স্বাস্থ্য ও পরিবেশ

উদ্দীপনার খেলাঘর

Share
Share

                                                 অধ্যায় – ৩ (ঘুমের দেশে)

 

নিদ্রাবস্থা (স্টেট অফ স্লিপ): নিদ্রাবস্থা  দুটি প্রধান দশায় (ফেজ) বিভক্ত – নন্  রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ ও রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ।  একটি নন্ রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ এর পর আসে রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ।  রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ এর শেষে আসে আরেকটি  নন্ রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ।  মানুষের ঘুম কতগুলি রাউন্ড বা সাইকল্-এ ঘটে। একটি নন্ রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ ও তারপর একটি রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ নিয়ে একটি নব্বই মিনিটের সাইকল্ সম্পূর্ণ হয়।  ঘুমোতে শুরু করার পর যত বেশী সংখ্যক সাইকল্ অতিবাহিত হয়, একটি নব্বই মিনিটের সাইকল্-এ রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ এর সময়সীমা ক্রমশ বাড়তে থাকে।

নন্ রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ – এই দশাটি মোট তিনটি স্টেজ বা উপদশায় বিভক্ত।

প্রথম উপদশা –

টেম্পোরাল লোবের ঠিক নীচে মস্তিষ্কের দুটি “হিপ্পোক্যাম্পাস” নামক অংশ থাকে। এই উপদশায় চোখের পাতা বন্ধ হলেও, মস্তিষ্কের ভিসুয়াল কর্টেক্স-এর কাছে অবস্থিত নিউরাল লুপটি যা দৃষ্টি সম্বন্ধীয় তথ্যের শর্ট টার্ম মেমোরি হিসাবে কাজ করে, হিপ্পোক্যাম্পাসে লং টার্ম মেমোরি-র জন্য উপযুক্ত ভিসুয়াল ডেটা পাঠাতে শুরু করে ও তাই নিউরাল লুপটির নিউরোন বা স্নায়ুকোষগুলি সক্রিয় থাকায় তা প্রায়শই  চোখের টনিক পেশীকে (টনিক মাসল্)  কম হারে কিন্তু অনেক সময় ধরে  উদ্দীপিত (স্টিমুলেট্)  করে যার ফলে চোখের এক ধীর গতির চলন (মুভমেন্ট)  লক্ষ করা যায়। সতর্ক জাগ্রত অবস্থা থেকে  নন্ রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ এর এই প্রথম উপদশায় উপনীত হলে, শর্ট টার্ম মেমোরি  থেকে আসা ভিসুয়াল ডেটা গ্রহণ করে হিপ্পোক্যাম্পাস উদ্দীপিত হয় ও উচ্চতর (হায়ার)  কম্পাঙ্কের থিটা তরঙ্গ বা হিপ্পোক্যাম্পাল থিটা তরঙ্গ নির্গত করতে শুরু করে যা মস্তিষ্কে মানুষটির নিজের বর্তমান অবস্থান (কারেন্ট স্পেশিয়াল লোকেশন)  এর ধারণা রাখতে সাহায্য করে।

মানুষের মিডব্রেইন এর মধ্যরেখার কাছাকাছি কতগুলি নিউরোন বা স্নায়ুকোষের একটি দল দেখা যায় যার নাম “ভেন্ট্রাল টেগমেন্টাল এরিয়া”। এই দলের ডোপামিনারজিক নিউরোন বা ডোপামিন নিউরোট্রান্সমিটার উৎপাদনকারী স্নুকোষগুলি নিষ্ক্রিয় অবস্থা থেকে সক্রিয় হয়ে উঠলে তবে আমাদের ঘুম ভাঙে। নন্ রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ এর প্রথম উপদশায় ভেন্ট্রাল টেগমেন্টাল এরিয়া-র ডোপামিনারজিক নিউরোনগুলি সাধারণত অল্প হলেও সক্রিয় থাকে ও তাই নিদ্রার এই উপদশা থেকে জেগে যাওয়া ব্যক্তি অনেক সময় মনে করেন যে তিনি জেগেই ছিলেন।

মস্তিষ্কের মোটর কর্টেক্স, সেরিবেলাম, বেসাল গ্যাংলিয়া, পেডাঙ্কিলোপন্টাইন নিউক্লিয়াস (স্নায়ুবিজ্ঞানে নিউক্লিয়াস হলো কতগুলি স্নায়ুকোষের এমন জটলা যেখানে সবকটি স্নায়ুকোষ প্রায় একই ধরনের কাজে ব্যবহৃত হয়), রেড নিউক্লিয়াস ও সাবকর্টিকাল মোটর নিউক্লিয়াসগুলি  বিভিন্ন মোটর নিউরোনের সাহায্যে আমাদের স্কেলেটাল পেশীগুলিকে ও গ্রন্থিগুলিকে (গ্ল্যান্ড)  প্রয়োজনমত উদ্দীপিত করে।  পেশীর এই উদ্দীপনা প্রধানত দু রকমের – মাসল্ টোন ও মাসল্ টেন্শন।  কোন কিছু ওঠানো, নামানো, ঠেলা বা টানার জন্য পেশীর স্থিতিস্থাপকতা (ফ্লেক্সিবিলিটি)  অপেক্ষা শক্তি (স্ট্রেংথ্)  অনেক বেশী প্রয়োজন।  তখন মাসল্ টেন্শন বেশী প্রয়োজনীয়।  কিন্তু স্বাভাবিকভাবে দাঁড়ানো বা হাঁটার সময় সম্পূর্ণ দেহের ভারসাম্য (ব্যালান্স)  রক্ষার জন্য কিংবা শোয়ার সময় মস্তিষ্কের শক্তিব্যয় কমানোর জন্য, হাত ও পায়ের পেশীতে শক্তি কমিয়ে স্থিতিস্থাপকতা বাড়ানো হয় অর্থাৎ পেশীতে মাসল্ টোন প্রকৃতির উদ্দীপনা পাঠানো হয়ে থাকে এবং প্রধানত মস্তিষ্কের সেরিবেলাম এই উদ্দীপনা পাঠায়। এছাড়াও সেরিবেলাম নাসারন্ধ্র থেকে ল্যারিংসের ভোকাল ফোল্ড এর আগে পর্যন্ত শ্বাস বায়ুর চলাচলের পথে (আপার এয়ারওয়ে)  যতগুলি পেশী আছে তাদের মাসল্ টোন পাঠিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে ও শ্বাসবায়ুকে নির্দিষ্ট রৈখিক (লিনিয়র্) পথে চালনা করে শ্বাসকার্যে (প্রশ্বাস ও নিঃশ্বাস)  সাহায্য করে। ঘুমের শুরুতে অর্থাৎ প্রথম নন্ রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ এর প্রথম উপদশা যখন শুরু হয়, সেরিবেলাম শ্বাসকার্যে (রেস্পিরেশন)  নিজের শক্তিব্যয় কমানোর জন্য, আপার এয়ারওয়ে-র পেশীগুলিতে মাসল্ টোন কমাতে শুরু করে (আপার এয়ারওয়ে-র পেশীগুলিতে কম মাসল্ টোন থাকার জন্যই নন্ রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ-এ আপার এয়ারওয়ে-তে শ্বাসবায়ুর প্রবাহ খুব একটা রৈখিক হয় না ও সেই বায়ুপ্রবাহ এয়ারওয়ে-র দেওয়ালে ধাক্কা খায় বেশী। তাই সকল মানুষেরই শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ স্বাভাবিকের তুলনায় বেশী হয় যাকে আমরা “নাক ডাকা” বলি) ও তারফলে সেরিবেলাম থেকে হাত বা পায়ের কোন কোন পেশীতে অনেক সময় মুহূর্তের জন্য স্বাভাবিক অপেক্ষা বেশী মাসল্ টোন প্রেরিত হয় [কারণ, মানুষের জাগ্রত অবস্থায়, সেরিবেলাম সাধারণত প্রতি একক সময়ে ধ্রুবক (কন্সট্যান্ট)  পরিমাণ শক্তিব্যয় করতে অভ্যস্ত]।  তখন আমরা পেশীটিতে এক ঝাঁকুনি অনুভব করি বা আমাদের মধ্যে “পতন” বা “পড়ে যাওয়া”-র অনুভূতি জন্ম নেয় যার প্রভাবে আমরা পুনরায় জাগ্রত অবস্থায় ফিরে যাই। এই অনুভূতি “হিপ্নিক জার্ক” নামে খ্যাত।

দ্বিতীয় উপদশা –

এই উপদশায় চোখের কোনরূপ চলন দেখা যায় না। এই সময়, থ্যালামিক রেটিকিউলার নিউক্লিয়াস এবং অন্যান্য থ্যালামিক নিক্লিয়াসগুলির পারস্পরিক ক্রিয়ায় মাঝে মাঝে প্রায় ১০ – ১২ হার্ৎজ কম্পাঙ্কের স্বল্পস্থায়ী (অন্তত ০.৫ সেকেন্ড) এক তরঙ্গ উৎপন্ন হয় যাকে “স্লিপ স্পিন্ডিল্স” বা “সিগ্মা ওয়েভ্স” নামে ডাকা হয়।

দ্বিতীয় উপদশায় স্লিপ স্পিন্ডিল্স ছাড়াও প্রতি ১ – ১.৭ মিনিটে দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের (ওয়েভলেঙ্থ) “ডেল্টা তরঙ্গ” (কম্পাঙ্ক ১.৬ – ৪.০ হার্ৎজ) দেখা যায় যা এক সেকেন্ড মত স্থায়ী হয়। এই ডেল্টা তরঙ্গগুলির এক একটিকে “কে-কম্প্লেক্স” বলা হয়।

নন্ রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ-র এই দ্বিতীয় উপদশায় প্রায়ই কে-কম্প্লেক্স তরঙ্গ উৎপন্ন হওয়ার ঠিক পরেই স্লিপ স্পিন্ডিল্স বা সিগ্মা ওয়েভ্স আবির্ভূত হয়।  কে-কম্প্লেক্স তরঙ্গের মাধ্যমে মস্তিষ্কের শর্ট টার্ম মেমোরিতে সঞ্চিত প্রধানত শব্দ ও ভাষা সংক্রান্ত তথ্যগুলি হিপ্পোক্যাম্পাস-এ আসে।  হিপ্পোক্যাম্পাস সংগ্রহীত শব্দ, ভাষা ও দৃষ্টি সংক্রান্ত তথ্যগুলির মধ্যে কোনগুলি প্রোসিডিউরাল লং টার্ম মেমোরি (পদ্ধতিগত দীর্ঘ মেয়াদী স্মৃতি) ও কোনগুলি ডিক্ল্যারেটিভ লং টার্ম মেমোরি (ব্যক্ত দীর্ঘ মেয়াদী স্মৃতি)-র জন্য উপযুক্ত তা নির্বাচন (সিলেক্ট)  করে, নির্বাচিত কিছু ডিক্ল্যারেটিভ লং টার্ম মেমোরি -র জন্য উপযুক্ত তথ্যকে এনকোড্ (সংকেতাক্ষরে লিখন)  করে এবং নির্বাচিত সকল প্রোসিডিউরাল লং টার্ম মেমোরি -র জন্য উপযুক্ত তথ্যকে কনসলিডেট (সমন্বয়সাধন)  করে।  তারপর এনকোডেড্ হওয়া  ডিক্ল্যারেটিভ লং টার্ম মেমোরি-র জন্য উপযুক্ত তথ্যগুলি স্লিপ স্পিন্ডিল্স তরঙ্গ বা সিগ্মা ওয়েভ্স এর মাধ্যমে টেম্পারাল কর্টেক্স-এ আসে আর এনকোডেড্ না হওয়া তথ্যগুলি (ডিক্ল্যারেটিভ লং টার্ম মেমোরি-র জন্য উপযুক্ত)  সিগ্মা ওয়েভ্স-র মাধ্যমেই এনটোরাইনাল ও পেরিরাইনাল কর্টেক্সে আসে।  এছাড়াও প্রোসিডিউরাল লং টার্ম মেমোরি -র জন্য উপযুক্ত কনসলিডেটেড্ সকল তথ্যসমূহ সিগ্মা ওয়েভ্স এর সাহায্যে হিপ্পোক্যাম্পাস থেকে সেরিবেলাম, পুটামেন, কডেট নিউক্লিয়াস ও মোটর কর্টেক্সে আসে।

এই প্রসঙ্গে ডিক্ল্যারেটিভ লং টার্ম মেমোরি ও প্রোসিডিউরাল লং টার্ম মেমোরি কি তা বলে নিই। তুমি তিন-চার বছর বা তারও আগে যে সিনেমাটি দেখেছ তার বিষয়বস্তু অথবা কোথাও বেড়াতে গিয়ে তুমি কি কি করেছ বা কি কি দেখেছ তা স্মরণ করে গরগর করে বলে দিতে পারো এই ডিক্ল্যারেটিভ লং টার্ম মেমোরি-র বদান্যতায়। আবার কিছু বিষয় আছে যা স্মরণ করতে হয় না বা স্মরণে রাখতে হয় না, স্মরণে রয়ে যায়। আমি সাইকেল চালানো শিখে তিন বছর অল্প-বিস্তর সাইকেল চালিয়েছিলাম। গত এগারো বছর আমি সাইকেল ছুঁইনি পর্যন্ত কিন্তু আমি আত্মবিশ্বাসী যে সাইকেল চালাতে গিয়ে আমি মোটেই ভারসাম্য হারাবো না কারণ সাইকেল চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যসমূহ (কিংবা কোন বাদ্যযন্ত্র বাজানোর দক্ষতা)  মস্তিষ্ক স্বাভাবিকভাবেই তার প্রোসিডিউরাল লং টার্ম মেমোরি (পদ্ধতিগত দীর্ঘ মেয়াদী স্মৃতি)-তে জমা করে রাখে। তবে এমন অনেক তথ্য আছে যারা ডিক্ল্যারেটিভ লং টার্ম মেমোরি-র জন্য উপযুক্ত হলেও সেই তথ্যের দৈনন্দিন জীবনে খুব বেশী ব্যবহারের জন্য মস্তিষ্ককে প্রায়ই তথ্যগুলিকে চট্-জল্দি স্মরণ করতে হয় কিংবা কিছু বিষয়ে আমাদের পছন্দ বা বিশেষ অনুভূতির কারণে মস্তিষ্ক সেই সংক্রান্ত তথ্যগুলি নিজ স্মৃতিতে চিরস্থায়ী করতে চায়। এই সকল ক্ষেত্রে প্রোসিডিউরাল লং টার্ম মেমোরি-ই ভরসা। প্রোসিডিউরাল লং টার্ম মেমোরি অভ্যাস বা কোন কাজের পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে গড়ে ওঠে। ইংরাজীতে “প্র্যাক্টিস মেক্স আ ম্যান্ পারফেক্ট” কথাটি পরম সত্য কারণ প্রোসিডিউরাল লং টার্ম মেমোরি-তে সঞ্চিত নির্দিষ্ট কোন কাজ করার পূর্বাভিজ্ঞতা আমাদের অজান্তেই কাজটিকে আরও নিখুঁতভাবে ও দক্ষতার সাথে করতে সাহায্য করে।

আমরা অনেকেই অনেক সময় ভেবে থাকি যে আমাদের অনেক রকম অধীত বিদ্যা বা অর্জন করা দক্ষতা প্রয়োগের যথাযথ সুযোগ আমরা পেলাম না। আমরা আমাদের বর্তমান পেশা বা কর্মজীবনের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে হয়ত কখনও কখনও ভাবি যে বোধ হয় অত কিছু না জানলে বা শিখলেও চলত।  এই প্রসঙ্গে আমার মা বারবার আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয় – “জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা” কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব তা বোঝাচ্ছি। ভাবলে অবাক হবে যে, আমাদের স্মরণ করা তথ্যসমূহ যেমন আমাদের মস্তিষ্কে এনকোড্ করে রাখা স্মৃতির ডিকোডেড্ রূপ তেমনই আমরা নতুন যা কিছু ভাবি তা হলো ঐ ডিকোডেড্ তথ্যসমূহের এনক্রিপ্টেড্ রূপ। অর্থাৎ আমরা যে কাজই করি না কেন বা আমরা বর্তমানে যে পেশার সাথেই যুক্ত থাকি না কেন, মস্তিষ্ক সেই ছোট্টবেলা থেকে শিখে আসা সকল বিদ্যা বা  অর্জিত দক্ষতাকে আমাদের অজান্তেই কাজে লাগিয়ে দেয়।

তৃতীয় উপদশা –

এই উপদশায় এনটোরাইনাল ও পেরিরাইনাল কর্টেক্সে আসা ডিক্ল্যারেটিভ লং টার্ম মেমোরি-র জন্য উপযুক্ত তথ্যগুলি সংকেতাক্ষরে লিখিত (এনকোডেড্)  হয়।  এছাড়াও প্রোসিডিউরাল লং টার্ম মেমোরি-র জন্য উপযুক্ত কনসলিডেটেড তথ্যসমূহ সেরিবেলাম, পুটামেন, কডেট নিউক্লিয়াস ও মোটর কর্টেক্সে এনকোডেড্ হয়।  এই উপদশায় ০.৫ – ২ হার্ৎজ কম্পাঙ্কের ও ৭৫ মাইক্রোভোল্ট বিস্তারের (অ্যাম্প্লিচিউড)  ডেল্টা তরঙ্গ উৎপন্ন হয়।  খুব কম কম্পাঙ্কের হওয়ায় এই ডেল্টা তরঙ্গকে সাধারণত “স্লো ওয়েভ” এবং এই উপদশাকে “স্লো ওয়েভ স্লিপ” বা “ধীর তরঙ্গের ঘুম” বলা হয়।  এই  “স্লো ওয়েভ”-ই তৃতীয় উপদশায় ঘটে চলা সকল এনকোডিং প্রক্রিয়ার (প্রোসেস্)  হোতা।

অল্প বয়সী ইঁদুর ও বয়স্ক ইঁদুরের মস্তিষ্কে সিগ্মা ওয়েভ্ ও স্লো ওয়েভ্

 

এই তৃতীয় উপদশায় মানুষ কখনও কখনও স্বপ্ন দেখে, তবে সে স্বপ্ন হয় অসংলগ্ন ও অপরিষ্কার যা ঘুম থেকে জেগে আর মনে থাকে না। এই উপদশায় তথ্যসমূহের যে এনকোডিং প্রক্রিয়া চলে তা-ই আমাদের কাছে কখনও কখনও অসংলগ্ন ও অপরিষ্কার স্বপ্ন হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।

রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ

সেরিবেলাম নন্ রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ-এ সাধারণত  হাত-পায়ের স্কেলেটাল পেশীগুলিতে স্বাভাবিক মাসল্ টোন [হাত-পায়ের স্কেলেটাল পেশীগুলিতে স্বাভাবিক মাসল্ টোন থাকার জন্যই নন্ রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ-এ অনেকের ঘুমিয়ে চলার (স্লিপ্-ওয়াক্) অভ্যাস থাকে] ও আপার এয়ারওয়ে-র পেশীগুলিতে অনেক কম মাসল্ টোন বজায় রাখে।  এরপর ঘুমের রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ শুরু হলে, সেরিবেলাম হাত-পায়ের স্কেলেটাল পেশীগুলিতে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম [সেইজন্যই রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ-এ হাত-পা অসাড় (প্যারালাইস্ড)  থাকে] এবং আপার এয়ারওয়ে-র পেশীগুলিতে স্বাভাবিক মাসল্ টোন বজায় রাখে [ফলে রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ-এ শয্যা সঙ্গী(নি)-র “নাক ডাকা” থেকে নিস্তার পাওয়া যায়]।

এই দশায় সম্পূর্ণ মস্তিষ্কের শক্তি-ব্যায়ের হার জাগ্রত অবস্থা বা নন্ রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ অপেক্ষা বেশী।  মস্তিষ্কের পিছনের দিকে যে অংশটি স্পাইনাল কর্ডের সাথে অবিচ্ছিন্ন তা “ব্রেইন-স্টেম” নামে পরিচিত (এটি মেডুলা অবলংগাটা, পন্স ও মিডব্রেইন – এই তিনটি অংশ নিয়ে তৈরি হয়)।  রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ-এ পন্স অংশটি থেকে “পন্টো-জেনিকিউলো-অকিপিটাল” নামক এক বিশেষ তরঙ্গ উৎপন্ন হয়ে তা থ্যালামাস-র মধ্যে অবস্থিত ল্যাটারাল জেনিকিউলেট নিউক্লিয়াস এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে অকিপিটাল লোবের প্রাইমারী ভিসুয়াল কর্টেক্স পর্যন্ত যায় – ফলে প্রাইমারী ভিসুয়াল কর্টেক্স সক্রিয় হয়ে অল্প সময়ের জন্য হলেও চোখের টনিক পেশীকে দ্রুত হারে উত্তেজিত করে।  তখন চোখের পাতা বন্ধ অবস্থাতেই চোখের টনিক পেশী মধ্যস্থিত ফাস্ট ট্যুইচ্ মাসল্ ফাইবার দ্বারা চোখ বেশ দ্রুত চালিত হয়।  চোখের এই দ্রুত চলনের উপর ভিত্তি করেই ঘুমের এই দশার নাম দেওয়া হয়েছে – “রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ”।

মস্তিষ্কের পন্স, জেনিকিউলেট নিউক্লিয়াস ও অকিপিটাল কর্টেক্স

 

ঘুমের এই দশাতেই মানুষ সবচেয়ে বেশী স্বপ্ন দেখে।  এনটোরাইনাল ও পেরিরাইনাল কর্টেক্সে এনকোডেড্ হওয়া ডিক্ল্যারেটিভ লং টার্ম মেমোরি-র জন্য উপযুক্ত তথ্যগুলি এই দশাতেই টেম্পোরাল কর্টেক্সে কনসলিডেটেড্ হয়ে সঞ্চিত (স্টোর্ড)  হয়।  শুধু তাই নয়; সেরিবেলাম, পুটামেন, কডেট নিউক্লিয়াস ও মোটর কর্টেক্সে এনকোডেড্ হওয়ার পর প্রোসিডিউরাল লং টার্ম মেমোরি-র জন্য উপযুক্ত তথ্যগুলির সঞ্চয়ের (স্টোরিং) কাজ এই দশাতেই চলতে থাকে। তথ্য সঞ্চয়ের এই প্রক্রিয়াসমূহই কখনও কখনও  স্বপ্ন রূপে ধরা দেয়।  এই দশায় পরিষ্কার স্বপ্ন দেখা যায় এবং ঘুম থেকে জাগার পরেও সেই স্বপ্ন মনে থাকে, তবে এই স্বপ্নে ছবি (ইমেজ্) বা আবেগ (ইমোশন্) বা ঘটনাগুলি বাস্তব ঘটনাগুলির মত কারণ-ফলাফল সম্পর্কের (ক্যসালিটি)  ভিত্তিতে সাজানো থাকে না। উদাহরণস্বরূপ – ধর তুমি একটা চল্লিশ পাতার গল্প পড়ছ।  তুমি গল্পটা এক নম্বর থেকে চল্লিশ নম্বর পাতা অবধি পরপর না পড়ে; প্রথমেই দশ নম্বর পাতা থেকে এক নম্বর পাতা পর্যন্ত পরপর পড়লে, তারপর দুই নম্বর পাতা থেকে ত্রিশ নম্বর পাতা পর্যন্ত পরপর পড়লে এবং তারপর চল্লিশ নম্বর পাতা থেকে আবার ক্রমান্বয়ে কুড়ি নম্বর পাতা পর্যন্ত পিছিয়ে এলে – এভাবে পুরো চল্লিশ পাতা পড়লে ভেবে দেখ যে গল্পটা সম্পর্কে তোমার কী ধারণা হবে।  রাপিড আই মুভমেন্ট ফেজ-এ স্বপ্নের অভিজ্ঞতা অনেকটা সেরকমই।  এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, জাগ্রত অবস্থায় পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা, পূর্বোল্লিখিত গল্পটা এক নম্বর থেকে চল্লিশ নম্বর পাতা অবধি পরপর পড়ে যে ধারণা হয় তার অনুরূপ।  আর গল্পটার সবকটা পাতা না পড়ে মাঝখান থেকে কয়েকটা পাতা পড়লে তোমার পড়া বিষয়টা বেশীদিন মনেও থাকবে না।  এক্ষেত্রে গল্পটা সম্বন্ধে ধারণা, নন্ রাপিড আই মুভমেন্ট দশার তৃতীয় উপদশায় দেখা স্বপ্নের অভিজ্ঞতার মত।

Share
Written by
Diganta Paul -

জন্ম: ১৯৮৯ সালে ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হাওড়া জেলায়। শিক্ষা: প্রাথমিক, মাধ্যমিক, ও উচ্চ-মাধ্যমিক শিক্ষা হাওড়া জিলা স্কুলে। এরপর কলকাতার "সেইন্ট থমাস্ কলেজ অফ এঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনলজি" কলেজ থেকে বৈদ্যুতিক কারিগরিবিদ্যা নিয়ে প্রযুক্তিতে স্নাতক (B.Tech. in Electrical Engineering)। পেশা: তথ্য প্রযুক্তি পেশাদার (IT Professional)। নেশা: বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা নিয়ে পড়াশোনা ও চিন্তাভাবনা। এছাড়াও বিজ্ঞান প্রবন্ধ, বিজ্ঞান নিবন্ধ, কল্পবিজ্ঞান ভিত্তিক গল্প, কল্পবিজ্ঞান কবিতা, গাণিতিক কল্পকাহিনী, বিজ্ঞান নাটক, ও বিজ্ঞান কবিতা লেখা। উল্লেখযোগ্য পুরস্কার: বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ কর্তৃক প্রদত্ত অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি রৌপ্য পদক। যোগাযোগ: [email protected]

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচিকিৎসা বিদ্যাসাক্ষাৎকারস্বাস্থ্য ও পরিবেশ

আমাদের গর্ব ড. ফারিয়াহ মাহযাবীন

কৃতি বিজ্ঞানীদের সিরিজে আমি কথা বলেছি ড. ফারিয়াহ মাহযাবীন এর সাথে। তিনি...

GenZপরিবেশ ও পৃথিবীসাক্ষাৎকারস্বাস্থ্য ও পরিবেশ

ই-বর্জ্য এর গবেষক হৃদয় রায়

ই-বর্জ এর গবেষক হৃদয় রায়। বাংলাদেশের মধ্যে ই-বর্জ নিয়ে কাজ করছে এমন...

স্বাস্থ্য ও পরিবেশ

অন্ধকারে ভয়

কোন ব্যক্তি বাস্তবে যতই সাহসী হোন না কেন, গভীর রাতে অন্ধকার জনশূন্য...

স্বাস্থ্য ও পরিবেশ

পাখার শব্দে নাম যে পাখির

ঈগল, বাজ ইত্যাদি পাখি মানুষকে এরোপ্লেন আবিষ্কারের অনুপ্রেরণা জোগালেও ফড়িং, মৌমাছি ইত্যাদি...

স্বাস্থ্য ও পরিবেশ

মাছরাঙার মাছ ধরা

একটি মাছরাঙা প্রতিদিন নিজের ওজনের প্রায় সম পরিমাণ ছোটো মাছ শিকার করে...

Three Columns Layout

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact

biggani.org❤️gmail.com

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

যোগাযোগ:

biggani.org@জিমেইল.com

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.