নবীন প্রজন্মদের সাক্ষাৎকার সিরিজে এবার আমরা সাক্ষাৎকার নিয়েছি মিনহাজুর রহমান এর। তিনি বর্তমানে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম এ কাজ করছেন। তার সাক্ষাৎকারটি পড়ুন:
প্রথমেই আপনার সম্বন্ধে আমাদের একটু বলুন:
আমি মিনহাজুর রহমান, একজন উদীয়মান তরুণ গবেষক। আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের (IIUC) ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল (EEE) বিভাগে স্নাতকে (সম্মান) পড়াশোনা করেছি, যেখানে আমার বিশেষায়ন ছিল ইলেকট্রিক্যাল পাওয়ার সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ারিং। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির শুরু থেকেই বিভিন্ন গবেষণামূলক কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে যুক্ত রয়েছি। বর্তমানে আমি প্রফেসর ড. ইয়াসির আরাফাতের তত্ত্বাবধানে স্মার্ট গ্রিডের উপর গবেষণা করছি।
আমার গবেষণার আগ্রহের বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে হিউম্যান-সাইবার-ফিজিক্যাল সিস্টেমস এর লার্নিং এবং অপটিমাইজেশন, পাওয়ার সিস্টেম এবং এনার্জি খাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ, এবং কম্পিউটেশনাল সাস্টেইনেবিলিটি। বিশেষ করে, আমি স্মার্ট গ্রিড এবং স্মার্ট সিটির বাস্তব প্রয়োগক্ষেত্রে কাজ করতে আগ্রহী। আমার লক্ষ্য হলো বুদ্ধিমান, স্বয়ংক্রিয় এবং টেকসই এনার্জি সিস্টেমের তাত্ত্বিক ভিত্তি গড়ে তোলা এবং ব্যবহারিক প্রয়োগযোগ্য টুলস উদ্ভাবন করা, যা ভবিষ্যতে এনার্জি ব্যবস্থাকে আরও দক্ষ এবং পরিবেশবান্ধব করে তুলবে। মোটাদাগে আমি তত্ত্বীয় গবেষণায় আগ্রহী।
আপনার গবেষনার বিষয় কি?
আমি দুটি গবেষণা ক্ষেত্র স্মার্ট গ্রিড এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় কাজ করছি যা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (Sustainable Development Goals – SDGs) এর লক্ষ্য পূরণে অবদান রাখতে পারে। SDGs স্মার্ট গ্রিড এর মতো প্রযুক্তির জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
প্রথমত, স্মার্ট গ্রিড প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আমি Non-intrusive Load Monitoring নিয়ে কাজ করছি। এটার সহজ বাংলা করা কঠিন। সহজভাবে বলতে গেলে, আমি রিসিভিং এন্ড হতে বিভিন্ন ডিভাইসের পাওয়ার ইউসেজ মনিটর করতে চাই শুধুমাত্র কন্সাম্পশন ডেটা বিশ্লেষণের মাধ্যমে, সরাসরি ডিভাইসের উপর কোনো সেন্সর স্থাপন না করেই। যেমন, একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোন কোন ডিভাইস চালু আছে, কোনটি কতটুকু বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে—এই ধরনের তথ্য নির্ধারণ করা। এটি একটি বুদ্ধিমান এবং টেকসই প্রযুক্তি যা রিয়েল-টাইমে এনার্জি ব্যবহারের বিস্তারিত তথ্য দেয়।
Non-intrusive Load Monitoring স্মার্ট গ্রিডের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি এনার্জি ব্যবহারের তথ্য বিশ্লেষণ করে ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT) ব্যবহার করে ডিভাইসগুলোকে স্মার্টলি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। Non-intrusive Load Monitoring সিস্টেমের মূল উপাদান হলো এর অ্যালগরিদম। বর্তমানে, আমি এই অ্যালগরিদমের উন্নয়নে কাজ করছি, যেখানে প্যাটার্ন রিকগনিশন, মেশিন লার্নিং, এবং ডিপ লার্নিং-এর মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। আমি বিশেষভাবে ট্রান্সফরমার-ভিত্তিক ডিপ লার্নিং মডেলের ওপর গবেষণা করছি। এই অ্যালগরিদম গবেষণার ক্ষেত্রে স্মার্ট মিটারের ডেটা হ্যান্ডেল করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এর জন্য আমি একটি জেনারেলাইজড ইঞ্জিনিয়ারিং সমাধান তৈরি করার লক্ষ্যে কাজ করছি, যা এই সমস্যার সমাধান করতে পারে।
দ্বিতীয়ত, আমি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্বলিত ডায়েটারি ফুড মনিটরিং ব্যবস্থা ও স্মার্ট ট্রাফিক মনিটরিং ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করছি। আধুনিক বিজ্ঞান নির্ভর জগতে মানুষ খাদ্য বিজ্ঞান এবং খাওয়া-দাওয়ার অভ্যাস নিয়ে বেশ সচেতন হলেও মধ্যবয়সী বেশিরভাগ মানুষ নানান শারীরিক জটিলতা যেমন ডায়াবেটিকস ও স্থুলতায় ভুগছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করে স্মার্ট ডায়েটারি ফুড মনিটরিং সিস্টেম তৈরি করার মাধ্যমে খাবার-দাবার সঠিক নিয়ম মেনে গ্রহন করতে সহায়ক এআই-এজেন্ট মানুষকে সহায়তা করছে। আমি নিজস্ব দেশ ও স্বংস্কৃতির খাবার সম্বলিত একটি ডেটাবেস তৈরি করার লক্ষে কাজ করছি এবং আমাদের দেশীয় খাবার-দাবারে ডায়েটারি ফুড মনিটরিং প্রযুক্তির উপযোগিতা নিয়ে গবেষণা করছি। যদিও এটি SDGs এর সাথে সরাসরি সম্পর্কিত নয়, তবে ডায়েটারি ফুড মনিটরিং প্রযুক্তির মাধ্যমে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস উন্নয়নে মানুষের স্বাস্থ্য ও কল্যাণে এটি সহায়ক হতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক স্মার্ট ট্রাফিক মনিটরিং ব্যবস্থার ব্যবহার বর্তমানে অত্যন্ত যুগোপযোগী। এর মাধ্যমে মানুষের সময় এবং জীবনের বহুমুখী উন্নয়ন সাধিত হতে পারে।
আমার গভেষণার কাজ স্মার্ট গ্রিডের মাধ্যমে এনার্জি ব্যবহারের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং টেকসই এনার্জি ব্যবস্থার দিকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, যা সরাসরি SDG ৭ (“স্বল্প খরচে পরিচ্ছন্ন জ্বালানি”) এবং SDG ১৩ (“জলবায়ু কর্মপরিকল্পনা”) এর সঙ্গে সম্পর্কিত।
Non-intrusive Load Monitoring প্রযুক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ ব্যবহারের সঠিক বিশ্লেষণ এবং সাশ্রয়ী উপায়ে এনার্জি পরিচালনা করা সম্ভব হবে, যা শক্তি অপচয় কমাতে এবং পরিচ্ছন্ন জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে সহায়ক। পাশাপাশি, এটি পরিবেশ সংরক্ষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। স্মার্ট গ্রিডের বুদ্ধিমান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা উন্নত করে SDG ৯ (“শিল্প, উদ্ভাবন ও অবকাঠামো”) এবং SDG ১১ (“টেকসই নগর ও সম্প্রদায়”) এর লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সহায়তা করতে পারবে।
এই প্রযুক্তির উন্নয়ন ও ব্যবহার বিশ্বের টেকসই উন্নয়নের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করবে।
আপনার গবেষনার কাজগুলি কিভাবে আমাদের উপকৃত করছে কিংবা করবে?
আমার কাজগুলো আশা করি প্রচলিত পাওয়ার গ্রিড থেকে স্মার্ট গ্রিডে প্রযুক্তিগত মানোন্নয়নে সহায়ক হবে। এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীরা তাদের এনার্জি ব্যবহারের ওপর আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ এবং সচেতনতা অর্জন করতে পারবেন। রিয়েল-টাইম ফিডব্যাক এবং স্বয়ংক্রিয় দ্বিমুখী যোগাযোগ ব্যবস্থা সমৃদ্ধ স্মার্ট গ্রিড ভবিষ্যতে নিরবচ্ছিন্ন ও নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, যা আমাদের পৃথিবীর টেকশই উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
একজন বিজ্ঞানীর কি কি গুণ থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন?
যদিও প্রত্যেক বিজ্ঞানীর এই সমস্ত বৈশিষ্ট্য থাকে না, তবে এই বৈশিষ্ট্যগুলিই ভাল বিজ্ঞানী তৈরি করতে সাহায্য করে।
কৌতূহলী: বিজ্ঞানীরা তাদের পৃথিবী সম্পর্কে কৌতূহলী। তারা জানতে চায় কেন জিনিসগুলি ঘটে এবং কীভাবে জিনিসগুলি কাজ করে। বিজ্ঞানীরা ধৈর্যশীল কারণ তারা ফলাফল যাচাই করার জন্য একাধিকবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে।
সাহসী: বিজ্ঞানীরা বছরের পর বছর এবং অসংখ্য ব্যর্থতার সাথে প্রায়শই উত্তর আবিষ্কার করার জন্য কাজ করে। তারা স্বীকার করে যে ব্যর্থ পরীক্ষাগুলি যতবার সফল ততবার উত্তর দেয়। বিস্তারিত ভিত্তিক বিজ্ঞানে, উত্তরগুলি পর্যবেক্ষণ এবং সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়। বিজ্ঞান তত্ত্বের বিকাশে বিশদ বিবরণের প্রতি গভীর মনোযোগ গুরুত্বপূর্ণ। একটি পরীক্ষায় বিশদ পর্যবেক্ষণগুলিও অন্যটিতে উত্তরের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
সৃজনশীল: জনপ্রিয় মতামতের বিপরীতে, বিজ্ঞানীদের অবশ্যই সৃজনশীল হতে হবে, বাক্সের বাইরে চিন্তা করতে সক্ষম হতে হবে।
অবিচল: বিজ্ঞানীরা স্বীকার করেছেন যে তাদের কাজ কয়েক দশক সময় নিতে পারে, এবং তাদের পদ্ধতি ভুল হতে পারে এবং তাদের কাজ ভবিষ্যতের বিজ্ঞানীদের দ্বারা মিথ্যা প্রমাণিত হতে পারে।
যোগাযোগমূলক: বিজ্ঞানীদের ভালো যোগাযোগ দক্ষতা প্রয়োজন। তাদের একটি দলের অংশ হিসাবে কাজ করতে হতে পারে, জনসাধারণের সাথে তথ্য ভাগ করতে হবে বা বিশ্বজুড়ে সহকর্মীদের সাথে সহযোগিতা করতে হবে।
মুক্তমনা এবং পক্ষপাত মুক্ত: বিজ্ঞানীদের বিচার স্থগিত করতে হবে যাতে তারা সর্বোত্তম সম্ভাব্য সমাধান অনুসন্ধান করার সময় পর্যবেক্ষণ এবং ডেটা সংগ্রহ করা চালিয়ে যেতে পারে। যদিও তারা একটি হাইপোথিসিস মাথায় রেখে কাজ করছে, তাদের মনে রাখতে হবে আরও অনেক হাইপোথিসিস আছে।
সমালোচনামূলক চিন্তাবিদ এবং সমস্যা সমাধানকারী: পরীক্ষামূলক সমস্যা বা বিশ্ব সমস্যা সমাধানের জন্য বিজ্ঞানীদের তথ্য বিশ্লেষণ এবং সমালোচনামূলক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বাংলাদেশের তরুণ শিক্ষার্থী যারা বিজ্ঞানে কাজ করতে চায় – তাদের জন্য আপনার কোন ম্যাসেজ কিংবা বার্তা কি?:
বাংলাদেশের তরুণদের জন্য আমার বার্তা হলো— কৌতূহল ধরে রাখো, পরিশ্রম করো, আর ধৈর্য হারিও না। ব্যর্থতা থেকে শিখে সামনে এগিয়ে যাও। সৎভাবে কাজ করো যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মও উপকৃত হয়।
আপনার যোগাযোগের তথ্য:
আমার সাথে LinkedIn- এ যোগাযোগ করতে পারেন- https://www.linkedin.com/in/minhajur-rahman-b516a916b এছাড়াও আমাকে ই-মেইল করতে পারেন- fahad061299@জিমেইল.com
আমরা শামফিন হুসাইন কাশফি এর উত্তোরত্তর সাফল্য কামনা করি।
Leave a comment