রাত ১১টা। রাতুল নিজের স্মার্টফোনের স্ক্রিনে স্ক্রল করছে। সারাদিনের ক্লান্তি দূর করার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সময় কাটানো তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ফেসবুকে চোখ বোলাতে বোলাতে একের পর এক গল্প, কবিতা, আর সুন্দর ছবি দেখে মন ভরে উঠল তার। হঠাৎ নজরে পড়ল বন্ধুর শেয়ার করা একটি অসাধারণ পোস্ট—একটি কবিতা, চমৎকার ভাষা, ভাব, আর আবেগ। মুহূর্তেই সে কবিতাটি শেয়ার করে ফেলল। কিন্তু মিনিট খানেক পরেই বন্ধু তাকে জানাল, “এটি কিন্তু AI দিয়ে তৈরি কবিতা।”
সত্যিই কি তাই? মানুষ নয়, যন্ত্রের তৈরি লেখা এখন আমাদের আবেগকে এত গভীরভাবে স্পর্শ করছে? বাস্তবতা হলো, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) আজকের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অন্যতম চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। কেবল কবিতা বা গল্প নয়, ছবি, ভিডিও, এমনকি অডিও কন্টেন্টেও AI-এর উপস্থিতি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি জনপ্রিয় চলচ্চিত্র এবং গানের ক্ষেত্রেও ক্রমেই AI প্রযুক্তির ব্যবহার চোখে পড়ছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৬ সালের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রায় ৪৮ শতাংশ কন্টেন্ট তৈরি হবে AI প্রযুক্তির মাধ্যমে, যা ২০২৪ সালে ছিল মাত্র ৩৯ শতাংশ। একটি আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া এই পরিসংখ্যান আমাদের নতুন এক বাস্তবতার দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এই সংখ্যা আগামী কয়েক বছরের মধ্যে আরও দ্রুত বাড়তে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী আনিসুর রহমান বলেন, “মানুষের লেখা সবসময় আবেগ এবং সৃজনশীলতাকে ধারণ করে, কিন্তু AI যে গতিতে উন্নতি করছে তাতে ভবিষ্যতে মানব-লেখার প্রয়োজনীয়তা কমে আসবে বলেই মনে হয়। তবে এর ফলে সৃজনশীলতা এবং মৌলিকতার ওপর দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। লেখার মধ্য দিয়ে মানুষের অভিজ্ঞতা, সংস্কৃতি, ও ঐতিহ্যের প্রকাশ ঘটবে কিনা—এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।”
তরুণ প্রজন্ম AI-এর ব্যবহারকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সামিহা বলেন, “AI আমাকে দ্রুত ভাইরাল হতে সাহায্য করে। আমার ফলোয়ারও বেড়েছে। AI ব্যবহার করে সহজেই ভালো মানের পোস্ট তৈরি করা সম্ভব। এটি সময় বাঁচায় এবং বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাতে সাহায্য করে।”
কিন্তু অন্যদিকে রয়েছে গভীর উদ্বেগ। সাহিত্যিক ও কবি সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সতর্ক করে বলেন, “মানুষের চিন্তা, মনন, ও সৃজনশীলতার জায়গা যেন AI দখল করে না নেয়, সে বিষয়ে সচেতন থাকা জরুরি। প্রযুক্তি আমাদের সহায়ক হতে পারে, কিন্তু নিয়ন্ত্রক নয়। লেখা কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি মানুষের আত্মপ্রকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার প্রবণতা AI-এর ব্যবহারকে উস্কে দিচ্ছে। এতে বিজ্ঞাপনদাতারাও আকৃষ্ট হচ্ছেন, কারণ দ্রুত ভাইরাল কন্টেন্ট বিজ্ঞাপন আয়ে বড় ভূমিকা রাখে। অর্থনৈতিক কারণেও AI-সৃষ্ট কন্টেন্টের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এক গবেষণায় উঠে এসেছে, ২০৩১ সালের মধ্যে AI-ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বাজার প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছতে পারে।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভবিষ্যতে মানুষ ও AI-এর মধ্যে সহাবস্থান সম্ভব। তবে সেই সহাবস্থান হবে সতর্ক এবং ভারসাম্যপূর্ণ। মানবিক সংবেদনশীলতা, বিবেচনা ও সচেতনতা—এই গুণগুলোই মানুষের লেখাকে চিরকাল আলাদা করে রাখবে বলে তারা আশাবাদী। AI যেভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে জায়গা করে নিচ্ছে, তাতে মানবিক বৈচিত্র্য ও মৌলিকতাকে রক্ষা করা আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ।
রাতুল আবারো স্ক্রল করতে করতে ভাবল, মানুষের লেখা কন্টেন্টের কি সত্যিই শেষ দিন এসে গেছে, নাকি নতুন কোনো যুগের সূচনা হচ্ছে? উত্তর হয়তো সময়ই বলে দেবে।
Leave a comment