আহমদ শামসুল ইসলাম: (৬ আগস্ট ১৯২৪—১৪ এপ্রিল ২০২৫)
বাংলাদেশে গবেষণার পথিকৃৎ ও এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের বিদায়
তোফাজ্জল ইসলাম
প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও অধ্যাপক, ইনস্টিউট অভ বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, গাজীপুরকৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ফেলো, বাংলাদেশও বিশ্ব বিজ্ঞান একাডেমি
ই—মেইল: [email protected]
বিজ্ঞান কোনো ভৌগোলিক সীমানা, ধর্ম, বর্ণ কিংবা রাজনৈতিক পক্ষপাত মানে না। এটি সকলের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। এটি সকলের জন্য উন্মুক্ত হলে সকলেই এর সুবিধা ভোগ করে। বর্তমান বিশ্বে আমরা যা কিছু ব্যবহার করছি, তা কেবলই বিজ্ঞান। বিজ্ঞানই সভ্যতার বিকাশ এবং অর্থনীতিক উন্নয়নের চালিকা শক্তি। যে দেশ বা সমাজে যত বেশী বিশ্বমানের বিজ্ঞানী রয়েছে, সে দেশ বা সমাজ বিশ্বে তত উন্নত এবং মর্যাদার আসনে আসীন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে উন্নয়নশীল দেশে বিজ্ঞানীরা প্রায়ই রাজনীতির বলি হন। বাংলাদেশেও বিজ্ঞানীদের কাজ ও স্বীকৃতিকে রাজনৈতিক ট্যাগিং ক্ষতিগ্রস্ত করে চলেছে। আমাদের অবশ্যই বিজ্ঞানীদের যেকোনো ট্যাগিং ও বৈষম্য থেকে মুক্ত রাখতে হবে এবং সমাজ ও দেশের বৃহত্তর স্বার্থে তাদের লালন করতে হবে। নতুবা, বিজ্ঞান এখানে বিকশিত হবে না এবং বেশিরভাগ মেধাবী ও সম্ভাবনাময় বিজ্ঞানী সুযোগের জন্য দেশ ছেড়ে উন্নত বিশ্ব চলে যাবেন। মেধা পাচার রোধ করতে, আমাদের অবশ্যই বিজ্ঞানীদের রাজনৈতিক ট্যাগিং থেকে মুক্ত রাখতে হবে এবং তাদেরকে কোনো রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব ছাড়াই সমাজে সেবা করার সুযোগ দিতে হবে।
বাংলাদেশে এক অসাধারন ও প্রভাবশালী বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী ছিলেন অধ্যাপক আহমদ শামসুল ইসলাম। দেশে বিরাজমান উল্লিখিত শত প্রতিকুলতাকে জয় করে তিনি স্বীয় মহিমায় উদ্ভাসিত হয়েছিলেন। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এক বিরল উদাহরন হিসেবে। দেখিয়েছেন কীভাবে উন্নয়নশীল দেশে কাজ করেও বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু বিজ্ঞান গবেষণা দেশের মুখ সমুজ্জল করা যায়। তিনিছিলেন শতাধিক বিজ্ঞানীর জন্য মেন্টর ও আলোকবর্তিকা, যারা এখন দেশে ও বিদেশে কাজ করছেন। শতবর্ষেরওবেশিজীবনকালেতিনিটিস্যুকালচারওবায়োটেকনোলজিরক্ষেত্রেবিজ্ঞানচর্চায়অগ্রদূতওনেতৃত্বদানকারীগবেষকছিলেন, যাআমাদেরকৃষিখাদ্যনিরাপত্তাওগবেষণাকেদৃঢ়ভাবেপ্রভাবিতকরেছে।বিষ্ময়কর বিষয় হচ্ছে, তিনি রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব থেকে মুক্ত ছিলেন এবং নিজেকে যেকোনো ট্যাগিং থেকে দূরে রেখেছিলেন। গত ১৪ই এপ্রিল ২০২৫তারিখে দেশের বিজ্ঞানী সমাজ এবং সকল শুভানুধ্যায়ীদের কাঁদিয়ে১০০ বছর৭ মাস বয়সে তিনি পরলোকগমন করেন। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর সংস্পর্শে আসার, যা বাংলাদেশে আমার বৈজ্ঞানিক ও অধ্যাপনা জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। যদিও তিনি আমার প্রত্যক্ষ শিক্ষক ছিলেন না, তবুও তিনি আমার এবং অন্যান্য বিজ্ঞানীদের জন্য একজন আদর্শ ছিলেন, যারা এই সুন্দর কিন্তু অত্যন্ত মেরুকৃত সমাজে বিশ্বস্তরে প্রতিযোগিতামূলক বিজ্ঞান চর্চার সংগ্রাম করছেন। কিংবদন্তী এ সফল বিজ্ঞানীর আলোকিত জীবনের ওপর কিছুটা আলোকপাত এবং তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধান্জলী অর্পণই এ প্রবন্ধের অবতারনা।
আহমদ শামসুল ইসলাম ১৯২৪ সালের ৬ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের মেদিনীপুর জেলায়। রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল ও রাজশাহী কলেজে প্রাথমিকও মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণের পর তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯৪৫ সালে উদ্ভিদবিজ্ঞানে অনার্স এবং ১৯৪৭ সালে এমএসসি সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে ব্রিটিশ কাউন্সিলের বৃত্তি নিয়ে তিনি (প্রথম বৃটিশ কাউন্সিল বৃত্তিধারী) যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণায় যুক্ত হন এবং ১৯৫৪ সালে সাইটোজেনেটিকসে ডিগ্রি অর্জন করেন। স্ট্রবেরির ক্রোমোজোম বিশ্লেষণে এবং বীজবিহীন স্ট্রবেরি উদ্ভাবনে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ওই বছর “কারি মেমোরিয়াল পুরস্কার” লাভ করেন।
আহমদ শামসুল ইসলামের গবেষণার শুরুতেই উদ্ভিদ সাইটোজেনেটিক্স নিয়ে বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার এএকাধিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় । ১৯৬০ সালে নেচার সাময়িকীতেই তিনি বিশ্বে প্রথমবারের মতো দুই প্রজাতির পাট গাছের মধ্যে সফল সংকরায়ণ ঘটিয়ে গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন, যা আজও প্রাসঙ্গিক গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তাঁর নেতৃত্বে ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রথমবারের মতো উদ্ভিদের টিস্যু কালচার গবেষণা (চিনিকেন্ড্রিক ফসলের ওপর) প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।
আহমদ শামসুল ইসলাম কর্মজীবন শুরু করেন ততকালীন পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট এ এবং পাটের জিন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা সূচনা করেন । তিনি ১৯৭১ সালের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং তখন থেকেই বাংলাদেশে আধুনিক উদ্ভিদবিজ্ঞান ও বায়োটেকনোলজি গবেষণার ভিত্তি নির্মাণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তাঁর হাতে দেশের প্রথম ‘প্ল্যান্ট টিস্যু কালচার ও জেনেটিকস ল্যাবরেটরি’ প্রতিষ্ঠিত হয়, যা পরবর্তীতে কৃষিভিত্তিক বায়োটেকনোলজির বিস্তারে মৌলিক ভূমিকা রাখে।তিনি স্থানীয় পাট, আলু, ও অর্কিডের রোগমুক্ত চারা উৎপাদনে টিস্যু কালচার পদ্ধতির প্রবর্তন করেন । দেশব্যাপী কর্মশালা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তিনি অসংখ্য তরুণ বিজ্ঞানীকে এই নতুন ধারার গবেষণায় উদ্বুদ্ধ ও দক্ষ করে তোলেন।
বাংলাদেশের পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন বিজ্ঞানের সবচাইতে আলোচিত বিষয়। এই ঐতিহাসিক উদ্যোগের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন অধ্যাপক আহমদ শামসুল ইসলাম। তিনিই প্রথম পাট জিনোম গবেষণার দিশা দেখান । ২০০৫ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে সোনালী আঁশ খ্যাত পাটের জিনোম বিশ্লেষণের প্রাথমিক কাজের একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। পাটের জিনোম সিকুয়েন্সিং প্রকল্পে তাঁর দূরদর্শিতা, নেতৃত্ব এবং বিশ্বমানের গবেষকদের মধ্যে সমন্বয় ঘটানোর দক্ষতা আজও অনুকরণীয়। এ প্রকল্পে তিনিপ্রবাসী বিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলমকে যুক্ত করেন। পরে ড. মাকসুদুল আলম এই প্রকল্পের সফল রূপদানকারী হয়ে ওঠেন।তোষা ও দেশী পাটের জিনোম সিকুয়েন্স বিশ্লেষণ বিষয়ক প্রবন্ধটি বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার প্লান্টস এ প্রকাশিত হয়। এ ঐতিহাসিক প্রবন্ধটি প্রফেসর আহমদ শামসুল ইসলামের নামে উৎসর্গ করা হয়। আলোড়ন সৃষ্টিকারী পাটের জিনোম সিকুয়েন্স বিশ্লেষণে নেতৃত্বদানের সফলতার জন্য ততকালীন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত বাঙালী বিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলম দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক স্বীকৃতি ‘স্বাধীনতা পদক’ লাভ করেন। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, স্বাধীনতা পুরস্কার গ্রহণকালে ড. মাকসুদুল আলম পরলোকগত ছিলেন।
অধ্যাপক আহমদ ইসলাম ছিলেন আন্তর্জাতিকভাবে প্রশিক্ষিত ও স্বীকৃত বিজ্ঞানী। তিনি ক্যালিফোর্নিয়া ডেভিস, কর্নেল, নটিংহাম, টোকিওসহ বহু বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও শিক্ষকতায় যুক্ত ছিলেন। তাঁর জীবনকর্মে দেখা যায় একান্তভাবে জ্ঞানচর্চা, বিজ্ঞানমনস্কতা এবং নেতৃত্বের এক দুর্লভ সমন্বয়।তিনি বাংলাদেশ এবং বিশ্ব বিজ্ঞান একাডেমির একজন নির্বাচিত ফেলো ছিলেন।
অধ্যাপক আহমদ ইসলাম ছিলেন বাংলাদেশ জার্নাল অব বোটানির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এবং Journal of Plant Tissue Culture and Biotechnology-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, যা আজও দেশের অন্যতম বৈজ্ঞানিক সাময়িকী হিসেবে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। এছাড়াও, তিনি পাঁচটি আন্তর্জাতিক জার্নালের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। তিনি রচনা করেছেন একাধিক পাঠ্যপুস্তক। তাঁর রচিত ‘বংশগতিবিদ্যার মূলকথা ও জীন প্রকৌশল’ বাংলা ভাষায় জিনতত্ত্বের প্রথম পাঠ্যপুস্তক হিসেবে স্বীকৃত।অধ্যাপক আহমদ শামসুল ইসলাম ছিলেন Global Network of Bangladeshi Biotechnologists (GNOBB)-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম মডারেটর। তাঁর অনুপ্রেরণায় গঠিত এ প্রভাবশালী প্ল্যাটফর্মটি প্রবাসী ও দেশীয় বিজ্ঞানীদের মধ্যে এক বিশাল সংযোগ তৈরি করে, যার ফলস্বরূপ বহু যৌথ গবেষণা ও উদ্ভাবন সম্ভব হয়েছে।
১৯৮৪ সালে অধ্যাপক আহমদ শামসুল ইসলাম‘রাষ্ট্রপতির কৃষি স্বর্ণপদক’ এবং ১৯৮৭ সালে শিক্ষায় বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘একুশে পদক’ লাভ করেন ।তিনি বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস স্বর্ণপদক (১৯৮৭) লাভ করেন । তাঁর উত্তরসূরিরা আজ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক সংস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। তিনি শুধু একজন পথিকৃত বিজ্ঞানী ছিলেন না—ছিলেন এক আলোকিত শিক্ষক, যাঁর শিক্ষা ও আদর্শে গড়ে উঠেছে এক বিজ্ঞানমনস্ক প্রজন্ম।
অধ্যাপক আহমদ ইসলাম শুধু শিক্ষক কিংবা গবেষক ছিলেন না, ছিলেন একজন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন স্বপ্নদ্রষ্টা—যিনি ভবিষ্যতের বিজ্ঞান সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। অধ্যাপক আহমদ শামসুল ইসলামের অবদান স্মরণ করে নিঃসংকোচে বলা যায়—তাঁর জীবন ছিল বাংলাদেশের বিজ্ঞানজগতের এক দীপ্ততম অধ্যায়। তিনি আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু রেখে গেছেন এক অনন্ত আলো—যা আগামীর বিজ্ঞানযাত্রায় পথ দেখাবে আমাদের।
শুধু বিজ্ঞান এবং শিক্ষায় নয়, অধ্যাপক ইসলাম ছিলেন একজন সফল পিতা। তাঁর কন্যা অধ্যাপক জেবা ইসলাম সেরাজঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদের একজন খ্যাতনামা গবেষক এবং দেশ সেরা জীবপ্রযুক্তিবিদ। বড় ছেলে অধ্যাপক ইউসুফ মাহবুবুল ইসলাম সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং ছোট ছেলে খালিদ ইসলাম যুক্তরাষ্ট্রে সফটওয়ার ইন্জিনিয়ার ।
প্রফেসর আহমদ ইসলাম শুধু বিজ্ঞানী নন, ছিলেন আদর্শ শিক্ষক ও সমাজসংগঠক। ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন কুরআনিক স্কুল সোসাইটি, যার মাধ্যমে শিশুদের নৈতিক শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করেন। তাঁর মৃত্যু আমাদের দিয়েছে এক অপূরণীয় শূন্যতা, কিন্তু রেখে গেছেন জ্ঞান, আদর্শ আর এক গভীর মানবিক আলো। আজ আমরা যখন নতুন বিজ্ঞানযাত্রার পথে এগিয়ে চলেছি, তখন তাঁর দেখানো পথই আমাদের সবচেয়ে বড় প্রেরণা। আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি এই মহান বিদ্বজ্জনকে—যাঁর জীবনাদর্শ বলে গেছে, “জ্ঞানই শক্তি, আর তার প্রয়োগই মুক্তি”।
Leave a comment