ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম (১৯১১–১৯৮৯) ছিলেন বাংলাদেশের চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে এক অনন্য স্বাক্ষর, যিনি দেশের ডায়াবেটিস চিকিৎসা ও গবেষণা ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি শুধু একজন চিকিৎসক ছিলেন না, ছিলেন সমাজসেবী, শিক্ষা সংস্কারক, এবং জনস্বাস্থ্যের অগ্রদূত। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে তাঁর অবদানকে আজও প্রবাদপ্রতিম হিসেবে গণ্য করা হয়। তাঁর হাতে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন এবং পরবর্তীতে গড়ে ওঠা বিআইআরডিইএম (BIRDEM) ইনস্টিটিউট ডায়াবেটিস চিকিৎসা, গবেষণা ও প্রশিক্ষণক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ করে।
জন্ম ও শৈশবের পটভূমি
ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম ১৯১১ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার ছিল শিক্ষিত ও সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ। ছোটবেলায় পরিবার থেকেই তিনি পেয়েছিলেন সাধারণ মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার অনুপ্রেরণা। সেই সময় ব্রিটিশ-ভারতের সাম্প্রতিক ইতিহাস, স্বাধীনতা আন্দোলন, এবং শিক্ষার প্রসারের প্রভাব তাঁর মানসগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন এবং পরবর্তীতে স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গ থেকে এমআরসিপি (MRCP) সম্পন্ন করেন। এই উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন তাঁর চিকিৎসা জ্ঞানকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পৌঁছে দেয়।
পেশাগত জীবনের শুরু
ভারত বিভাগোত্তর সময়ে, বহু বাঙালি চিকিৎসক দেশের ভেতরে বাইরে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। ডা. ইব্রাহিম সেই সময় পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ)-এ ফিরে এসে ঢাকা মেডিকেল কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনি ধীরে ধীরে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নিজস্ব দর্শন ও কৌশল গড়ে তোলেন, যেখানে শুধু রোগ নিরাময় নয়, রোগ প্রতিরোধ, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, এবং সমন্বিত স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রসার ছিল প্রধান লক্ষ্য। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে ডায়াবেটিস একটি ক্রমবর্ধমান বিপদ হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশে এই রোগের ব্যবস্থাপনা এবং সচেতনতার প্রয়োজনীয়তা খুব বেশি হলেও সেসময় তা ছিল অতি সীমিত।
ডায়াবেটিস গবেষণার প্রেক্ষাপট
বিশ্বময় ডায়াবেটিস রোগ একটি নীরব ঘাতক হিসেবে দেখা দিয়েছিল। তখনো বাংলাদেশে (সাবেক পূর্ব পাকিস্তান) ডায়াবেটিস রোগের বিস্তৃতি, কারণ, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে তেমন গবেষণা বা চিকিৎসা অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি। ডা. ইব্রাহিম এই শূন্যস্থান পূরণের প্রয়াস নেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘমেয়াদী রোগের চিকিৎসা শুধু ওষুধে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না; এর সঙ্গে দরকার প্রশিক্ষিত জনবল, সচেতন রোগী, সুষম খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম, জীবনযাত্রার পরিবর্তন, এবং সর্বোপরি সামাজিক উদ্যোগ। এই ধারণা বাস্তবায়নে তিনি একটি সংগঠিত কাঠামো চেয়েছিলেন যেখানে রোগী, চিকিৎসক, গবেষক, এবং সমাজকর্মীরা মিলেমিশে কাজ করতে পারবেন।
ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশনের জন্ম
১৯৫৬ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন Diabetic Association of Pakistan, যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর Diabetic Association of Bangladesh নামে পরিচিতি লাভ করে। এই সংগঠন কেবল একটি চিকিৎসা কেন্দ্র নয়, বরং একটি সামাজিক আন্দোলন হিসেবে কাজ করেছে। এর উদ্দেশ্য ছিল ডায়াবেটিস সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করা, রোগ নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা তৈরি, এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সুলভ চিকিৎসা নিশ্চিত করা। স্বেচ্ছাসেবক, রোগী ও তাদের পরিবার, চিকিৎসক, খাদ্য বিশেষজ্ঞ এবং সমাজকর্মীদের সমন্বয়ে এই অ্যাসোসিয়েশন ধীরে ধীরে একটি শক্তিশালী ভিত্তি গড়ে তোলে।
বিআইআরডিইএম (BIRDEM)-এর প্রতিষ্ঠা ও কার্যক্রম
ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশনের সাফল্যের পর ডা. ইব্রাহিম বুঝতে পারলেন যে আরও সংগঠিত ও গবেষণাধর্মী একটি প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন, যেখানে ডায়াবেটিস এবং অন্যান্য অন্তঃস্রাবী গ্রন্থিসংক্রান্ত রোগ নিয়ে গভীর গবেষণা, প্রশিক্ষণ এবং উন্নত চিকিৎসাসেবা দেওয়া যাবে। ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত হলো বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন ইন ডায়াবেটিস, এন্ডোক্রাইন অ্যান্ড মেটাবলিক ডিসঅর্ডারস (BIRDEM)। এটি শুধু ডায়াবেটিস চিকিৎসা দেয় না, এন্ডোক্রাইন এবং মেটাবলিক রোগের ক্ষেত্রেও গবেষণা ও চিকিৎসা সেবা প্রদান করে। এখানে রোগীদের জন্য রয়েছে পুষ্টি নির্দেশনা, নিয়মিত চেকআপ, ইনসুলিন ও ওষুধের সরবরাহ, এমনকি ডায়াবেটিস-সম্পর্কিত জটিলতা মোকাবিলার জন্য বিশেষজ্ঞ সেবা।
BIRDEM আজ এশিয়ার সবচেয়ে বড় ডায়াবেটিক চিকিৎসা ও গবেষণা কেন্দ্রগুলোর একটি হিসেবে পরিচিত। প্রতিবছর অগণিত রোগী এখানে চিকিৎসা নেন। ডা. ইব্রাহিমের মূল দর্শন ছিল “কমিউনিটি-বেইজড হেলথ কেয়ার মডেল,” অর্থাৎ চিকিৎসা ব্যবস্থাকে জনতার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া। সেজন্য বিআইআরডিইএমের অধীনে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে শাখা কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে, যাতে গ্রামাঞ্চলের মানুষকেও সহজে ডায়াবেটিস সেবা দিতে পারা যায়।
শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও গবেষণা
ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম বুঝতে পেরেছিলেন, ডায়াবেটিসের মতো একটি রোগ নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে কেবল ক্লিনিকাল চিকিৎসাই যথেষ্ট নয়, দরকার চিকিৎসকদের দক্ষতা উন্নয়ন, গবেষণা, এবং জনগণের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলা। তিনি শিক্ষার ক্ষেত্রে ছিলেন অত্যন্ত যত্নবান। বিআইআরডিইএমে চিকিৎসক, নার্স, পুষ্টিবিদ, স্বাস্থ্যকর্মী ও গবেষকদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। নতুন চিকিৎসকরা ডায়াবেটিস সম্পর্কে আধুনিক জ্ঞান আহরণ করতে পারেন এবং সেই জ্ঞান দেশজ প্রেক্ষাপটে প্রয়োগের কৌশল শিখতে পারেন। শিক্ষার্থীদেরও প্রয়োজনীয় গবেষণা উপকরণ ও সুযোগ দিয়ে তিনি encourage করেছিলেন নতুন চিন্তাধারা ও উদ্ভাবন।
গবেষণার ক্ষেত্রে তিনি জোর দিয়েছিলেন দেশীয় খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাত্রা ও পরিবেশগত উপাদানের প্রভাব পর্যবেক্ষণের ওপর। ডায়াবেটিস রোগীদের পুষ্টিকর খাবার, ব্যায়াম পরিকল্পনা, নিয়মিত রক্ত পরীক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরতে তিনি বিশেষ জোর দিতেন। এরফলে, রোগীদের ব্যক্তিগত জীবনযাপনের মানোন্নয়ন এবং স্বাস্থ্যকর জীবন পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি ও জটিলতা কমানো সম্ভব হয়।
সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও জনস্বাস্থ্য
ডা. ইব্রাহিমের একটি বড় অবদান ছিল রোগীদের প্রতি মানবিক ও সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি মনে করতেন চিকিৎসা শুধু ওষুধ ও পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না; দরকার সামাজিক ও মানসিক সমর্থন। অনেক ডায়াবেটিস রোগী দীর্ঘমেয়াদী এই রোগ নিয়ে হতাশায় ভোগেন। তাদের প্রতি সহমর্মিতা, সঠিক পরামর্শ, এবং কাউন্সেলিং প্রদানের মাধ্যমে তিনি এক নতুন ধারার চিকিৎসা সংষ্কৃতি গড়ে তুলেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন ডায়াবেটিস রোগীদের জীবনে স্বনির্ভরতা ও প্রত্যয় গড়ে উঠুক, যেন তারা স্বাভাবিকভাবে কাজকর্ম করে, সমাজের মূলস্রোতে থেকে নিজেদেরকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন।
সামাজিক সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি সাধারণ মানুষের মধ্যে বারবার উচ্চারণ করেছেন যে, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণযোগ্য, ভীতিকর কিছু নয়, যদি সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া যায়। তিনি খাদ্যাভ্যাসে স্থানীয় ফলমূল, শাকসবজি, এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যগ্রহণের উপরে জোর দিয়েছেন, যা উন্নয়নশীল দেশের প্রেক্ষিতে বেশ কার্যকর।
স্বীকৃতি ও সম্মাননা
ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিমের অনন্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাঁকে “জাতীয় অধ্যাপক” (National Professor) উপাধিতে ভূষিত করে। তাঁর অসামান্য কাজের জন্য তিনি স্বাধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর) সহ বেশ কিছু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মাননা লাভ করেন। তাঁর কর্ম শুধু বাংলাদেশে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সমাদৃত হয়। ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন এবং বিআইআরডিইএমের মাধ্যমে গড়ে ওঠা ‘বাংলাদেশ মডেল’ উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ (WHO) বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এই উদ্যোগকে প্রশংসা করেছে।
মৃত্যুপরে তাঁর উত্তরাধিকার
ডা. ইব্রাহিম ১৯৮৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশ একজন সত্যিকারের মানবহিতৈষী ও গুণীজনকে হারায়। কিন্তু তিনি রেখে গেছেন একটি সুসংগঠিত প্রতিষ্ঠান, শত শত প্রশিক্ষিত চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, এবং লক্ষাধিক সচেতন রোগী। বিআইআরডিইএম আজও তাঁর দেখানো পথে এগিয়ে চলছে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা ডায়াবেটিক সেন্টারসমূহ দেশের প্রতিটি স্তরে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিচ্ছে। তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ—দেশজ প্রেক্ষাপটে উদ্ভাবনী চিন্তা, রোগীর প্রতি মানবিক দৃষ্টি, এবং গবেষণাধর্মী স্বাস্থ্যকাঠামো—আজও অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে নতুন প্রজন্মের চিকিৎসক ও গবেষকদের।
উপসংহার
ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম ছিলেন একজন বহুমুখী ব্যক্তিত্ব, যিনি চিকিৎসাকে দেখেছিলেন সর্বাঙ্গীণ জনকল্যাণের হাতিয়ার হিসেবে। ডায়াবেটিসের মতো একটি জটিল ও দীর্ঘমেয়াদী রোগকে তিনি সামগ্রিকভাবে মোকাবেলা করার জন্য অনন্য পথনির্দেশনা দিয়েছেন। তাঁর হাতে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান এবং আন্দোলন আজও দেশের কোটি মানুষের জীবনে স্বস্তি ও নিরাপত্তা নিয়ে আসছে। শিক্ষা, গবেষণা, চিকিৎসা, সচেতনতা বৃদ্ধি—সবকিছুকে একত্র করে তিনি স্বাস্থ্যের যে সমাজমুখী মডেল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তা শুধু অতীতে নয়, ভবিষ্যতেও বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে পথপ্রদর্শক হয়ে থাকবে।
ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিমের জীবনকাহিনি ও কর্মের কথা মনে করিয়ে দেয় যে সত্যিকার উন্নয়ন শুধু অবকাঠামো নয়, বরং মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ও জনসম্পৃক্ত উদ্ভাবনে নিহিত। তাঁর উত্তরাধিকার শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো বিশ্বের জন্য শিক্ষণীয়। এটি আমাদের শেখায় যে মানবকল্যাণমূলক বিজ্ঞানের পথিকৃতেরা যুগে যুগে সমাজকে আলোকিত করে গেছেন এবং যাবেন। ডা. ইব্রাহিম সেই আলোকবর্তিকাদের মধ্যেই একজন, যিনি মানবতার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করে গেছেন নীরবে, কিন্তু গভীরভাবে।
Leave a comment