পৃথিবী থেকে সাধারন টেলিস্কোপেও মহাকাশ দেখা যায়। তবে সাধারন
টেলিস্কোপের প্রধান সমস্যা হলো এতে মহাকাশের যে চিত্র দেখা যায় তা কিছুটা
ঝাপসা। কারন টেলিস্কোপ আর মহাকাশের মাঝে থাকে পৃথিবীর বায়ুমন্ডল। ঠিক এ
কারনেই ১৯৯০ সালের ২৪ এপ্রিল পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের বাইরে ভূ-পৃষ্ট থেকে
৬০০কিলোমিটার উপরে বায়ুমন্ডলে মহাশূন্যে স্থাপন করা হয় ২.৪ মিটার দীর্ঘ
হাবল টেলিস্কোপ। প্রথমদিকে এই টেলিস্কোপের সাহায্যে প্রাপ্ত ছবিও ঝাপসা
দেখাত। ফলে তিন বছর পর ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বর মাসে মেরামতের পর এই
টেলিস্কোপটি পৃথিবী থেকে কয়েক বিলিয়ন আলোক বর্ষ দূরের গ্যালাক্সিও স্পষ্ট
হয়ে উঠে। মার্কিন জ্যোতিবির্দ এডুইন হাবলের নামানুসারে রাখা এই
টেলিস্কোপটি স্থাপনের ফলে মহাকাশ গবেষণায় এক নতুন যুগের সূচনা হয়। তবে
বিজ্ঞানীরা এখন অপেক্ষায় আছেন আরেক নতুন যুগে প্রবেশের। কারন নাসা গবেষকরা
ইতোমধ্যেই নাসার একজন প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক জেমস ওয়েবের নামানুসারে তৈরি
করেছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ বা সংক্ষেপে ‘JWST’। সাড়ে চার বিলিয়ন
ডলারে নিমির্ত ২৪ মিটার দীর্ঘ আর ১২ মিটার উচ্চতার এই টেলিস্কোপটি পৃথিবী
থেকে দেড় মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে স্থাপনের কথা রয়েছে। সব ঠিকঠাক থাকলে
‘বিশ্বজগতের জানালা’ হিসেবে পরিচিত হাবল টেলিস্কোপকে ২০১৩ সালের জুন মাসে
অবসরে পাঠানো হবে আর সূচনা হবে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের যুগ।
নতুন এই মহাকাশ টেলিস্কোপটি তৈরি হচ্ছে নাসা (NASA), ইউরোপীয়ান স্পেস
এজেন্সি (ESA), কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি (CSA)। প্রথমদিকে এর নাম রাখা হয়
পরবর্তী প্রজন্মের মহাকাশ টেলিস্কোপ । পরবর্তীতে ২০০২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর
মাসে নাসার প্রাক্তন পরিচালক জেমস ওয়েবের নামানুসারে এর নাম রাখা হয় জেমস
ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ । উল্লেখ্য, জেমস ওয়েব অ্যাপলো মিশন চলাকালীন নাসার
পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
ছবি | JWST (ইন্টারনেট থেকে)
এই প্রজেক্টটি পরিচালনা করছে নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টার। প্রায়
সতেরোটি দেশের এক হাজারেরও বেশি গবেষক এবং প্রকৌশলী কাজ করছেন এই
প্রজেক্টে। আর টেলিস্কোপ তৈরিতে নাসার বানিজ্যিক সহযোগী হিসেবে কাজ করছে
Northrop Grumman Space Technologies। টেলিস্কোপটি মহাকাশে স্থাপনের পর
দেখাশুনাসহ যাবতীয় দায়িত্ব পালন করবে স্পেস টেলিস্কোপ সায়েন্স ইনষ্টিটিউট।
হাবল টেলিস্কোপের চেয়ে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের প্রাথমিক আয়নাটি আকারে
অনেক বড় হবে। ৫১ ইঞ্চি প্রস্থের ১৮ টি ছোট ষড়ভূজাকৃতির আয়নার সমন্বয়ে গঠিত
বিশালাকৃতির প্রাথমিক আয়নায় ওজন কমাতে ব্যবহার করা হয়েছে বেরিলিয়াম ধাতু।
এক্ষেত্রে হালকা ধূসর এবং ভঙ্গুর ধাতু বেরিলিয়ামকে বেছে নেয়ার প্রধান কারন
হচ্ছে বেরিলিয়াম বাতাসের সংস্পর্শে খুব কমই বিবর্ন হয়। এর সাথে অল্প
পরিমান সংকর ধাতু মিশালে তা হয়ে উঠে তাপ এবং ক্ষয়রোধী।তাছাড়া ওজন কম
হওয়ায় সুপারসনিক বিমানের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ তৈরিতেও বেরিলিয়াম ব্যবহার করা
হয়। তবে বিষাক্ত হওয়ায়, বেরিলিয়াম ধাতু নিয়ে কাজ করার সময় বিশেষ ধরনের
সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। আলোর প্রবেশ নিয়ন্ত্রনের জন্য এই টেলিস্কোপে
রয়েছে ক্যামেরার শাটারের মতো ৬২,৪১৫ টি ছিদ্র। প্রতিটি ছিদ্রের আকার ১০০ ×
২০০ মাইক্রন। ফলে এর মাধ্যমে খুব সহজেই তড়িত চৌম্বকীয় বর্ণালী স্পষ্ট ছবি
ধারন করা সম্ভব হবে।
সূর্যের প্রখর তাপ থেকে রক্ষার জন্য এতে রাখা হয়েছে একটি বিশেষ ধরনের
ঢাকনা। অ্যালুমিনিয়াম এবং সিলিকনের প্রলেপ দেয়া এই ঢাকনাটি প্রায় পাঁচটি
টেনিস কোর্টের সমান।
এই টেলিস্কোপের প্রধান একটি অংশ হলো ইন্টিগ্রেটেড সায়েন্স ইনস্ট্রুমেন্ট
মডিউল সংক্ষেপে ISIM। এই মডিউলে মূলত মহাকাশ গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয়
বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি রাখা হয়। এই মডিউলে চার ধরনের যন্ত্রপাতি থাকবে-
১.মধ্য-ইনফ্রারেড ইনস্ট্রুমেন্ট ( MIRI): এই যন্ত্রাংশটি তৈরি করছে
ইউরোপীয়ান স্পেস এজেন্সী (ESA) এবং নাসার জ়েট প্রোপালশান ল্যবারেটোরি
(JPL)
২. নিকটবর্তী ইনফ্রারেড ক্যামেরা (NIRCam):টেলিস্কোপের এই অংশটি তৈরি করেছে ইউনিভার্সিটি অব আরিজোনা।
৩.নিকটবর্তী-ইনফ্রারেড স্পেকট্রোফ্রাফ বা বর্নালীবীক্ষন (NIRSpec): এই
যন্ত্রাংশ তৈরিতে প্রধান ভূমিকা পালন করছে ইউরোপীয়ান স্পেস এজেন্সী (ESA)
৪. ফাইন গাইডেন্স সেন্সর (FGS): টেলিস্কোপের এই অংশটি তৈরি করছে কানাডিয়ান
স্পেস এজেন্সি(CSA)। এতে একটি ফিল্টার ক্যামেরা থাকবে যা প্রয়োজন অনুসারে
টিউন করা যাবে।
এই যন্ত্রপাতিগুলোকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য গডার্ড স্পেস ফ্লাইট
সেন্টারের গবেষকরা তৈরি করছেন তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রক,তথ্য ব্যবস্থাপনা,
উড্ডয়ন নিয়ন্ত্রক,শক্তি উৎপাদন সহ যাবতীয় নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা।
ছবি | JWST টিম (ইন্টারনেট থেকে)
হাবল টেলিস্কোপ পৃথিবী থেকে প্রায় ছয়শ কিলোমিটার দূরে থেকে পৃথিবীকে
প্রদক্ষিণ করছে আর অন্যদিকে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ পৃথিবী থেকে প্রায়
দেড় মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে থেকে পৃথিবীকে প্রদক্ষিন করবে! পৃথিবী থেকে দেড়
মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই বিন্দুটি দ্বিতীয় ল্যাগরেঞ্জ বিন্দু (যা
সংক্ষেপে L2 point) হিসেবে পরিচিত। গবেষকরা দেখেছেন, পৃথিবী থেকে মহাকাশ
ভালোভাবে পর্যবেক্ষনের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক জায়গা হচ্ছে এই বিন্দুটি। এই
টেলিস্কোপটিকে কক্ষপথে স্থাপনে সময় লাগবে প্রায় তিন মাস। তবে হাবল
টেলিস্কোপ যেভাবে মেরামত করা গেছে সেভাবে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ
মেরামত করা হবে না। পৃথিবী থেকে খুব দূরে স্থাপন করাই এর প্রধান কারন।
মেরামত করা সম্ভব হলেও তা অর্থনৈতিকভাবে মোটেও লাভজনক হবে না বলে
জানিয়েছেন গবেষকরা।
Leave a comment