (ক্যসালিটি)  ভিত্তিতে স্মরণ করা” বলা হয়ে থাকে। আর উদ্ধার করা এনকোডেড্ তথ্যগুলিকে ডিকোড্ করার পর তাদেরকে কাজে লাগানোর জন্য যদি পুনরায় এনক্রিপ্ট করা হয়, তারই নাম “কার্য-কারণ ভিত্তিতে নতুন কিছু ভাবা বা চিন্তা করা”।

মস্তিষ্কের টেম্পোরাল লোব ও  ফ্রন্টাল লোব

 

কার্য-কারণ ভিত্তিতে মস্তিষ্কের কিছু স্মরণ করা এবং নতুন কিছু ভাবা – দুই ভিন্ন প্রকার চিন্তা প্রক্রিয়া বটে। এই প্রক্রিয়াগুলিকে সম্পাদন করার ক্ষমতাই হলো “যৌক্তিকতা”। এই “যৌক্তিকতা”-র ভিৎ হলো “ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ভাব” বা “সেন্স অফ ইন্ডিভিজুয়ালিটি” যা নিহিত থাকে মূলত মস্তিষ্কের “প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স” এর কেন্দ্রীয় নির্বাহী অংশটির পূর্ব-বর্ণিত কার্যকারিতায়।

              মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স

আমরা এই ব্রহ্মাণ্ডে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ সবসময়ই বিচ্ছিন্ন অস্তিত্বের মধ্যে পর্যবেক্ষণ করি। তুমি কোন কিছু পছন্দ কর, অথবা তুমি কোন ব্যক্তি বা বিষয় বা বস্তুর প্রতি আসক্ত বা আকৃষ্ট হওয়ার কারণই হলো তোমার মস্তিষ্কের “প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স” এর কেন্দ্রীয় নির্বাহী অংশটি ঐ ব্যক্তি বা বিষয় বা বস্তুর থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে করে। তোমার মস্তিষ্কের “প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স” এর কেন্দ্রীয় নির্বাহী অংশটি যাকে প্রয়োজন বা নিজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে মনে করে, তার ব্যাপারে তোমার আসক্তি বা বিরক্তি কোনটাই থাকে না। কখনও কখনও এমনও হয় যে; পছন্দের বিষয় বা ব্যক্তি বা বস্তুর প্রভাবে আমাদের মস্তিষ্কে এতটাই অতিরিক্ত পরিমাণে “এন্ডর্ফিন্স”, “ডোপামিন”, “সেরাটোনিন”, ও “অক্সিটোসিন” নিউরোট্রান্সমিটার ক্ষরিত হতে শুরু করে যা “প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স” এর কেন্দ্রীয় নির্বাহী অংশটির কার্যকারিতায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ! ফলে আমাদের মস্তিষ্কে যৌক্তিকতার অভাব ঘটে। এক্ষেত্রে আমাদের “প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স” এর কেন্দ্রীয় নির্বাহী অংশটি ঐ বিষয় বা ব্যক্তি বা বস্তুটিকে পছন্দের তালিকাতেই রাখবে না তাকে প্রয়োজনের তালিকায় স্থান দেবে তা ঠিক করে উঠতে পারে না। এই দোটানার নামই “প্রেম” !

Share
Written by
Diganta Paul -

জন্ম: ১৯৮৯ সালে ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হাওড়া জেলায়। শিক্ষা: প্রাথমিক, মাধ্যমিক, ও উচ্চ-মাধ্যমিক শিক্ষা হাওড়া জিলা স্কুলে। এরপর কলকাতার "সেইন্ট থমাস্ কলেজ অফ এঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনলজি" কলেজ থেকে বৈদ্যুতিক কারিগরিবিদ্যা নিয়ে প্রযুক্তিতে স্নাতক (B.Tech. in Electrical Engineering)। পেশা: তথ্যপ্রযুক্তি পেশাদার (IT Professional)। নেশা: বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা নিয়ে পড়াশোনা ও চিন্তাভাবনা। এছাড়াও বিভিন্ন পত্রিকায় বিজ্ঞান প্রবন্ধ, বিজ্ঞান নিবন্ধ, কল্পবিজ্ঞান ভিত্তিক গল্প, কল্পবিজ্ঞান কবিতা, গাণিতিক কল্পকাহিনী, বিজ্ঞান নাটক, ও বিজ্ঞান কবিতা লেখা। উল্লেখযোগ্য পুরস্কার: বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ কর্তৃক প্রদত্ত অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি রৌপ্য পদক। প্রকাশিত বই: উদ্দীপনার খেলাঘর। যোগাযোগ: [email protected]

4 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
গল্পে গল্পে বিজ্ঞান

গল্পে বিশেষ জ্ঞান – অল্প আলো

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কে আরো নতুন নতুন সংবাদ জানতে সাবস্ক্রাইব করুন। [mc4wp_form...

Three Columns Layout

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact

biggani.org❤️gmail.com

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

যোগাযোগ:

biggani.org@জিমেইল.com

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.