উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সুযোগগবেষণায় হাতে খড়ি

পিএইচডি বিক্রি হচ্ছে টাকায়, গবেষণার নামে চলছে প্রতারণা

Share
Share

বুধবার সকালে কুমিল্লার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রফিকুল ইসলামের ফোন বেজে উঠল। অপর প্রান্তে একজন পরিচিত সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, “স্যার, আমাদের এলাকার এক জনপ্রতিনিধি নাকি সম্প্রতি পিএইচডি করেছেন। আপনারা কি তাঁকে জানেন?”

সাংবাদিকের প্রশ্ন শুনে হতবাক হলেন রফিকুল। কারণ তিনি বেশ কিছুদিন ধরেই বিষয়টি লক্ষ্য করছিলেন। ওই জনপ্রতিনিধির ফেসবুক প্রোফাইলে লেখা—তিনি ‘আন্তর্জাতিক’ একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই কোনো স্বীকৃতি, নেই কোনো গ্রহণযোগ্যতা।

এই ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয়। বর্তমানে বাংলাদেশে সহজেই মিলছে পিএইচডি ডিগ্রি, শুধু পকেটে টাকা থাকলেই। ফলে সমাজে ক্রমেই বাড়ছে ভুয়া ডিগ্রিধারীদের আধিপত্য। এ নিয়ে চিন্তিত শিক্ষাবিদ ও প্রকৃত গবেষকরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আনিসুর রহমান বলেন, “পিএইচডি মানে হলো জ্ঞানের সাগরে নতুন কিছু আবিষ্কার করা। কিন্তু এখন টাকা দিয়ে গবেষণা ছাড়াই পাওয়া যাচ্ছে এই ডিগ্রি। এতে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে প্রকৃত গবেষকদের, কারণ মানুষ বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে।”

সম্প্রতি চট্টগ্রামে একজন শিক্ষক ভুয়া পিএইচডির কারণে চাকরি হারিয়েছেন। তিনি বিদেশি একটি নামমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনলাইনে ডিগ্রি কিনে নিয়েছিলেন। পরে যাচাইয়ে ধরা পড়ে যান তিনি। এমন বহু ঘটনা ঘটছে যা এখন উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।

কে প্রকৃত, কে প্রতারক?

গবেষকদের মতে, বর্তমানে পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়।

১। প্রকৃত গবেষক ও একাডেমিক

এরা দীর্ঘদিন ধরে গবেষণায় নিয়োজিত, স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। তাদের গবেষণাপত্র নিয়মিত প্রকাশিত হয় আন্তর্জাতিক জার্নালে, যা যাচাই-বাছাই (পিয়ার রিভিউ) করা হয়। তাদের গুগল স্কলার, ORCID, বা রিসার্চগেটের মতো প্রোফাইলও থাকে। তারা জ্ঞান বৃদ্ধিতে আগ্রহী এবং নতুন আবিষ্কারের জন্য নিরলস পরিশ্রম করেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ফাহমিদা ইসলাম বলেন, “প্রকৃত গবেষকরা তাদের গবেষণাকে জীবনের অংশ হিসেবে দেখেন। তারা কখনোই শর্টকাটে বিশ্বাস করেন না।”

২। টাকা দিয়ে কেনা ভুয়া পিএইচডি

এই শ্রেণির ডিগ্রিধারীরা মূলত গবেষণা করেন না। নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকার বিনিময়ে নামমাত্র গবেষণাপত্র কিনে নিয়ে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের সনদ প্রদর্শন করেন। তাদের গবেষণার বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘোষণাও দিয়ে থাকেন তারা। এদেরকে সহজেই চিহ্নিত করা সম্ভব, কারণ তাদের গবেষণা প্রোফাইল অনুপস্থিত থাকে।

ঢাকার এক শিক্ষার্থী জানান, “আমাদের এলাকায় একজন ব্যবসায়ীও এখন নিজেকে ডক্টর বলে পরিচয় দেন। অথচ এলাকার সবাই জানে, তিনি টাকা দিয়ে ডিগ্রি কিনেছেন।”

৩। মিশ্র ধরনের প্রতারক পিএইচডি (হাইব্রিড)

সবচেয়ে উদ্বেগের কারণ এই শ্রেণির ডিগ্রিধারীরা। এরা একাডেমিক পদে কর্মরত থাকার পরেও বিভিন্ন অসদাচরণে জড়িত। কখনো গবেষণার তথ্য জাল করেন, কখনো অন্যের গবেষণার কৃতিত্ব নিজের নামে চালিয়ে দেন। অনেক সময় প্রভাব খাটিয়ে গবেষণাপত্রে নাম যুক্ত করে নেন। একজন প্রতিষ্ঠিত গবেষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “একাডেমিক জগতে এ ধরনের মানুষ বেশি ক্ষতিকর। কারণ তারা সাধারণ মানুষের আস্থা নষ্ট করেন।”

সামাজিক ক্ষতি ভয়াবহ

ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. নাজমুল হক বলেন, “ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের কারণে প্রকৃত গবেষকরা উৎসাহ হারাচ্ছেন। সমাজে শিক্ষার প্রতি আস্থা কমে যাচ্ছে, তরুণরা বিভ্রান্ত হচ্ছেন। ভবিষ্যতে এর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।”

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)-এর এক কর্মকর্তার মতে, “ভুয়া ডিগ্রি প্রদানের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে এই সমস্যা আরও ভয়াবহ হবে।”

সচেতনতা জরুরি

তাহলে কীভাবে চিনবেন প্রকৃত গবেষক ও ভুয়া ডিগ্রিধারীদের? বিশেষজ্ঞরা কিছু পরামর্শ দিয়েছেন:

  • সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি যাচাই করুন।
  • গবেষকের গবেষণাপত্রের অবস্থান ও প্রকাশনার মান পরীক্ষা করুন।
  • গুগল স্কলার, ORCID বা রিসার্চগেটে তাদের প্রোফাইল খুঁজুন।

একাডেমিক জগতে সততা ফিরিয়ে আনতে হলে সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতার বিকল্প নেই। সরকারের পাশাপাশি নাগরিকদেরও এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই হয়তো ফিরে পাওয়া যাবে পিএইচডির প্রকৃত মর্যাদা।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
গবেষণায় হাতে খড়ি

ইংরেজি ব্যাকরণের পাঁচটি সাধারণ ভুল কীভাবে এড়ানো যায়

একাডেমিক লেখালেখিতে ৫টি সাধারণ ইংরেজি ব্যাকরণ ভুল কীভাবে এড়ানো যায় তা শিখুন।...

উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সুযোগবিজ্ঞানীদের জীবনী

ড. রউফুল আলম

স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশ্ব বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ের কাছে যুগান্তকারী গবেষণা অবদানকারী বাংলাদেশী জৈব...

কলামগবেষণায় হাতে খড়ি

কলাম: মেন্টর তৈরির সংস্কৃতি

বিজ্ঞান ও উদ্ভাবনে জার্মানি এবং জাপানের আধিপত্যকে কীভাবে পরামর্শদানের সংস্কৃতি প্রভাবিত করেছে...

উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সুযোগতথ্যপ্রযুক্তি

কোডিং করে ঘুরে আসুন সান ফ্রান্সিসকো

১৮ বছরের কম বয়সী কিশোর-কিশোরীদের জন্য GitHub-এর ২০২৫ সালের কোডিং চ্যালেঞ্জ আবিষ্কার...

কলামগবেষণায় হাতে খড়ি

কলাম: নক্ষত্রদের গুরু

হাইজেনবার্গ এবং পাওলির মতো নোবেল বিজয়ী পদার্থবিদদের পিছনের পরামর্শদাতা আর্নল্ড সমারফেল্ডের অবিশ্বাস্য...

Three Columns Layout

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact

biggani.org❤️gmail.com

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

যোগাযোগ:

biggani.org@জিমেইল.com

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.