স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু (১৮৫৮-১৯৩৭) ছিলেন এমন একজন বাঙালি বিজ্ঞানী, যিনি শুধুমাত্র ভারতবর্ষ নয়, সমগ্র বিশ্বের বৈজ্ঞানিক সমাজকে আলোড়িত করেছিলেন। তাঁর গবেষণার পরিধি এতটাই ব্যাপক ছিল যে তিনি উদ্ভিদের জীবন ক্রিয়া থেকে শুরু করে বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থার বিকাশে সমান অবদান রেখেছেন। তিনি এমন একজন গবেষক, যিনি প্রকৃতির রহস্য উন্মোচনে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
প্রথম জীবনের প্রেক্ষাপট:
জগদীশ চন্দ্র বসুর জন্ম হয়েছিল ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার রাণাগাঁও গ্রামে। তাঁর বাবা ভগবান চন্দ্র বসু ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষ। জগদীশ চন্দ্র ছোটবেলাতেই প্রকৃতির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় গ্রামীণ পাঠশালায়, যেখানে তিনি স্থানীয় সংস্কৃতি এবং প্রকৃতির সাথে নিবিড় সংযোগ স্থাপন করেন। পরবর্তীতে কলকাতা এবং লন্ডনের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা লাভের মাধ্যমে তিনি উচ্চতর বিজ্ঞানচর্চার দিকে অগ্রসর হন।
উদ্ভিদের সংবেদনশীলতা ও ক্রেস্কোগ্রাফের আবিষ্কার:
জগদীশ চন্দ্র বসুর অন্যতম বড় আবিষ্কার ছিল উদ্ভিদের সংবেদনশীলতা। তিনি দেখিয়েছিলেন যে উদ্ভিদও প্রাণীর মতো ব্যথা ও আনন্দ অনুভব করতে পারে। এর প্রমাণ দিতে তিনি ক্রেস্কোগ্রাফ নামে একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন, যা উদ্ভিদের বৃদ্ধি এবং তাদের প্রতিক্রিয়াকে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে মাপতে সক্ষম। এই যন্ত্রের মাধ্যমে উদ্ভিদের জীবন্ত প্রতিক্রিয়া এবং পরিবেশের প্রতি তাদের সাড়া প্রদানের বিষয়টি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
বেতার বিজ্ঞানের অগ্রপথিক:
স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু শুধুমাত্র উদ্ভিদ গবেষণার জন্যই বিখ্যাত ছিলেন না, তিনি বেতার বিজ্ঞানেরও এক অগ্রপথিক ছিলেন। ১৮৯৫ সালে তিনি বেতার তরঙ্গের ব্যবহারিক প্রয়োগ প্রদর্শন করেন, যা পরে আধুনিক টেলিকমিউনিকেশনের ভিত্তি হয়ে ওঠে। তাঁর আবিষ্কৃত যন্ত্রপাতি, বিশেষ করে “মাইক্রোওয়েভ ডিটেক্টর,” আজকের তারবিহীন যোগাযোগ ব্যবস্থার মূলভিত্তি। যদিও বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থায় তাঁর অবদান যথেষ্ট মূল্যায়িত হয়নি, তবুও তিনি বিজ্ঞানের ইতিহাসে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
সাহিত্য এবং বিজ্ঞানচর্চার সংযোগ:
জগদীশ চন্দ্র বসু শুধুমাত্র বিজ্ঞানীই ছিলেন না, তিনি একজন সাহিত্যপ্রেমীও ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, বিজ্ঞান এবং শিল্পকলা একে অপরের পরিপূরক। তাঁর লেখায় প্রকৃতির রহস্যময়তা এবং বিজ্ঞানের মাধ্যমে তা উন্মোচনের প্রক্রিয়াকে গভীরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তাঁর রচনা যেমন ‘অব্যক্ত’ এবং ‘নিরুদ্ধ’ আজও পাঠকদের মন কেড়ে নেয়।
বিজ্ঞান ও মানবতার মেলবন্ধন:
স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু মনে করতেন, বিজ্ঞান শুধুমাত্র গবেষণার নয়, এটি মানবতার সেবার একটি মাধ্যম। তিনি প্রকৃতির সৌন্দর্য ও রহস্য উদঘাটনের মাধ্যমে মানুষের জীবনকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর গবেষণার মাধ্যমে তিনি শিখিয়েছেন যে প্রকৃতি এবং বিজ্ঞান একে অপরের অংশীদার, এবং এই সংযোগ মানব জাতির জন্য এক অমূল্য সম্পদ।
উপসংহার:
স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু ছিলেন এমন এক অনন্য ব্যক্তিত্ব, যিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বিজ্ঞানের সেবা করে গেছেন। তাঁর জীবন আমাদের শিখায় যে সত্যের প্রতি নিষ্ঠা, প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা, এবং জ্ঞানের প্রতি তৃষ্ণা মানুষকে অনন্ত উঁচুতে তুলে নিতে পারে। আজও তিনি আমাদের জন্য এক অনুপ্রেরণার উৎস, এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এক আলোকবর্তিকা।
তাঁর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতা চিরদিন অমলিন থাকবে।
Leave a comment