মাঝরাতে টেবিলের ওপর রাখা স্মার্টফোনে হঠাৎ একটি নোটিফিকেশন বেজে উঠলো। হাত বাড়িয়ে ফোনটি হাতে নিলেন রাশেদ। স্ক্রিনে লেখা—”আপনার পছন্দের নতুন সিনেমাটি এখন নেটফ্লিক্সে দেখা যাচ্ছে!” চমকে উঠলেন রাশেদ, মনে হলো ফোনটি যেন তার পছন্দ, আগ্রহ সব কিছু বোঝে। কিছুক্ষণ ভাবতেই মনে হলো, “এটা কি সত্যিই আমাকে চিনতে পারছে?”
আসলেই কি আপনার ফোন বা কম্পিউটার আপনাকে চিনতে পারে, নাকি এর পেছনে কাজ করছে অন্য কোনো রহস্য?
এই প্রশ্নের উত্তরে চলে যেতে হবে ইতিহাসে, যখন বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছিলেন গণিতের আশ্চর্য ক্ষমতা। একসময় বৃটিশ পদার্থবিদ আইজ্যাক নিউটন একটি আপেলের মাটিতে পড়া দেখে গণিতের সাহায্যে ব্যাখ্যা করেছিলেন অভিকর্ষজ তত্ত্ব। গণিতের মাধ্যমেই জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল আমাদের দিয়েছিলেন তড়িৎচুম্বকত্বের বিস্ময়কর সূত্র। আর বিখ্যাত বিজ্ঞানী পল ডিরাক, কেবল গণিতের সমীকরণ দিয়েই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন অ্যান্টিম্যাটারের অস্তিত্বের। এ যেন গণিতের জাদু!
ঠিক একইভাবে, বর্তমানের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) আসলে কোনো জাদুর বস্তু নয়। এটি সম্পূর্ণভাবে গণিতের উপর ভিত্তি করে তৈরি হওয়া একটি মডেল।
বিশ্বখ্যাত কম্পিউটার বিজ্ঞানী ও ডিপ লার্নিং বিশেষজ্ঞ ইয়ান লেকুন (Yann LeCun) বলেন, “মানুষ মনে করে AI মানে হয়তো কম্পিউটারের ভেতরে বসবাসকারী কোনো মানুষ। বাস্তবে এটি শুধুই ডেটা থেকে প্যাটার্ন শিখতে সক্ষম একটি জটিল গণিতিক ব্যবস্থা।”
আধুনিক যুগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার ডিপ লার্নিং। এটি নিউরাল নেটওয়ার্ক নামের এক ধরনের বিশেষ গণিতিক কাঠামো ব্যবহার করে কাজ করে। ডিপ লার্নিংয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন জিওফ্রে হিনটন (Geoffrey Hinton), ইয়ান লেকুন (Yann LeCun) এবং ইয়োশুয়া বেনজিও (Yoshua Bengio)। তাদের তৈরি এই পদ্ধতিতে কম্পিউটার লক্ষ লক্ষ ডেটা থেকে শিখতে পারে, এমনকি মানুষের মতো নির্ভুলভাবে চেহারা চিনতে বা রোগ নির্ণয় করতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, ডিপ লার্নিংয়ে মূল ভূমিকা পালন করছে লিনিয়ার অ্যালজেব্রা, ক্যালকুলাস ও সম্ভাবনা তত্ত্বের মতো জটিল গণিতিক পদ্ধতিগুলো। বাংলাদেশের ডাটা সায়েন্টিস্ট ড. রাইহান হাসান মন্তব্য করেন, “AI বা ডিপ লার্নিংকে বোঝার জন্য গণিতকে সহজে ব্যাখ্যা করাটা জরুরি। এটি কোনো রহস্যময় জাদু নয়। যত সহজে গণিতকে বোঝানো যাবে, তত দ্রুত আমাদের তরুণেরা এর বাস্তব ব্যবহার নিয়ে কাজ করতে পারবে।”
একটি সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ মনে করেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের মতোই চিন্তা করতে সক্ষম। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। এটি শুধু গণিতের সূত্র ধরে এগিয়ে যাওয়া একটি শক্তিশালী অ্যালগরিদম, যার নেই কোনো নিজস্ব অনুভূতি বা সচেতনতা।
সুতরাং পরবর্তীবার যখন আপনার ফোন আপনাকে পছন্দের সিনেমা বা খাবারের কথা মনে করিয়ে দেবে, তখন মনে রাখবেন—এটি আসলে একগুচ্ছ জটিল গণিতিক হিসাবের ফলাফল, কোনো ভাবুক কম্পিউটারের মনের কথা নয়।
Leave a comment