বিজ্ঞানী.অর্গ এ আমরা দেশ বিদেশে থাকা বিজ্ঞানীদের সাথে বাংলাদেশের পাঠকদের সাথে পরিচয় করে দিই। বিজ্ঞানী.অর্গ এর পক্ষ থেকে ড. মশিউর রহমান কথা বলেছেন আমারেকায় বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশী বিজ্ঞানী ড. মনঞ্জুর আহমেদ এর সাথে।
বিজ্ঞানী.অর্গ: ধন্যবাদ ড. মনঞ্জুর আহমেদ আমাদের সময় দেবার জন্য। আলাপের শুরুতেই আমরা আপনার পরিচয় জানতে চাই।
ডা. মঞ্জুর: আমি বর্তমানে আমি গ্যাস্ট্রোএন্ট্রোলজি বিভাগে (টারশিয়ারি মেডিকেল কেয়ার সেন্টারে) একাধারে একজন চিকিৎসক, অধ্যাপক এবং গবেষক হিসেবে নিযুক্ত আছি। এর সাথে আমি (ওয়ার্ল্ড জার্নাল অফ গ্যাস্ট্রো অনকোলজি) এর জন্য (এডিটর-ইন-চিফ ) হিসেবে কাজ করছি।
বিজ্ঞানী.অর্গ: আমরা আপনার বর্তমান অবস্থান জানলাম যে আপনি একজন ডাক্তার এবং গবেষক। আপনার শৈশব এর কথা বলুন?
ডা. মঞ্জুর: আমার শৈশব কাটে ঈশ্বরদী, পাবনায়। আমার স্কুল ছিল এলাকার সবচেয়ে পুরনো নামকরা স্কুল, এস এম হাই স্কুল। সেখান থেকে প্রত্যেক বছরই অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী মাধ্যমিক পড়াশোনা শেষ করে বের হয়। আমার সময়টাতে ফলাফল ভালো হওয়ায় বাবার ইচ্ছা ছিল যাতে ডাক্তার হতে পারি। কিন্তু মেট্রিক পাশ করার পরে আমেরিকা আসার চেষ্টা শুরু করি, সুযোগ ও হয় ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর। সেই সময় আর্থিক বিষয়ে চিন্তা করে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এরপরে দেশেই পড়াশোনা শেষ করার ইচ্ছা থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হই। ঢাকা মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস পাস করি এবং সেখানেই ইন্টার্নশিপ শেষ করি। পরবর্তীতে বাবার ইচ্ছায় এমআরসিপি ডিগ্রী অর্জন করতে ইংল্যান্ডের রয়াল কলেজ অফ এডিনবার্গে ভর্তি হই। এমআরসিপি ট্রেনিং শেষ হয় ১৯৯০ সনে। সেখান থেকে আমেরিকায় এসে কর্মসংস্থানে যোগ দিই।
বিজ্ঞানী.অর্গ: আপনার চিকিৎসা বিজ্ঞানের কোন বিষয়ে বিশেষায়ত্ব রয়েছে?
ডা. মঞ্জুর: আমি চিকিৎসাবিজ্ঞানের গ্যাস্ট্রোএন্ট্রোলজি নিয়ে কাজ করছি।
বিজ্ঞানী.অর্গ: এই বিভাগটি শরীরের কোন বিষয় নিয়ে কাজ করে? এই বিষয়ে আপনার আগ্রহ বেশি হওয়ার কারণ কি?
ডা. মঞ্জুর: এটি মূলত মানব দেহের খাদ্যনালী নিয়ে কাজ করে। মানব শরীরের গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ট্রাক (গলব্লাডার, প্যানক্রিয়াস ইত্যাদি) এ বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। এই রোগ নিরাময়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনেক সফল অস্ত্রোপচার ব্যবস্থাগুলো ব্যবহার করা হয়। যেমন, এন্ডোস্কোপি কোলোনোস্কোপি, লিভার ট্রান্সপ্লান্ট, গলব্লাডার ট্রানস্প্লান্ট, প্যানক্রিয়াস অপারেশন, কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট ইত্যাদি। এই বিষয়ে আগ্রহ তৈরি হওয়ার অন্যতম কারণ হলো বাংলাদেশি মানুষদের রোগের ধরন। মেডিকেলে পড়াশোনা করতে গিয়ে দেখলাম পড়তে গিয়ে দেখলাম রোগের মধ্যে গ্যাস্ট্রোলজির সমস্যা অনেক বেশি। এর জন্য মূলত আমাদের খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপনের ধরণ দায়ী।
এছাড়াও চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই বিভাগের রোগ এবং রোগের ব্যবস্থাপনা সবচেয়ে ফলপ্রসূ। ব্যক্তিগত দিক থেকে বলতে গেলে এই বিভাগ নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিজীবনের উন্নতিতে সহায়তা করে। গ্যাস্ট্রোএন্ট্রোলজি মানবদেহের খুব গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ নিয়ে কাজ করে। এতে কেবল শরীরের একটি অঙ্গ নয় অনেক অঙ্গ নিয়ে আলোচনা হয়। এর চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির সম্ভাবনা অনেক বেশি। চিকিৎসা ক্ষেত্রে অন্য বিষয়গুলোতে অনুশীলন করতে হাসপাতালের উপর নির্ভরশীল থাকতে হয়, কিন্তু গ্যাস্ট্রোএন্ট্রোলজি তে নিজে নিজে রোগ, রোগের ধরন ও এর নিরাময় সম্বন্ধে অনুশীলন করা যায়।
বিজ্ঞানী.অর্গ: একজন ডাক্তার হিসেবে আপনার কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু জানার আছে। তবে যেমনটা আমরা প্রথমেই বলেছি আমাদের চেষ্টা হচ্ছে আপনাদের অভিজ্ঞতা গুলো বাংলাদেশের সেসব শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেয়া যারা বিজ্ঞান বিষয়ে উচ্চশিক্ষা ও অগ্রগতি নিয়ে ভাবছে। সে সকল শিক্ষার্থীর আত্মবিশ্বাস বাড়াতে আপনার গবেষণা সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
ডা. মঞ্জুর: গবেষণা হলো এক ধরনের ট্রেনিং প্রোগ্রাম। যারা এতে অংশ নেয় তাদেরকে “ফেলো” বলা হয়। ট্রেইনিদের নিজেদের রিসার্চ সম্পন্ন করতে যথার্থ নির্দেশনা দেয়া হয়। এর পরে তারা নিজেদের অনুধাবন গুলো লিখে প্রকাশ করে এবং তা পর্যাপ্ত যাচাই করে বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশ করা হয়।
আমি শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় থাকার কারণে এই ধরনের ট্রেনিং প্রোগ্রাম গুলো পরিচালনা করতে হয়। এক্ষেত্রে আমার কিছু জব ডেস্ক্রিপশন জমা দিতে হয়। যেমন-
ট্রেইন এন্ড টিচ দা ফেলোজ: এখানে স্পেসিফিক ট্রেনিং প্রোগ্রাম আছে যাতে কোন রোগী ইন্টেস্টাইনাল প্রবলেমস যেমন জন্ডিস, ডায়রিয়া, কোলাইটিস, প্যানক্রিয়াটাইটিস প্রবলেম নিয়ে আসলে তা কিভাবে নিরাময় করা সম্ভব তা অনুশীলন করানো হয়। এই ধরনের টিচিং এর জন্য কারিকুলাম আছে। যাতে কি কি বিষয়ের উপর লেকচার দেয়া লাগবে অথবা ট্রেইন করা লাগবে সেটা উল্লেখ থাকে। এইভাবে একজন ট্রেইনি তিন বছর পর একজন গ্যাস্ট্রোলজিস্ট হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে থাকেন।
রিসার্চ: এই ধরনের প্রোগ্রামের জন্য কতগুলো টপিকস ঠিক করা হয় ন্যাশনাল মিটিং গুলোতে যা বছরের শুরুতেই পরিকল্পনায় থাকে।
ক্লিনিক্যাল কেয়ার: এক্ষেত্রে ট্রেনিং সেন্টারের ক্লিনিক নিয়মিত রোগীদের নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়। কিন্তু গবেষণা চিকিৎসা কেন্দ্র গুলোতে শুধুমাত্র কম্প্লেক্স কেসেস যেগুলো অন্য হাসপাতালের ডাক্তারগণ নিরাময় করতে পারছেন না তখন রেফার করেন। এতে করে গবেষণা ইনস্টিটিউট মেম্বারগন রোগের লক্ষণগুলো পর্যালোচনা করে ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করেন।
একজন ফ্যাকাল্টি মেম্বার হিসেবে উপরিউক্ত বিষয়গুলো আমাকে প্রতিনিয়ত খেয়াল রাখতে হয়।
পাবলিকেশন: গবেষণার প্রকাশনা যত বেশি হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান ততো বাড়ে। গবেষণা ক্ষেত্রে প্রত্যেক বছরই কিছু ন্যাশনাল ও ইন্টারন্যাশনাল লেকচারস এর জন্য প্রস্তুতি রাখতে হয়। প্রায় প্রতিবছরই ন্যাশনাল কনফারেন্স এ রিসার্চ পেপার প্রেজেন্ট করতে হয়।
বিজ্ঞানী.অর্গ: আপনি বর্তমানে কোন বিষয়ের উপর গবেষণা করছেন?
ডা. মঞ্জুর: বর্তমানে রিসার্চ করছি গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল এন্ড হেপাটোবিলিয়ারি কন্ডিশনস অফ মেডিকেল স্টুডেন্টস এ। ইয়ং মেডিকেল স্টুডেন্টদের ইন্টেস্টাইনাল কি ধরনের সমস্যা যেমন প্যানক্রিয়াটাইটিস, আলসার ব্লিডিং ইত্যাদি আছে তা নির্ধারণ ও নিরাময় সম্বন্ধে।
বিজ্ঞানী.অর্গ: গবেষণা সম্বন্ধীয় তথ্য গুলো কিভাবে সংগ্রহ করেন?
ডা. মঞ্জুর: গবেষণার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্লিনিক্যাল রিসোর্স ব্যবহার করা হয়। উদাহরণ স্বরূপঃ বিগত কয়েক বছরে যদি 5000 রোগী আমরা দেখে থাকি,তাদের কি সমস্যা ছিল, সেটা কি ধরনের রোগের লক্ষণ এবং নিরাময় ব্যবস্থাপনার দেয়া হয়েছিল তার ফল কেমন পাওয়া গেছে ইত্যাদি। এছাড়াও বিভিন্ন সময় পরিবেশ অনুযায়ী জনগণের কাছ থেকেও তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এই সকল তথ্য আইআরবি (ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ ব্যুরো) তে অ্যাপ্রভাল এর জন্য দেওয়া হয় এবং পরবর্তীতে তা বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়।
বিজ্ঞানী.অর্গ: কি কি এডভান্স প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন? নতুন ওষুধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করে থাকেন?
ডা. মঞ্জুর: হ্যাঁ, ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয়ে থাকে। কিছু মাল্টি ইনস্টিটিউশনস একসাথে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের কাজগুলো করে থাকে যাতে করে তথ্যগুলো সঠিক কিনা যাচাই করতে সুবিধা হয়। এছাড়াও মেডিকেল সাইন্স এর নতুন কোন টেকনোলজি আবিষ্কার হলে ফাইনাল ট্রায়াল ও অ্যাপ্রভালের জন্য আমাদের কাছে আসে। বিভিন্ন ধরনের ফার্মেসিউটিক্যাল কম্পানি প্রমোশনের করতে তাদের ড্রাগ এর ট্রায়াল এর জন্য আমাদের সাথে যোগাযোগ করে এবং যদি মানসম্মত হয় তবেই আমরা প্রচারণা করি।
বিজ্ঞানী.অর্গ: আপনি দীর্ঘদিন যাবত ইংল্যান্ডে ছিলেন এবং বর্তমানে আমেরিকায় আছেন। এই দুই দেশের কি ধরনের পার্থক্য চোখে পড়েছে?
ডা. মঞ্জুর: প্রত্যেকটা জায়গাতেই কিছু সুবিধা অসুবিধা থাকে। আমি ইংল্যান্ডের বিভিন্ন শহরে 1986 থেকে 1990 পর্যন্ত উচ্চতর ডিগ্রী অর্জনের জন্য বসবাস করেছি। তারপরে আমেরিকায় এসে অবস্থান করছি। সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত আমেরিকা প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে এগিয়ে।
এছাড়াও তখনকার সময়ে ইংল্যান্ডে পুরোপুরি হোয়াইট পপুলেশন ছিল, বিদেশি খুব কমই চোখে পড়তো। কিন্ত আমেরিকা মাল্টিকালচারাল হওয়ায় এখানে শুরুর থেকেইবিদেশি যেমন ইন্ডিয়ানস, ফিলিপিনোস, কম্বোডিয়ান বাস করে। একজন ডাক্তার হিসেবে এই পার্থক্যটি অনেক বেশী পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছি কারণ জাতি এবং সমাজ বিশেষে রোগের ধরন ভিন্ন হয়ে থাকে।
ইংল্যান্ডের ক্লিনিক্যাল কেয়ার অনেক গুছানো ছিল কিন্তু আমেরিকাতে সেটা ছিল না।
বিজ্ঞানী.অর্গ: একাধারে চিকিৎসা এবং গবেষণার কাজে নিযুক্ত আছেন যা সচরাচর দেখা যায় না। এক্ষেত্রে আপনার দর্শন কি?
ডা. মঞ্জুর: গবেষণা ছাড়া একাডেমিক অ্যাক্টিভিটি কখনোই সঠিকভাবে উপযুক্ত হয় না। গবেষণার ক্ষেত্রে কোন একটি প্রজেক্ট শুরু করতে হলে সে বিষয়টি নিয়ে অনেক বেশি পড়তে হয় এবং সেই সাথে বিষয়টির পরিবেশ নিয়ে পর্যালোচনা করতে হয়।যাতে করে যেকোনো বিষয়ে একজন মানুষের জ্ঞান পাকাপোক্ত হওয়া সম্ভব। একাডেমিক ক্ষেত্রে গবেষণা ছাড়া অনেক বড় ঘাটতি থেকে যায়। বিশেষ করে চিকিৎসা বিজ্ঞানে কোনো একটি বিষয়ে বিশেষায়ত্ত্ব অর্জন করতে গবেষণার কোন বিকল্প নেই।
বিজ্ঞানী.অর্গ: জীবনে সফলতার এই পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে আপনার উপদেশ কি?
ডা. মঞ্জুর: জীবনে সবসময় আশাবাদী এবং কঠোর পরিশ্রমী থাকতে হবে। যদি কেউ একটি সঠিক লক্ষ্য নির্ধারণ করে এবং সে অনুযায়ী অথর পরিশ্রম করে, সেই লক্ষ্যে অবশ্যই পৌঁছাবে। আমার উপদেশ হল- কখনও হাল ছেড়ো না।
ধন্যবাদ: লেখাটি কম্পোজ করার জন্য জয়নাব বিন্তে আলী কে ধন্যবাদ।
রেফারেন্স
ধন্যবাদ এরকম একজন বিখ্যাত লোকের জীবনী আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য
অনেক তথ্যপূর্ণ লিখুনী