GenZপরিবেশ ও পৃথিবীসাক্ষাৎকারস্বাস্থ্য ও পরিবেশ

ই-বর্জ্য এর গবেষক হৃদয় রায়

Share
Share

নবীন প্রজন্মদের সাক্ষাৎকার সিরিজের জন্য আমি সব সময়ই বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের কাজগুলি ফলো করি। সেইরকমই কোন একটি সময়ে আমি মেমব্রেন বায়োরিএক্টর (MBR) প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং টেকসই শিল্প বর্জ্য জল ব্যবস্থাপনা এর উপর একটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ পড়ে একটু অবাক হলাম। আজকের বিশ্বে এই ধরনের প্রযু্ক্তি এর প্রচুর প্রয়োজন রয়েছে আর সেই কাজটি বাংলাদেশের মতন একটি দেশে যেখানে গবেষণার যন্ত্রপাতির খুব অভাব, এবং সর্বপরি রয়েছে ফান্ড ও দক্ষ জনবলের অভাব। সেই রকম একটি প্রেক্ষাপটে এই ধরনের নবীন গবেষকরা আমাদের সত্যিই আশার আলো দেখায়। তাঁর প্রবন্ধে, মেমব্রেন বায়োরিএক্টর (MBR) প্রযুক্তির উন্নয়নের মাধ্যমে কীভাবে শিল্প বর্জ্য জল ব্যবস্থাপনাকে আরও টেকসই করা যায়, তা বিশ্লেষণ করেছেন। প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় MBR প্রযুক্তি কম জায়গা নেয়, বেশি দক্ষ এবং তুলনামূলকভাবে কম খরচে কার্যকর হতে পারে। প্রচলিত অ্যাক্টিভেটেড স্লাজ (CAS) পদ্ধতি এবং তৃতীয় পর্যায়ের পরিস্রাবণকে MBR প্রযুক্তি দ্বারা প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে। তবে MBR প্রযুক্তির কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যেমন স্লাজের মান, যন্ত্রপাতির প্রয়োজনীয়তা এবং ফাউলিং সমস্যা। তবুও, এটি জল পরিশোধনের ক্ষেত্রে একটি টেকসই এবং কার্যকর সমাধান হতে পারে।

ই-বর্জ্য (ইলেকট্রনিক বর্জ্য) হল সেই সব বর্জ্য যা পুরোনো, অপ্রয়োজনীয়, নষ্ট বা অকেজো ইলেকট্রনিক ডিভাইস এবং যন্ত্রপাতি থেকে আসে। এর মধ্যে কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটর, মাইক্রোওয়েভ ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক পণ্য অন্তর্ভুক্ত। ই-বর্জ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে কারণ এই বর্জ্যগুলোতে থাকে ক্ষতিকারক রাসায়নিক উপাদান, যেমন সীসা, পারদ, ক্যাডমিয়াম ইত্যাদি, যা ঠিকমত নিষ্পত্তি না হলে মাটি, পানি ও বায়ু দূষণ করতে পারে।

ই-বর্জ্য পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ বা রিসাইক্লিং এর মাধ্যমে কিছু মূল্যবান উপাদান যেমন ধাতু, প্লাস্টিক ইত্যাদি পুনরায় ব্যবহার করা সম্ভব, যা পরিবেশগত ক্ষতি কমাতে সাহায্য করে। তবে, যথাযথ ব্যবস্থা না থাকলে, এটি মানব স্বাস্থ্যের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।

উনার সাথে ফেসবুকে যোগাযোগ করে সাক্ষাৎকার নেবার আগ্রহ প্রকাশ করলে উনি সানন্দে রাজী হন। তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিকৌশল বিভাগে কর্মরত। বাংলাদেশের মধ্যে ই-বর্জ নিয়ে কাজ করছে এমন গবেষক খুবই কম। তার মধ্যে এক উদিয়মান গবেষক হলেন হৃদয় রায়। তার সাক্ষাৎকারটি নিম্নে পড়ুন:

প্রথমেই আপনার সম্বন্ধে আমাদের একটু বলুন:

আমি হৃদয় রায়, ২রা এপ্রিল, ১৯৯৮ এ চা-বাগানে ঘেরা সিলেটের মৌলভীবাজার জেলায় জন্মগ্রহণ করি। স্কুল-কলেজের পড়াশোনা মৌলভীবাজারের মফস্বলে সম্পন করে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, এবং ২০২২ সালে স্নাতক সম্পন্ন করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২য় (লেভেল-২, টার্ম-১) বর্ষ থেকেই ল্যাবরেটরি-ভিত্তিক গবেষণায় যুক্ত হই, এবং পড়াশোনার পাশাপাশি গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকি। ২০২২ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিকৌশল বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি, এবং ২০২৩ এর এপ্রিলে পূর্ণকালীন শিক্ষক হিসেবে চাকুরীজীবন শুরু করি। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সুযোগ মূলত আমার গবেষণা প্রোফাইলের জন্যই সম্ভব হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকেই আমার গবেষণা কার্যক্রমকে দেশের কাজে লাগানোর প্রয়াস করি। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে তিনটি গবেষণা প্রজেক্টে সহ-গবেষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। সাস্টেনেইবল ম্যাটারিয়ালস তৈরি করে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট করায় জাপানের কিয়ুশু বিশ্ববিদ্যালয়ে সেরা পরিবেশক পুরস্কার লাভ করি। ঢাকা শহরের ওপেন ল্যান্ডফিল এগুলোতে ই-ওয়েস্ট কন্টামিনেশন নিয়ে জার্মানি সংবাদ মাধ্যম “ডয়চে ভেলে” র সাথে কোলাবোরেটিভ প্রজেক্টে প্রটাগনিস্ট হিসেবে কাজ করেছি। ভবিষ্যতে দেশের উন্নয়নে গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে আমি বদ্ধপরিকর।

আপনার গবেষণার বিষয় কি?

গবেষণার জগতে এখনও আমি শিশু তুল্য, তবুও ইতোমধ্যেই কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর বেশ কিছু ক্ষেত্র বিচরণ করেছি। আমার গবেষণার বিষয়কে মূলত ২ টি ভাগে ভাগ করতে চাই: ১) মাইক্রো/ন্যানো স্কেল, এবং ২) ম্যাক্রো-স্কেল। মাইক্রো/ন্যানো স্কেলে আমি মূলত ম্যাটারিয়ালস ডিজাইন নিয়ে কাজ করি, যা দিয়ে পরবর্তীতে দূষিত পানি পরিশোধন, এবং বায়োডিগ্রেডেবল সফট ম্যাটারিয়ালস তৈরি করে থাকি। ম্যাক্রো-স্কেলে আমি মিউনিসিপ্যাল সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট, ইলেক্ট্রিক্যাল ওয়েস্ট রিসাইক্লিং এন্ড রিকভারি, এবং নদীদূষণ ও পুনরুদ্ধার নিয়ে কাজ করে থাকি।

আপনার গবেষণার কাজগুলি কীভাবে আমাদের উপকৃত করছে?

গবেষণা কাজগুলোর একটি বিশেষত্ব হচ্ছে, কিছু গবেষণার সুফল ইমিডিয়েটলি পাওয়া গেলেও, অধিকাংশ গবেষণাই দীর্ঘমেয়াদি ও সাস্টেইনেবল সলিউশন নিয়ে কাজ করে। বাংলাদেশে পরিকল্পনাহীনভাবে বেড়ে উঠা কল-কারখানার কারণে পানি দূষণ মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। কলকারখানা গুলো প্রচুর পরিমাণে ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহার করছে, যার কারণে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, অপরদিকে কলকারখানা থেকে নির্গত দূষিত পানি আমাদের জলাশয়গুলিতে মিশ্রণ হওয়ার কারণে জলাশয়গুলি ব্যবহার উপযোগী থাকছেনা। এই কারণেই, আমি পানি দূষণরোধ করতে দীর্ঘমেয়াদের পদার্থ বা সাস্টেনেইবল ম্যাটারিয়ালস ডিজাইন করার কাজ করছি, যার মাধ্যমে পানি পরিশোধন করা বাস্তবসম্মত এবং সাশ্রয়ী হবে।
অন্যদিকে,মিউনিসিপ্যালিটি থেকে তৈরি হাজার-হাজার টন সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজ করতে ঢাকা শহরের খুব কার্যকর কোন পরিকল্পনা কিংবা অগ্রগতি নেই। তাই, এই সলিড ওয়েস্ট ভ্যালোরাইজেশন এর মাধ্যমে ভ্যালু-এডেড-প্রোডাক্ট তৈরি করা আমার গবেষণার আরেকটি স্কোপ।
বাংলাদেশের জন্য ইদানীং একটি বিশেষ ধরনের বর্জ্য আমাদের উদ্বিগ্নের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে, সেটি হলো ইলেকট্রনিক বর্জ্য বা ই-ওয়েস্ট। কিন্তু এই ই-ওয়েস্টের প্রস্পেক্ট কিন্তু অনেক আশাব্যঞ্জক। ই-ওয়েস্ট থেকে অনেক মূল্যবান ধাতু বের করা সম্ভব, আমরা সেই গবেষণাটি করে যাচ্ছি।

একজন বিজ্ঞানীর কি কি গুণ থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন?

যদিও আমরা গবেষক, বিজ্ঞানী নই। গবেষক বস্তুনিষ্ঠভাবে কাজ করে গেলেই একমাত্র বিজ্ঞানী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। আমি বরং একজন বিজ্ঞান গবেষকের ন্যূনতম যে বৈশিষ্ট্য থাকতে হয় সেগুলিই বলি:
১. গবেষণা পত্র বা রিসার্চ পেপার পড়ার ধৈর্য
২. গবেষণার বিষয় নিয়ে স্পষ্ট ধারণা থাকা
৩. ল্যাবরেটরিতে নিরলস পরিশ্রম করতে পারার মানসিকতা
৪. নিজের ধারণাকে লিখে প্রকাশ করতে পারার ক্ষমতা
৫. ল্যাবরেটরি-লব্ধ ডাটাকে সঠিকভাবে ইন্টারপ্রিটেশন বা ব্যাখ্যা করতে পারা
৬. সহ-গবেষক দের সাহায্য করার মানসিকতা
৭. সহ-গবেষকের সাথে গবেষণা নিয়ে আলোচনা করা
৮. নতুন আইডিয়া জেনারেট করতে পারা

মোটাদাগে, উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো থাকলেই একজন গবেষক পরিপূর্ণ হতে পারেন।

বাংলাদেশের তরুণ শিক্ষার্থী যারা বিজ্ঞানে কাজ করতে চায় – তাদের জন্য আপনার কোন ম্যাসেজ কিংবা বার্তা কি?

বিজ্ঞান এর ক্ষেত্রটা এতটাই বৃহৎ যে এই সেক্টরে কাজ করা মানুষের সংখ্যাও অনেক। বাংলাদেশ হয়ত এইদিক থেকে কিছুটা পিছিয়ে আছে। কিন্তু আশাব্যঞ্জক হলো, বাংলাদেশের তরুণ গবেষকরা দেশে-বিদেশে নিজেদের প্রতিভা প্রতিনিয়ত প্রমাণ করছেন।

বাংলাদেশের তরুণ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে আমি বলবো:
গবেষনার পথ-টা মসৃণ নয়, এখানে যশ-খ্যাতির থেকেও আত্ম-তৃপ্তি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। একাগ্রচিত্তে কাজ করলে গবেষণায় সাফল্য পাওয়া সম্ভব। তাড়াহুড়ো করে কিছুই অর্জন হবে না, এজন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয়-বর্ষ থেকে গবেষণা পত্র পড়া উচিত, আপনার সেক্টর-অফ-ইন্টারেস্ট খুঁজে পাওয়ার জন্য এর বিকল্প নেই, আর সবশেষে বলবো, শিক্ষার্থীদের জন্য সবার সাথে কাজ করতে পারার মনোভাব তৈরি করাটা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।

আপনার যোগাযোগের তথ্য:

hridoyroy @ che.buet.ac.bd

আপনার লিংকডইন সাইটের ওয়েবএড্রেস

https://www.linkedin.com/in/hridoy-roy-798369186

আপনার ওয়েবসাইট, গবেষণা কাজের লিংক ইত্যাদি

https://scholar.google.com/citations?user=nrASVqEAAAAJ&hl=en

আমরা বিজ্ঞানী ডট অর্গ এই নবীন গবেষকের উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি। ধন্যবাদ আমাদেরকে সময় দেবার জন্য।

Share
Written by
ড. মশিউর রহমান -

ড. মশিউর রহমান বিজ্ঞানী.অর্গ এর cofounder যার যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০০৬ সনে। পেশাগত জীবনে কাজ করেছেন প্রযুক্তিবিদ, বিজ্ঞানী ও শিক্ষক হিসাবে আমেরিকা, জাপান, বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুরে। বর্তমানে তিনি কাজ করছেন ডিজিটাল হেল্থকেয়ারে যেখানে তার টিম তথ্যকে ব্যবহার করছেন বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবার জন্য। বিস্তারিত এর জন্য দেখুন: DrMashiur.com

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
সাক্ষাৎকার

পানি গবেষক মোঃ রিপাজ উদ্দিন

পানি আমাদের সবার জীবনে অতপ্রতভাবে জড়িত। তবে পানি নিয়েও কি গবেষনা হতে...

GenZসাক্ষাৎকার

নবীন গবেষক শামফিন হুসাইন কাশফি

নবীন প্রজন্মদের সাক্ষাৎকার সিরিজে এবার আমরা সাক্ষাৎকার নিয়েছি শামফিন হুসাইন কাশফি এর।...

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসাক্ষাৎকার

নবীন প্রজন্মের গবেষক মোহাম্মদ হাসিবুর রহমান

নবীন প্রজন্মদের সাক্ষাৎকার সিরিজে এবার আমরা সাক্ষাৎকার নিয়েছি মোহাম্মদ হাসিবুর রহমান এর।...

সাক্ষাৎকার

স্বয়ংক্রিয় যুক্তিবিদ্যা এর গবেষক সলিমুল চৌধুরী

অটোমেটেড রিজনিং বা স্বয়ংক্রিয় যুক্তিবিদ্যা এর সাথে আমরা পরিচিত নাও থাকতে পারি।...

GenZসাক্ষাৎকার

GenZ গবেষক অন্ত শাহরিয়ার

ফোটোনিক ডিভাইস, মিডিয়ার ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক বৈশিষ্ট্যে সাময়িক বিচ্ছিন্নতা, মেটাসারফেস, মেটামেটেরিয়াল এবং অ্যান্টেনা এর...

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.

যোগাযোগ: biggani.org@জিমেইল.com

Copyright © biggani.org