শিরোনাম:
প্রযুক্তির তীব্র বিকাশে আমরা কি আসলে মেধাহীনতার দিকে এগোচ্ছি?
বর্তমান যুগে সোশ্যাল মিডিয়ার রিলস আর স্টোরি আমাদের বিনোদন ও কন্টেন্টের জগতে যেন ঝড় বইয়ে দিয়েছে। একদিকে এগুলো আমাদের হাতে-নাতে অগণিত কন্টেন্ট এনে দিচ্ছে, ক্রিয়েটরদের কাজকে করেছে সহজ এবং পৌঁছে দিচ্ছে অঢেল সুযোগ। অন্যদিকে, এত দ্রুত আর ক্ষুদ্র-দৈর্ঘ্যের ভিডিও কনটেন্ট দেখে দেখে আমাদের মস্তিষ্কের মনোযোগের সক্ষমতা (ADHD) দিন দিন কমে যাচ্ছে। আগে হয়তো আমরা বই খুলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মগ্ন থাকতে পারতাম, এখন একটা লম্বা লেখা দেখলেই আর পড়তে ইচ্ছে করে না।
মানুষের মস্তিষ্ক প্রকৃতিগতভাবেই ধীর গতির পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে চলতে অভ্যস্ত। বিবর্তনের জটিল প্রক্রিয়ায় গড়ে ওঠা এই অঙ্গ আকস্মিক, তীব্র পরিবর্তনে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে। আজ আমরা ডিজিটাল দুনিয়ায় এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছেছি, যেখানে একের পর এক নতুন টুল, প্ল্যাটফর্ম বা প্রযুক্তি—সবকিছুই দৃষ্টিপাতের আগেই বদলে যাচ্ছে। ফলে আমাদের মনোযোগ ক্রমাগত ভাঙছে, স্থায়িত্ব হারাচ্ছে, আর মস্তিষ্ক হতবিহ্বল হয়ে পড়ছে।
এই পটভূমিতে ‘লার্জ ল্যাংগুয়েজ মডেল’ বা AI-চালিত বিভিন্ন প্রযুক্তি নতুন মাত্রায় আমাদের কাজকে সহজ করে দিচ্ছে। গাণিতিক হিসাব থেকে শুরু করে কোডিং—আগে যা আমাদের নিজে করতে হতো, এখন সহজে সফটওয়্যারই করে দিচ্ছে। কষ্ট করে চিন্তা না করেও আমরা পেয়ে যাচ্ছি প্রয়োজনীয় সমাধান। এতে সাময়িকভাবে আমাদের উৎপাদনশীলতা হয়তো বেড়ে যাচ্ছে, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশ, যুক্তি আর বোধের জায়গাটি কোথায় যাচ্ছে?
আমাদের চারপাশের চ্যালেঞ্জগুলো যদি আর আমাদের ভাবায় না, যদি সব প্রশ্নের উত্তর মেলে এক ক্লিকে, তবে আমরা শেখার আনন্দ, সৃজনশীলতার তাগিদ—এসব ধীরে ধীরে হারাতে বসি। একসময় হয়তো এক নিঃশ্বাসে বই পড়া বা গভীরভাবে একটি বিষয় নিয়ে বিশ্লেষণ করার মতো ধৈর্য আর কারো থাকবে না। প্রযুক্তি আমাদের সময় বাঁচাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সেই সময় আমরা কি উৎপাদনশীল কাজে ব্যয় করছি, নাকি আরো বেশি সারফেস-লেভেল বিনোদনে ডুবে যাচ্ছি?
সব মিলিয়ে, প্রশ্নটা এসে দাঁড়ায়—“আমরা কি বেশি উৎপাদনশীল হতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত আরও ‘অসচেতন’ হয়ে পড়ছি?” বাড়তি স্বাচ্ছন্দ্য আর সহজসাধ্যতার কারণে আমরা যেন চিন্তাকে গৌণ করে ফেলছি। নতুন প্রজন্ম একসময় গণিত করবে না, কোড লেখবে না—সবকিছুই যদি যন্ত্র করে দেয়, তবে মানুষের সৃজনশীলতা, যুক্তিকাঠামো ও চিন্তার পরিসর কোথায় দাঁড়াবে?
বলা হয়, “What we call increased productivity, might result in an increased stupidity.” বর্তমান প্রযুক্তি আমাদের একদিকে গতিময়তা ও স্বাচ্ছন্দ্য দিচ্ছে, অন্যদিকে চিন্তা ও মনোযোগের জায়গায় তৈরি করছে এক বিশাল শূন্যতা। সচেতনভাবে যদি আমরা নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলন চালিয়ে না যাই, তবে হয়তো আমরা খুব দ্রুত জ্ঞান-বিজ্ঞানের নিম্নপর্যায়ে গিয়ে পৌঁছবো। সময় থাকতে আমাদের প্রশ্ন করতে হবে: প্রযুক্তির বিকাশকে কীভাবে স্বাস্থ্যকরভাবে ব্যবহার করা যায়, যাতে আমরা সত্যিকারের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশও নিশ্চিত করতে পারি?
নতুন প্রযুক্তিকে পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, বরং একে সঠিকভাবে ব্যবহার করা, নিজের দক্ষতা বাড়ানো, সৃজনশীল চিন্তাকে চালিয়ে যাওয়া—এসবের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করাই হবে মূল চাবিকাঠি। নইলে অতিরিক্ত সুবিধার মোহে পড়ে আমাদের সামাজিক, বৌদ্ধিক ও মানসিক বিকাশ হ্রাস পেতে পারে। কাজেই, এখনই সময় ভাবার—প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে গিয়ে যেন ‘মানবিক বুদ্ধি’ পিছিয়ে না পড়ে।
Leave a comment