বিশ শতকের শুরুর দিকে এক বর্ষণমুখর দিনে তরুণ বিজ্ঞানী মারি ক্যুরি গবেষণাগারে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়েছেন। বাইরে ছিল ঠাণ্ডা, ভেতরে অন্ধকার কক্ষে তিনি ছোট একটি আলোর আভায় বারবার পরীক্ষা করছেন, যা থেকে একদিন মানবজাতি পেল একটি নতুন মৌল, রেডিয়াম। মারি ক্যুরি এবং তাঁর স্বামী পিয়েরে ক্যুরি এই গবেষণার জন্য দুই টন খনিজ পদার্থ পরিশোধন করেন, যা থেকে মাত্র এক দশমিক এক গ্রাম বিশুদ্ধ রেডিয়াম উৎপন্ন হয়েছিল। দুই টন থেকে এক গ্রাম—ভাবতেই বিস্ময় জাগে, কিন্তু এই ‘পাগলামি’ থেকেই আসে যুগান্তকারী আবিষ্কার।
তাহলে কেন বিজ্ঞানীরা এমন কঠোর পরিশ্রম করেন, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কাটান সামান্যতম ডেটার আশায়? গবেষণার পেছনে কী এমন আকর্ষণ, যা বিজ্ঞানীদের সারাজীবন জুড়ে রাখে?
বিজ্ঞানীদের মনোভাব বুঝতে গেলে প্রথমেই তাদের অনুসন্ধিৎসু মানসিকতার কথা আসবে। তাঁরা সবসময়ই জানার জন্য আগ্রহী। আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছেন, “আমি অত্যন্ত মেধাবী নই, আমার মধ্যে কেবল অসীম কৌতূহল রয়েছে।” এ অসীম কৌতূহলই বিজ্ঞানীদের দীর্ঘ গবেষণার পথে চালিত করে।
২০১৫ সালে মার্কিন ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, ৯৩ শতাংশ বিজ্ঞানী তাদের কাজ করেন মূলত নতুন কিছু আবিষ্কারের আনন্দ ও উত্তেজনার জন্য। আর্থিক পুরস্কার বা স্বীকৃতি তাদের প্রধান চালিকাশক্তি নয়। এই তথ্যই বোঝায়, বিজ্ঞানীরা আসলে ‘পাগল’ নন; তারা অনুসন্ধানের আনন্দকে গুরুত্ব দেন, যা সাধারণ চোখে প্রায়ই বোঝা যায় না।
আরেকটি উদাহরণ নেওয়া যাক। ২০১২ সালে হিগস বোসনের সন্ধান পেতে লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে হাজার হাজার বিজ্ঞানী কাজ করেছেন। দশকের পর দশক ধরে চলে তাদের গবেষণা। অথচ শেষমেশ যে হিগস বোসনের অস্তিত্ব নিশ্চিত হয়েছিল, তার জীবনকাল মাত্র এক সেকেন্ডের এক ট্রিলিয়ন ভাগেরও কম। এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র তথ্যের পেছনে ছিল এক বিশাল দলবদ্ধ গবেষণার পাগলাটে চেষ্টা। কিন্তু এই ‘ক্ষুদ্র’ আবিষ্কারই পদার্থবিজ্ঞানের অনেক রহস্যের দরজা খুলে দিয়েছে, যার ফলে বিজ্ঞানীরা এখন মহাবিশ্বের গঠনকে আরও গভীরভাবে বুঝতে পারছেন।
গবেষণার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যগুলো হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে অর্থবহ মনে না হতে পারে, কিন্তু এসব ছোট ছোট ডেটা যখন একত্রিত হয়, তখন তা একটি বৃহত্তর ছবি তৈরি করে। ঠিক যেমনটি ঘটেছে পেনিসিলিন আবিষ্কারের ক্ষেত্রে। আলেকজান্ডার ফ্লেমিং ১৯২৮ সালে পেনিসিলিন আবিষ্কার করেন দুর্ঘটনাবশত, একটি ভুল থেকে। এই ছোট ‘ভুল’ পরবর্তীতে কোটি কোটি মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। এক সময় যেটা পাগলামি মনে হয়েছিল, আজ সেটাই আধুনিক চিকিৎসার অন্যতম ভিত্তি।
বিজ্ঞানীদের গবেষণার আরেকটি বড় কারণ হল তাদের দায়িত্ববোধ। তারা জানেন, তাদের কাজের মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব। গবেষণা মানবসভ্যতার অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করে, জীবনমান উন্নত করে। বিশ্বব্যাংকের ২০২০ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গবেষণা এবং উদ্ভাবনের ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে গত পাঁচ দশকে অন্তত দ্বিগুণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অর্থাৎ, বিজ্ঞানীরা সমাজের নিরন্তর উন্নয়নের নীরব কারিগর।
তবে বিজ্ঞানীরা কেবল তথ্য কিংবা ফলাফলের জন্য গবেষণা করেন না, তারা করেন সত্য ও সৌন্দর্যের সন্ধানে। বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যানের ভাষায়, “বিজ্ঞান হচ্ছে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করার একটি পথ।” এই সৌন্দর্য অনুসন্ধানের তীব্র আকাঙ্ক্ষাই তাদেরকে নতুন নতুন অজানা পথের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
শেষমেশ, বিজ্ঞানীরা আসলে পাগল নন, বরং তারা এমন এক আদর্শের পাগল, যেখানে প্রশ্ন করার স্বাধীনতা আছে, অজানাকে জানার সাহস আছে, এবং সত্যকে উন্মোচনের জন্য নিরলস প্রচেষ্টা আছে। এই উন্মত্ততাই মানবজাতিকে দেয় জ্ঞান, দেয় শক্তি, এবং দেয় এগিয়ে যাওয়ার সাহস।
আপনিও কি সেই পাগলদের একজন হতে চান?
Leave a comment