এক গ্রীষ্মের দুপুরে, জার্মানির কার্লসরুহে শহরের প্রান্তে দাঁড়িয়ে একদল বিজ্ঞানী তাকিয়ে আছেন একটি দৈত্যাকার ধাতব ট্যাংকের দিকে। ২০০ টন ওজনের এই বিশাল যন্ত্রটি দেখতে যেন ভবিষ্যতের কোনো নভোযান—কিন্তু আসলে এটি KATRIN, একটি অতিপ্রযুক্তিময় নিউট্রিনো পরিমাপক যন্ত্র। তাদের চোখে আশার ঝিলিক—হয়তো এবার সেই “অদৃশ্য ভৌতিক কণা”র ওজন ধরা যাবে বিজ্ঞানীর মুঠোয়।
এই কণাটির নাম নিউট্রিনো। প্রতিদিন প্রতি সেকেন্ডে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন নিউট্রিনো আমাদের শরীর ভেদ করে চলে যাচ্ছে—যেন এক অনন্ত ঝরনার মতো কণা প্রবাহ, যা আমাদের স্পর্শ না করেই নিরবধি প্রবাহিত হয়ে যায়। অথচ আমরা টেরই পাই না। একে বলা হয় মহাবিশ্বের সবচেয়ে প্রচ্ছন্ন অথচ প্রচুর কণা। কিন্তু এত পরিচিত হলেও, এটির একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য—ভর—আজও নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি।
নতুন পদক্ষেপে এক ধাপ এগিয়ে
সম্প্রতি কার্লসরুহে ট্রিটিয়াম নিউট্রিনো (KATRIN) এক্সপেরিমেন্ট থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, নিউট্রিনোর ভর ০.৪৫ ইলেকট্রন-ভোল্ট (eV)-এর বেশি নয়—যা একটি ইলেকট্রনের ভরের এক মিলিয়ন ভাগেরও কম! কেবল প্রথম ২৫৯ দিনের তথ্য বিশ্লেষণ করেই এই সাফল্য এসেছে। এখনও বাকি তিন-চতুর্থাংশ তথ্য বিশ্লেষণ।
KATRIN দলের সদস্য ও গবেষক আলেক্সেই লোখভ বলেন, “আমরা এখনো সম্পূর্ণ লক্ষ্য অর্জন করিনি। কিন্তু আমাদের যন্ত্রের সংবেদনশীলতা দ্বিগুণ বেড়েছে। আশা করি, চূড়ান্ত বিশ্লেষণে ০.৩ eV পর্যন্ত পৌঁছানো যাবে।”
সঙ্গী গবেষক ক্রিস্টোফ উইসিঙ্গার যোগ করেন, “এই বছরের শেষে বিশাল তথ্যভাণ্ডার পেয়ে যাব আমরা। আর তখন হয়তো আমরা ইতিহাসের সবচেয়ে নির্ভুল মাপটি দিতে পারব।”
নিউট্রিনো: এক অভিমানী বিপ্লবী কণা
নিউট্রিনো কেবল ছোট বা হালকা নয়—এ এক অদ্ভুত চরিত্র। নিউট্রিনোর রয়েছে তিনটি ‘ফ্লেভার’ বা রূপ: ইলেকট্রন নিউট্রিনো, মিউন নিউট্রিনো এবং টাও নিউট্রিনো। এরা এক রূপ থেকে আরেক রূপে রূপান্তরিত হতে পারে, যাকে বলা হয় ‘নিউট্রিনো ওসিলেশন’। এই বৈশিষ্ট্যটিই প্রমাণ করে যে নিউট্রিনোর একটি ক্ষুদ্র কিন্তু বাস্তব ভর আছে। “যখন মনে হয় সব ব্যাখ্যা মিলে গেছে, তখন নিউট্রিনো বলে, না—এখনও কিছু বাদ আছে,”—এভাবেই Harvard-এর পদার্থবিজ্ঞানী কার্লোস আর্গুয়েলেস ডেলগাডো বলেন।
স্ট্যান্ডার্ড মডেল নামক পদার্থবিজ্ঞানের তত্ত্ব অনুযায়ী নিউট্রিনোর ভর থাকার কথা নয়। অথচ ২০১৫ সালে নোবেলজয়ী গবেষণা দেখিয়েছে, নিউট্রিনোর ভর আছে এবং তারা তিনটি রূপে রূপান্তরিত হতে পারে। এটি কেবল কণা নয়, এক রহস্যের দরজা।
কারণেই নিউট্রিনো গুরুত্বপূর্ণ
কেন এই কণার ভর জানাটা এত জরুরি? কারণ এটি মহাবিশ্বের জন্ম ও গঠনের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। কোলোম্বিয়া ইউনিভার্সিটির পদার্থবিদ জর্জিয়া কারাজিওর্গি বলেন, “নিউট্রিনোর সংখ্যা এত বেশি, যে তারা মহাবিশ্বের গঠন প্রক্রিয়াতেই বড় প্রভাব ফেলে।”
KATRIN-এর প্রধান স্পেকট্রোমিটারটি ২৪ মিটার লম্বা ও ১০ মিটার চওড়া—এটি দেখতে অনেকটা একটি বিশাল টানেল বা পাইপলাইনের মতো, যার ভেতর দিয়ে ইলেকট্রনের শক্তি যাচাইয়ের জন্য একটি নিখুঁত পরিবেশ তৈরি করা হয়। ঠিক যেমন এক টানেলের ভেতর দিয়ে হালকা বাতাস বইলে আমরা সেই বাতাসের গতি নির্ণয় করতে পারি, তেমনই এই স্পেকট্রোমিটার ইলেকট্রনের শক্তির ক্ষীণতম পরিবর্তনও ধরতে সক্ষম। এক বিশাল সিলিন্ডার, যার অভ্যন্তরভাগ ৮০০ বর্গমিটার আয়তনের। এটির কাজ খুব সূক্ষ্মভাবে বিটা ক্ষয় প্রক্রিয়ায় নির্গত ইলেকট্রনের শক্তি পরিমাপ করা। এই শক্তির বিকৃতি থেকেই আন্দাজ করা যায় নিউট্রিনোর ভর।
এই যাত্রার শেষ কোথায়?
KATRIN প্রকল্প শেষের পথে, তবে বিজ্ঞানীদের আশাবাদ রয়েছে যে, ভবিষ্যতের গবেষণার ভিত্তি হিসেবে এই ডেটা দশকের পর দশক কাজে লাগবে।
“নিউট্রিনো যেন এক ‘কসমিক কী’—যা দিয়ে মহাবিশ্বের অনেক অজানা দরজা খুলে ফেলা সম্ভব,” বলেন লোখভ।
এ যেন এক মহাকাব্যিক অনুসন্ধান—এক অদৃশ্য কণার পেছনে দৌড়, যা আমাদের মহাবিশ্বের প্রকৃতি নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।
পাঠকের মন্তব্য:
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী রিদওয়ান হাসান বলেন, “এই রকম গবেষণার খবর পড়লে মনে হয় আমরা বিজ্ঞানের সঠিক পথে হাঁটছি। হয়তো আগামী প্রজন্ম নিউট্রিনোর রহস্যই উন্মোচন করবে।”
উপসংহার
নিউট্রিনো হয়তো ক্ষুদ্র, কিন্তু তার তাৎপর্য বিশাল। KATRIN-এর এই নতুন অর্জন আমাদের একধাপ এগিয়ে নিয়েছে মহাবিশ্বের গভীরতর রহস্য উন্মোচনের পথে।
আর এই গবেষণা শুধু বিজ্ঞানীদের নয়, আমাদের সকলের ভাবনায় নতুন আলো জ্বালিয়ে দিল।
Leave a comment