নিউজ ডেস্ক, বিজ্ঞানী অর্গ
[email protected]
রাত তখন গভীর। শহরের কোলাহল থেমে গেছে। সব আলো নিভে গেলেও দুটি চোখ জেগে আছে—একটি চোখ হিসাবের খাতায় ডুবে থাকা একজন ব্যবসায়ীর, অন্যটি স্বপ্নের খাঁচা খুলে নতুন দিগন্তের খোঁজে থাকা একজন উদ্যোক্তার।
এই দুই চরিত্রের গল্পটি হয়তো শুরু হয়েছে একইভাবে—একটি ছোট দোকান, কিছু পুঁজি, আর জীবনে কিছু একটা করে দেখানোর জেদ নিয়ে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের যাত্রার গন্তব্য আলাদা হয়ে যায়। একজন ব্যবসা চালিয়ে যেতে শেখে, আর অন্যজন স্বপ্ন বুনতে শেখে।
ব্যবসায়ী হোসেন সাহেবের দিন শুরু হয় খুব ভোরে। দোকান খোলার আগে তিনি প্রতিদিন পণ্যের তালিকা মিলিয়ে দেখেন, আগের দিনের বিক্রি কেমন হয়েছে, কোন আইটেমের চাহিদা বেড়েছে, কোনটা কমেছে। বছর বছর তাঁর দোকানটা বড় হয়, আয় বাড়ে, পরিচিতি বাড়ে। কিন্তু তাঁর জীবনে খুব বেশি নতুন কিছু নেই। তিনি জানেন কোন জিনিস বিক্রি হবে, কোন দাম গ্রাহক নেবে, কোথায় বিজ্ঞাপন দিলে লাভ হবে। তাঁর জীবনটি যেন একটি সুপরিচালিত ট্রেন, যার গন্তব্য নির্ধারিত এবং পথটাও পরিচিত।
অন্যদিকে আছে রিজওয়ান। সে চাকরি ছেড়ে দিয়ে একটা অ্যাপ বানাতে চায়, যেখানে মানুষ গ্রামের কৃষিপণ্য শহরে অর্ডার দিতে পারবে। চারদিকে লোকজন হাসাহাসি করে—”এইসব করে কি চলে?” রিজওয়ানের প্রথম অ্যাপ ঠিকঠাক চলে না, সে আবার কোড শেখে, বন্ধুদের নিয়ে নতুন দল গঠন করে, আরেকবার চেষ্টা করে। কেউ তাকে বলে পাগল, কেউ বলে সাহসী। কিন্তু রিজওয়ান জানে, সে কিছু একটা নতুন করতে চায়। তার মনে হয়, যদি এই কাজটা সফল হয়, তাহলে শুধু তার নিজের নয়, গ্রামের অসংখ্য কৃষকের জীবন বদলে যাবে।
হোসেন সাহেব ঝুঁকি নিতে চান না। তিনি যা জানেন, তাতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তিনি ব্যবসায় লাভ খুঁজেন, নিরাপত্তা খোঁজেন, আর চেনা জগতে সাফল্য চান। তিনি নিজের প্রতিষ্ঠানের জন্য ধারাবাহিকতা এবং স্থিতিশীলতাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন।
রিজওয়ান ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত। তার জন্য লাভের থেকেও বড় বিষয় হলো, তার চিন্তাটা বাস্তব হয়েছে কিনা। সে জানে, প্রতিটা নতুন চিন্তার পেছনে থাকে ব্যর্থতার সম্ভাবনা। কিন্তু ব্যর্থতা তাকে থামায় না, বরং শিখিয়ে দেয় কীভাবে সামনে এগোতে হয়।
দুইজনেই কঠোর পরিশ্রম করে, দুইজনেই অর্থনৈতিক অবদান রাখে। কিন্তু তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। হোসেন সাহেব চাইছেন তার ব্যবসার ধারাবাহিক উন্নতি, নির্ভরযোগ্য কর্মী, নিয়মিত গ্রাহক। রিজওয়ান চাইছে একটি নতুন জগতের দরজা খুলতে, যেখানে আগে কেউ যায়নি।
এই দুই পথই মূল্যবান। একজন সমাজে স্থায়িত্ব আনেন, অন্যজন আনেন পরিবর্তন। একজন আমাদের বলে কিভাবে টিকে থাকতে হয়, অন্যজন শেখান কীভাবে স্বপ্ন দেখতে হয়।
অনেক সময় আমরা ভাবি, ব্যবসায়ী আর উদ্যোক্তা তো এক জিনিস। কিন্তু আসলে তারা দুই ভিন্ন মানসিকতার মানুষ। একজন হিসাবের ক্যালকুলেটর হাতে নিয়ে দিন শুরু করেন, আর অন্যজন স্বপ্নের স্কেচ হাতে নিয়ে রাত পার করেন।
এই দুই চরিত্রের মধ্যে যেটি আপনি হবেন, সেটি আপনার নিজের বিশ্বাস, স্বপ্ন, আর ঝুঁকি নেবার মানসিকতার ওপর নির্ভর করে। আপনি হয়তো হোসেন সাহেবের মতো স্থিতিশীলতা খুঁজবেন, অথবা রিজওয়ানের মতো উন্মোচন করতে চাইবেন অজানা সম্ভাবনার দরজা।
কিন্তু যেকোনো পথই যদি সততা, নিষ্ঠা ও উদ্দেশ্যপ্রবণতা দিয়ে চলে, তাহলে সেটি শেষমেশ সমাজকে কিছু না কিছু দিয়ে যায়। আর তাতেই তো জীবনের সার্থকতা।
নিচের ছকটিতে আমরা সংক্ষেপে দেখছি ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তার পার্থক্য:
বৈশিষ্ট্য | ব্যবসায়ী | উদ্যোক্তা |
---|---|---|
উদ্দেশ্য | স্থিতিশীল আয় ও ব্যবসা পরিচালনা | নতুন কিছু তৈরি করা ও সমস্যা সমাধান করা |
ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতা | কম ঝুঁকিপূর্ণ পথে হাঁটা | ঝুঁকি নিয়ে নতুন কিছু চেষ্টা করা |
উদ্ভাবন | প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতির মধ্যে সীমিত উদ্ভাবন | সমস্যা সমাধানে সৃজনশীল চিন্তা |
কৌশল | বিদ্যমান কৌশল বাস্তবায়ন | নিজস্ব কৌশল গঠন ও বাস্তবায়ন |
প্রেরণা | আর্থিক সাফল্য ও নিরাপত্তা | আইডিয়ার প্রতি ভালোবাসা ও সমাজে প্রভাব রাখার চেষ্টা |
বৃদ্ধি | ধীর ও ধারাবাহিক উন্নতি | দ্রুত ও স্কেলযোগ্য বৃদ্ধি |
বিজ্ঞানী.অর্গ সব ধরনের চিন্তাকে স্বাগত জানায়—ব্যবসায় হোক বা উদ্যোগে, সৃষ্টিশীলতা থাকলেই আমরা তাকে শ্রদ্ধা করি।
Leave a comment