বাল্টিক সাগরের গভীর তলদেশ থেকে উঠে এল এক প্রাচীন জীবনের নতুন গল্প
সকালটা ছিল কুয়াশাচ্ছন্ন। জার্মানির লেইবনিজ ইনস্টিটিউটের গবেষণাগারে সেইদিন সবার চোখে-মুখে ছিল চাঞ্চল্য। গবেষক লুকাস হানস মুখে এক চিলতে হাসি নিয়ে সহকর্মীকে বলছিলেন, “এটা শুধু আবিষ্কার নয়, সময়ের ওপারে পৌঁছে যাওয়া। ভাবতে পারো? সাত হাজার বছর ঘুমিয়ে থাকা কোষগুলো আজ আবার নিঃশ্বাস নিচ্ছে আমাদের সামনে।” টেস্ট টিউবের ভিতরে ক্ষীণ সবুজ আলো—সেখানে যেন আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে কিছু! সাত হাজার বছরের ঘুম পেরিয়ে, প্রাণ ফিরে পেল একদল শৈবাল—সাগরের তলদেশে গভীর ঘুমে থাকা এক জীবাশ্মপ্রায় জীবনের নবজাগরণ।
এই ঘটনা শুধু গবেষণাগারে সীমাবদ্ধ নয়, বিশ্ববিজ্ঞান জগতে এক আলোড়ন তুলেছে। একে বলা হচ্ছে “Resurrection Ecology” বা ‘পুনর্জীবিত বাস্তুতন্ত্র বিজ্ঞানের’ বাস্তব উদাহরণ।
বাল্টিক সাগরের নিচে, ঘুমিয়ে থাকা প্রাণ
বাল্টিক সাগরের “Eastern Gotland Deep” অঞ্চলে, প্রায় ৮০০ ফুট গভীরে, যেখানে আলো পৌঁছায় না, সেখানে অক্সিজেনহীন (anoxic) স্তরে পড়ে ছিল এই শৈবাল কোষগুলি। হাজার হাজার বছর ধরে সাগরের তলদেশে জমা হওয়া গাদাগাদি সেডিমেন্টের নিচে তারা চাপা পড়ে ছিল—একদম কোনো আলো বা বাতাস ছাড়াই।
গবেষক সারাহ বোলিয়াস (Sarah Bolius), যিনি এই গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন, বলেন—
“সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, এই প্রাচীন শৈবালরা কেবল বেঁচে উঠেই থেমে থাকেনি, তারা আজকের আধুনিক প্রজাতির মতোই শক্তিশালীভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিভাজিত হচ্ছে এবং অক্সিজেন তৈরি করছে।”
এই সাফল্যের কথা জানিয়ে The ISME Journal-এ গবেষণাটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে।
সময়পাত্রের ভেতরে বন্ধ জীবন
গবেষক দল মোট ৯টি নমুনা থেকে শৈবাল পুনর্জীবিত করতে সক্ষম হন। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরনোটি কার্বন ডেটিং পদ্ধতিতে নির্ধারিত হয় ৬৮৭১ বছর, যার ভুলত্রুটি মাত্র ±১৪০ বছর।
এই নমুনাগুলি কেবল জীবের জীবন নয়, বরং প্রাচীন পরিবেশের কথাও বলে দেয়। সেই সময়ের সাগরের লবণাক্ততা, তাপমাত্রা, এমনকি অক্সিজেনের স্তর সম্পর্কে জানার এক অমূল্য উৎস হয়ে উঠেছে এই শৈবাল।
বোলিয়াস বলেন,
“এই ধরনের সেডিমেন্ট যেন একটি টাইম ক্যাপসুল—যেমন পুরোনো দিনের মানুষ কোনও গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ভবিষ্যতের জন্য রেখে দিতেন একটি বাক্সে। তেমনি এই সেডিমেন্টের স্তরগুলো ধরে রেখেছে হাজার বছর আগের পরিবেশের চিহ্ন। এর ভেতরে আমরা পাই অতীতের বাস্তুতন্ত্রের ছাপ, জীববৈচিত্র্য ও জেনেটিক পরিবর্তনের উপাখ্যান।”
একটি নতুন শাস্ত্রের জন্ম: রেজারেকশন ইকোলজি
এই ঘটনাকে বিজ্ঞানীরা “Resurrection Ecology” নামে চিহ্নিত করেছেন। এর মূল ধারণা হলো—প্রাচীন জীব বা অণুজীবদের পুনরুজ্জীবিত করে বর্তমান ল্যাব-পরিস্থিতিতে গবেষণা চালানো, যেন সময়ে পিছিয়ে গিয়ে একটি জীবন্ত অধ্যায় দেখা যায়।
এটি ভবিষ্যতের গবেষণায় দারুণ সুযোগ এনে দিচ্ছে। যেমন, শৈবাল পুনর্জীবনের মাধ্যমে বোঝা যাবে, পরিবেশগত পরিবর্তনের ফলে আজকের জীববৈচিত্র্যে কী প্রভাব পড়েছে। এমনকি, জলবায়ু পরিবর্তন বা দূষণের মতো আধুনিক সমস্যা বুঝতে অতীতের জীবদের ফিরিয়ে আনা হতে পারে এক অসাধারণ হাতিয়ার।
বিশ্বজুড়ে প্রতিক্রিয়া
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অনুরাগীরা এই আবিষ্কারে অভিভূত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. তানভীর আহমেদ বলেন—
“এটা শুধু বিজ্ঞান নয়, ইতিহাসের জীবন্ত দলিল। আগামী দিনে জলবায়ু পরিবর্তন বুঝতে এ গবেষণা পথ দেখাবে।”
অন্যদিকে এক পাঠক, ময়মনসিংহের কলেজ শিক্ষার্থী শারমিন জানায়—
“ভেবেছিলাম পুরনো জীব মানেই জীবাশ্ম, কিন্তু এখন বুঝলাম, ঘুমিয়েও হাজার বছর পরে জেগে ওঠা সম্ভব!”
শেষ কথা: প্রকৃতির বিস্ময় এখনও শেষ হয়নি
একটা সময় ছিল, যখন মানুষ ভাবতো মৃত্যুই চূড়ান্ত। কিন্তু এখন আমরা জানি, প্রকৃতি তার কোলে লুকিয়ে রেখেছে হাজার বছরের ঘুমন্ত জীবন, যেগুলো একদিন জেগে উঠে আমাদের নতুন কিছু শেখাতে পারে।
আর সেই শিক্ষা—মানব সভ্যতাকে শুধু এগিয়ে নিয়ে যাবে না, বরং আমাদের চিন্তার পরিধিকেও প্রসারিত করবে।
“হ্যালো লাজারাস”—এই ডাক এখন কেবল ধর্মীয় বা সাহিত্যিক কল্পনার গল্প নয়, এটি বাস্তব বিজ্ঞানের অলৌকিকতা!
Leave a comment