নবীন প্রজন্মদের সাক্ষাৎকার সিরিজে এবার আমরা সাক্ষাৎকার নিয়েছি শামস নাফিসা আলী এর। তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত। তার সাক্ষাৎকারটি পড়ুন:
প্রথমেই আপনার সম্বন্ধে আমাদের একটু বলুন।
আমি শামস নাফিসা আলী, বাংলাদেশের একজন উদীয়মান গবেষক। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ হতে প্রথম স্থানসহ স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি অর্জন করে বর্তমানে এই বিভাগের অধীনে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধ্যয়নরত রয়েছি । একই সাথে এই বিভাগেই প্রভাষক হিসেবে কর্মরত আছি।
স্নাতক পর্যায়ের সূচনালগ্ন থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গবেষণা কার্যক্রমে যুক্ত থেকে এখন পর্যন্ত আমার ১৫ টির অধিক গবেষণাপত্র খ্যাতিসম্পন্ন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক Q1 জার্নাল ও কনফারেন্সে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণামূলক কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি স্বরূপ আমি ২০২২ সালে জাপানের হোন্ডা ফাউন্ডেশন কর্তৃক “Honda Young Engineer and Scientists’ (Y-E-S) Award 2021” এ ভূষিত হই। এছাড়াও ২০২৩ এবং ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্বনামধন্য Rice University এবং Johns Hopkins University কর্তৃক আয়োজিত গ্লোবাল হেলথকেয়ার ডিজাইন কম্পিটিশনে আমার দুইটি দল বিজয়ী হওয়ার গৌরব অর্জন করে । বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগের মাধ্যমে চিকিৎসা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মেলবন্ধন ঘটিয়ে দেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় নিজেকে শামিল করতে চাই আমি। দেশে মেডিকেল ডিভাইস ইন্ডাস্ট্রির বিকাশে এবং সার্বিক জনস্বাস্থ্য উন্নয়নমূলক বিভিন্ন প্রকল্পে অংশগ্রহণপূর্বক বাংলাদেশকে Sustainable Development Goals (SDGs) অর্জনে সর্বোপরি সহযোগিতা করাই আমার ভবিষ্যৎ লক্ষ্য।
আপনার গবেষনার বিষয় কি?
আমার গবেষণার প্রধান ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে বায়োমেডিক্যাল সিগন্যাল প্রসেসিং, মেডিকেল ইমেজিং, মেশিন লার্নিং এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা সিস্টেম যাতে স্বল্পোন্নত ও প্রত্যন্ত এলাকার সীমিত অবকাঠামোতে IoT ডিভাইস ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে কার্ডিওভাস্কুলার এবং শ্বাসযন্ত্র জনিত ব্যাধি নির্ভুল ও দ্রুততার সহিত শনাক্তকরণ সম্ভবপর হয়। এছাড়াও সাশ্রয়ী মূল্যে ওয়্যেরাবেল (wearable) ডিভাইস এবং মোবাইল স্বাস্থ্যসেবার প্রযুক্তির উপর আমি কাজ করছি। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের ‘Fluid Management’ বা তরল ব্যবস্থাপনা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পাদনের জন্য বুয়েট বিএমই ও সরকারের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত ‘ডেঙ্গুড্রপস’ অ্যাপের টেকনিক্যাল লীড হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করি। গবেষক হিসাবে এটি আমার জীবনে একটি বিরল অভিজ্ঞতা।
মুলত বলা যায়, I am a traveler on many paths of Bioengineering. তাই উপরোল্লিখিত কাজের পাশাপাশি আমি ওয়েট ল্যাব টেকনোলজিস, সেল কালচার, এনিমেল মডেলস এবং স্মার্ট ম্যাটেরিয়াল বিষয়ক কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, যা আমার কাজে একটি অনন্য ও বহুমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসে। আমি স্বপ্ন দেখি ভবিষ্যতে স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে AI একীভূত করে ক্যান্সার গবেষণায় দ্রুত অগ্রগতি আনার, উন্নত বায়োমার্কার ও থেরাপিউটিক্স উদ্ভাবন করার ।
আপনার গবেষনার কাজগুলি কিভাবে আমাদের উপকৃত করছে?
একজন বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আমার সকল গবেষণা মানুষের স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে নিবেদিত। আমার তৈরি কৃত্রিমবুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির সিস্টেমগুলো মেডিকেল ইমেজিং, সিগন্যাল প্রসেসিং এবং mHealth প্রযুক্তিতে একীভূত করা হচ্ছে, যা রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা পদ্ধতিকে দ্রুত, নির্ভুল এবং উন্নত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। উদাহরণস্বরূপ, হৃদযন্ত্রের শব্দের রিয়েল-টাইম ডিনোইজিং নিয়ে আমার গবেষণাকর্মটি কার্ডিওভাস্কুলার এবং শ্বসনযন্ত্রজনিত রোগগুলির প্রাথমিক সনাক্তকরণে বিশেষ সহায়ক হচ্ছে। এটি বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রত্যন্ত অঞ্চলের অপ্রতুল স্বাস্থ্যসেবা পরিবেশেও ব্যবহারোপযোগী এবং কার্যকরী , যা অসংখ্য মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে।
এছাড়াও AI এবং ওয়েট ল্যাব একই সাথে ব্যবহার করে বায়োমেডিক্যাল অ্যাপ্লিকেশনগুলোর মধ্যে যে সেতুবন্ধন তৈরি করতে আমি বদ্ধপরিকর, তা সর্বোপরি রোগীদের উন্নত সেবা এবং আরও কার্যকরী চিকিৎসা পদ্ধতি নিশ্চিত করবে বলে আমি বিশ্বাসী।
একজন বিজ্ঞানীর কি কি গুণ থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন?
একজন বিজ্ঞানীর মধ্যে 3C (Curiosity, Critical Thinking, Creativity) অর্থাৎ কৌতুহল, ক্রিটিক্যাল থিংকিং, এবং সৃজনশীলতার সমন্বয় থাকা জরুরি বলে আমি মনে করি। কৌতুহল একজন ব্যক্তিকে বিশ্বের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে গভীর প্রশ্ন করতে উদ্বুদ্ধ করে, আর ক্রিটিক্যাল থিংকিং সহায়তা করে ডেটা বিশ্লেষণ এবং কোনো হাইপোথিসিসের সম্ভাব্যতা যাচাই করতে । সৃজনশীলতা নতুন সমাধান উদ্ভাবন এবং বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অপরিহার্য। এছাড়াও, অধ্যবসায়, ধৈর্য এবং সুষ্ঠ কর্মনীতি বিজ্ঞানীদেরকে চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে সাহায্য করে, এবং ইফেক্টিভ কমিউনিকেশন ক্যাপাবিলিটি তাদের উদ্ভাবন ও আবিষ্কারগুলো বৃহত্তর সম্প্রদায়ের সামনে প্রকাশপূর্বক মানব কল্যাণ সাধনে সহায়তা করে।
বাংলাদেশের তরুণ শিক্ষার্থী যারা বিজ্ঞানে কাজ করতে চায় – তাদের জন্য আপনার কোন ম্যাসেজ কিংবা বার্তা কি?
পঞ্চম শ্রেণিতে পড়েছিলাম একটি উক্তি, “There is no alternative to hard work and there is no shortcut to success.” ব্যক্তিগত জীবনে আমার মূলমন্ত্র এটাই। তাই বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য আমার বার্তা হলো: খুব দ্রুত খ্যাতি, বিত্ত-বৈভব বা অন্য কোনো কিছু পাওয়ার আশায় নয়, লব্ধ জ্ঞানকে “জ্ঞান”-এর স্বার্থেই ভালোবাসুন। নিজের কৌতূহলকে জাগ্রত রাখুন এবং সাহস করে নতুন কিছু শিখতে আগ্রহী হোন। আন্তরিকভাবে পরিশ্রম করুন, সৃজনশীল থাকুন, এবং অন্যদের সহযোগিতা করতে শিখুন। জ্ঞান অর্জন করুন, নিজের অনন্য গুণাবলিকে এপ্রিসিয়েট করুন, নিজেকে অন্যের সাথে তুলনা না করে চেষ্টা চালিয়ে যান, নিজের দেশ ও পৃথিবীর জন্য ভালো কিছু করতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ থাকুন।
বিজ্ঞান একটি চ্যালেঞ্জিং কিন্তু অসাধারণভাবে পুরস্কৃতকারী ক্ষেত্র, যেখানে আপনার জিজ্ঞাসু মন এবং সৃজনশীল চিন্তাধারা আপনাকে অনেক দূর নিয়ে যেতে পারে। এটি এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে প্রতিদিন কিছু না কিছু নতুন শেখার সুযোগ আছে। এখানে ব্যর্থতা কোন শেষ কথা নয়, বরং শেখার একটি ধাপ। প্রতিটি ভুল বা ব্যর্থতা থেকে আপনি নতুন কিছু শিখবেন যা আপনাকে পরবর্তীতে আরও ভালো করতে সহায়ক হবে।সর্বোপরি, সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ কামনা করুন, এবং ধৈর্য ধরে লেগে থাকুন – সাফল্য আসবেই ।
লিংকডইন এর লিংক
https://www.linkedin.com/in/shams-nafisa-ali/
আপনার ওয়েবসাইট, গবেষনাকাজের লিংক ইত্যাদি
(1) https://scholar.google.com/citations?user=JqajiA4AAAAJ&hl=en&oi=ao
(2) https://www.researchgate.net/profile/Shams-Nafisa-Ali
শামস নাফিসা আলী কে সাক্ষাৎকারটি দেবার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি এবং আমরা তার সুন্দর ভবিষ্যত কামনা করছি।
Leave a comment