রক্ত থেকে প্লাস্টিকবর্জ্য পরিষ্কার
লন্ডনের অভিজাত হার্লে স্ট্রিটের পাশ দিয়ে হাঁটলে চোখে পড়বে মার্বেল দেয়াল ঘেরা একটি নিঃশব্দ ক্লিনিক। বাইরে শান্ত, ভেতরে চলছে এক অদ্ভুত বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা—মানুষের শরীর থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক অপসারণ! হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। আপনি যখন ব্যস্ত জীবনে প্রতিদিন প্লাস্টিক মোড়ানো খাবার খান, বা প্যাকেটের পানি পান করেন, তখন শরীরে ঢুকে যাচ্ছে অগণিত মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা। আর সেই অনাকাঙ্ক্ষিত কণাগুলোকে রক্ত থেকে সরিয়ে দিচ্ছে এক বিলাসবহুল চিকিৎসা পদ্ধতি—Clari Apheresis।
এই চিকিৎসাটি চালু করেছে Clarify Clinics নামের একটি প্রাইভেট মেডিকেল প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির সিইও ইয়ায়েল কোহেন বলেন, “চিকিৎসা চলাকালীন রোগীরা ফোনে মিটিং করেন, সিনেমা দেখেন, এমনকি ঘুমিয়ে পড়েন—এটাই প্রমাণ করে, এটি কতটা আরামদায়ক।”
এমনকি কোহেন মজা করে বলেন, “যারা ঘুমিয়ে পড়েন, তারাই আমার প্রিয় রোগী!” একেকটি সেশন খরচ প্রায় $১২,০০০, কিন্তু এই দামে মিলছে কি সত্যিই প্লাস্টিকমুক্ত জীবন?
কেন এই চিকিৎসা?
বিগত কয়েক বছরে গবেষকরা দেখেছেন, মানুষের রক্ত, অন্ত্র, এমনকি মস্তিষ্কেও পাওয়া যাচ্ছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। ইউরোপিয়ান রিসার্চ কাউন্সিলের গবেষক ড. আন্দ্রেয়া ফ্লেচার জানান, “এগুলো ছোট হলেও বিপজ্জনক। সেল ড্যামেজ, হার্ট প্রবলেম এমনকি স্নায়বিক জটিলতাও এর কারণে হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।”
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, একজন ব্যক্তি বছরে প্রায় ৫০,০০০ মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা গিলে ফেলেন—এবং তা কেবল খাদ্য ও পানীয় থেকেই। গবেষণাগারে মানুষের প্ল্যাসেন্টা ও ব্রেইন টিস্যুতে এসব কণার উপস্থিতিও পাওয়া গেছে।
তবে সমস্যার গভীরতা বোঝার আগেই একদল মানুষ নিজের শরীর পরিষ্কারের দিকে ঝুঁকেছেন। কোহেন বলছেন, লং কোভিড, ক্রনিক ফ্যাটিগ, ব্রেইন ফগ, লুপাসের মতো অসুস্থতায় যারা ভুগছেন তারাও এই চিকিৎসা নিচ্ছেন।
চিকিৎসা না বিলাসিতা?
যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞান সংবাদিক ম্যাট রেইনল্ডস সম্প্রতি নিজের রক্তে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পরীক্ষা করান—প্রতি মিলিলিটারে ১৯০টি কণা। যেহেতু তিনি চিকিৎসাটি নিজে নেননি, তিনি ক্লিনিকের সিইও কোহেনকে মেইল করেন। উত্তরে কোহেন বলেন, “তোমার দেহে এখনও প্রায় এক মিলিয়ন মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা রয়ে গেছে!”
লম্বা সময় ধরে এপেরেসিস পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে অটোইমিউন ডিজঅর্ডার এবং কিছু স্নায়বিক রোগে। তবে এই পদ্ধতি যে সত্যিই মাইক্রোপ্লাস্টিক অপসারণে কার্যকর, তা এখনো বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ হয়নি। ফলে প্রশ্ন থেকেই যায়—এটি চিকিৎসা না বিলাসিতা?
দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে ‘লং জিভিটি ইনফ্লুয়েন্সার’
ব্রায়ান জনসন নামের এক প্রযুক্তি ব্যবসায়ী এবং ‘লং জিভিটি’ ইনফ্লুয়েন্সার সম্প্রতি নিজের ছেলের রক্ত নিজের শরীরে প্রবাহিত করে দিয়েছেন, এই একই এপেরেসিস পদ্ধতি ব্যবহার করে। কোহেন বলেন, “তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে শরীরের আয়ু বাড়ানো যায়—আর এতে আমাদের ক্লিনিকের চাহিদাও বেড়েছে।”
সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া
শরীরচর্চা করা ৩৪ বছরের লন্ডনবাসী হেনরি স্মিথ বলেন, “আমি দিনে পাঁচ লিটার পানি খাই, সুস্থ জীবনযাপন করি। কিন্তু যখন শুনি আমার রক্তেও মাইক্রোপ্লাস্টিক রয়েছে, তখন মনে হয়—সবই বৃথা!”
আর এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী শার্লট ডেভিস বলেন, “১২ হাজার ডলার খরচ করার মতো আমার সামর্থ্য নেই, কিন্তু যদি সরকারি কোনো স্কিমে এটা সহজলভ্য হয়, অবশ্যই নিতে চাই।”
বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যৎ
এই চিকিৎসা বিজ্ঞানী সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করেছে। কেউ বলছেন এটি ভবিষ্যতের চিকিৎসা, আবার কেউ এটিকে বিজ্ঞানের ছদ্মবেশে বিলাসবহুল ব্যবসা বলছেন। যেহেতু বিশ্বব্যাপী মাইক্রোপ্লাস্টিক ক্রমে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করছে, তাই অনেকেই বিশ্বাস করেন, এ ধরনের উদ্ভাবনকে অবহেলা করা উচিত নয়।
বিজ্ঞানী মহলের অনেকেই বলছেন, এটি এক ধরনের ‘প্রিভেনটিভ বায়োহ্যাকিং’। তবে যেহেতু এখনো ব্যাপক গবেষণালব্ধ প্রমাণ নেই, তাই এটি হয়তো ধনীদের বিলাসিতা হিসেবেই রয়ে যাবে—কমপক্ষে এই মুহূর্তে।
বাংলাদেশের এনভায়রনমেন্ট সায়েন্টিস্ট ড. ফারহানা ইসলাম বলেন, “আমাদের দেশের প্লাস্টিক দূষণের হারও ভয়াবহ। ভবিষ্যতে যদি এমন প্রযুক্তি দেশে আসে, তাহলে তা হবে যুগান্তকারী।”
শেষ কথা
এই গল্প শুধু একটি ক্লিনিক বা চিকিৎসার গল্প নয়—এটা ভবিষ্যতের স্বাস্থ্য সচেতন সমাজের প্রতিচ্ছবি। যখন প্লাস্টিক আমাদের খাবার, পানি এমনকি রক্তের অংশ হয়ে যায়, তখন নতুন যুগের চিকিৎসাই হতে পারে আমাদের মুক্তির উপায়। তবে সেটি কতটা বিজ্ঞানসম্মত ও নিরাপদ—সেই প্রশ্নের উত্তর হয়তো সময়ই দেবে।
আপনার মতামত জানাতে লিখুন: [email protected] সূত্র: Wired, Futurism, European Research Council, Clarify Clinics ছবি কৃতজ্ঞতা: Peter Dazeley via Getty Images
এই ধরনের আরও প্রতিবেদন পেতে যুক্ত থাকুন বিজ্ঞানী অর্গ-এর ফেসবুক পেজে।
Leave a comment