হীরা এর গয়না কিনতে যেহেতু অনেক টাকা ব্যায় করতে হয় তাই একটু সাবধানে কেনা উচিত। তবে, বাজারে নকল হীরার পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেকেই চিন্তিত হন যে তারা সত্যিকারের হীরা কিনেছেন কিনা। হীরা কেনার সময় তা আসল কিনা যাচাই করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি কেবলমাত্র আপনার বিনিয়োগের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে না, বরং আপনাকে মানসিক স্বস্তিও দেবে।
এই প্রবন্ধে, আমরা কিভাবে আপনি নিজের কেনা হীরা আসল কিনা তা যাচাই করতে পারেন তার বিভিন্ন উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব। যদিও এই প্রক্রিয়াগুলো আপনার হীরার সত্যতা যাচাই করতে সহায়ক হবে, তবে পেশাদার পরীক্ষাও একান্ত প্রয়োজন।
১. সার্টিফিকেশন পরীক্ষা করুন
সর্বপ্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আপনার কেনা হীরার সাথে একটি সার্টিফিকেশন থাকা উচিত। GIA (Gemological Institute of America), AGS (American Gem Society), HRD (Hoge Raad voor Diamant), বা IGI (International Gemological Institute) এর মতো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রাপ্ত সার্টিফিকেট হীরার মান এবং সত্যতা নিশ্চিত করে। এই সার্টিফিকেটে হীরার সঠিক ওজন, কাটা, রঙ, স্বচ্ছতা এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য উল্লেখ থাকে। হীরা কেনার সময় এই সার্টিফিকেট পরীক্ষা করুন এবং নিশ্চিত করুন যে এটি বিশ্বস্ত উৎস থেকে প্রাপ্ত।
২. হীরার প্রতিসরণ ক্ষমতা পরীক্ষা
হীরা তার প্রতিসরণ ক্ষমতার জন্য বিখ্যাত, যা আলোকে এমনভাবে প্রতিফলিত করে যে তা উজ্জ্বলতা এবং জ্বলজ্বল করে। একটি সাধারণ পরীক্ষা হলো, একটি ছোট লেখা বা সংবাদপত্রের ওপর হীরা রেখে তা দেখে নেওয়া। যদি হীরার মধ্য দিয়ে আপনি লেখা পরিষ্কার দেখতে পারেন, তাহলে এটি আসল নয়। আসল হীরা আলোকে এতটাই প্রতিসরণ করে যে এর মধ্য দিয়ে লেখা বা বস্তু পরিষ্কার দেখা সম্ভব নয়।
৩. কাঁচের ওপর খোদাই পরীক্ষা
আসল হীরা পৃথিবীর সবচেয়ে শক্ত পদার্থগুলোর একটি, তাই এটি সহজেই কাঁচ বা কাচের বস্তুতে খোদাই করতে সক্ষম। আপনি যদি নিজের হীরাটি পরীক্ষা করতে চান, তবে একটি কাঁচের পৃষ্ঠের ওপর এটি ঘষে দেখতে পারেন। যদি হীরা কাঁচের ওপর স্ক্র্যাচ তৈরি করে, তাহলে এটি আসল হতে পারে। তবে, এই পরীক্ষা করার সময় সতর্ক থাকুন, কারণ এটি হীরাতে দাগ ফেলতে পারে।
৪. পানি পরীক্ষা
হীরার ঘনত্ব অত্যন্ত বেশি, তাই এটি পানিতে ডুবিয়ে রাখলে ডুবে যায়। আপনি যদি সন্দেহ করেন যে আপনার হীরা আসল কিনা, তাহলে একটি পানিভর্তি গ্লাসে হীরাটি ডুবিয়ে দিন। যদি হীরাটি ডুবে যায়, তবে এটি আসল হতে পারে। অন্যদিকে, যদি এটি ভেসে ওঠে বা গ্লাসের মধ্যে সোজা থাকে, তাহলে এটি নকল হতে পারে।
৫. শ্বাস পরীক্ষা
হীরার তাপ পরিবাহিতা অত্যন্ত বেশি, তাই এটি সহজেই তাপ শোষণ করে। একটি সহজ পরীক্ষা হলো, হীরার ওপর শ্বাস ফেলুন এবং দেখুন কুয়াশা কতক্ষণ থাকে। আসল হীরা দ্রুত তাপ শোষণ করে এবং কুয়াশা খুব দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যায়। তবে, নকল হীরা বা স্ফটিকের ক্ষেত্রে কুয়াশা অনেকক্ষণ থাকে।
৬. ব্ল্যাক লাইট পরীক্ষা
কিছু আসল হীরা ব্ল্যাক লাইটের (UV আলো) নিচে নীলাভ প্রতিফলন করে, যা ফ্লুরোসেন্স নামে পরিচিত। আপনি যদি একটি ব্ল্যাক লাইটের সাহায্যে আপনার হীরা পরীক্ষা করেন এবং এটি নীলাভ আলো প্রকাশ করে, তাহলে এটি আসল হতে পারে। তবে, মনে রাখবেন সব হীরারই ফ্লুরোসেন্স থাকে না, তাই এটি নিশ্চিতকরণের একটি উপায় হলেও সর্বশেষ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অন্যান্য পরীক্ষা করাও গুরুত্বপূর্ণ।
৭. তাপ পরীক্ষা
হীরা তাপ পরিবাহিতার জন্য বিখ্যাত, যা অন্য অনেক পদার্থের তুলনায় বেশি। একটি তাপ পরীক্ষা করতে, হীরাটিকে একটি গরম বাতাসের চুলার কাছে নিয়ে যান এবং তা কয়েক সেকেন্ডের জন্য উত্তপ্ত করুন। তারপর দ্রুত ঠান্ডা পানিতে ডুবিয়ে দিন। যদি হীরাটি ফাটে না বা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তাহলে এটি আসল হতে পারে। নকল হীরা তাপমাত্রার পরিবর্তনে ফেটে যেতে পারে।
৮. পেশাদার পরীক্ষা
উপরের পরীক্ষাগুলো আপনার হীরার সত্যতা যাচাই করতে সহায়ক হলেও, পেশাদার পরীক্ষার কোনো বিকল্প নেই। আপনি একটি বিশ্বস্ত জুয়েলারি দোকানে বা জেমোলজিস্টের কাছে আপনার হীরা নিয়ে যেতে পারেন, যেখানে তারা বিশেষ যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে হীরার সত্যতা নির্ধারণ করবে। তারা সাধারণত মাইক্রোস্কোপ, স্পেকট্রোমিটার, এবং অন্যান্য পরীক্ষার মাধ্যমে হীরার গুণগত মান নির্ধারণ করে।
৯. ইলেকট্রনিক ডায়মন্ড টেস্টার
ইলেকট্রনিক ডায়মন্ড টেস্টার একটি জনপ্রিয় যন্ত্র, যা হীরার তাপ পরিবাহিতা নির্ধারণ করতে ব্যবহৃত হয়। এটি হীরার পৃষ্ঠে স্পর্শ করলে তাৎক্ষণিকভাবে জানিয়ে দেয় যে এটি আসল কিনা। তবে, কিছু নকল হীরা, যেমন মোইসানাইট, যা হীরার মতোই তাপ পরিবাহিতা রাখে, এই টেস্টে পাস করতে পারে। তাই, এই যন্ত্রটি শুধুমাত্র একটি প্রাথমিক পরীক্ষা হিসেবে বিবেচনা করুন।
১০. নকল হীরার পরিচিতি
নকল হীরা চেনার জন্য কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য জানা গুরুত্বপূর্ণ। স্ফটিক, জিরকনিয়া, এবং মোইসানাইটসহ বিভিন্ন নকল হীরা বাজারে পাওয়া যায়, যেগুলি দেখতে আসল হীরার মতোই হতে পারে। তবে, এগুলির প্রতিসরণ ক্ষমতা, তাপ পরিবাহিতা, এবং ওজন প্রায়ই আসল হীরার থেকে আলাদা হয়। এই নকল হীরা চেনার জন্য, একটি অভিজ্ঞ জেমোলজিস্টের পরামর্শ নেওয়া সবচেয়ে ভালো।
উপসংহার
হীরা কেনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ, এবং তা আসল কিনা যাচাই করা আবশ্যক। যদিও উপরের পরীক্ষাগুলো আপনাকে সহায়তা করতে পারে, তবে পেশাদার পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া সর্বোত্তম পদ্ধতি। একটি বিশ্বস্ত জুয়েলারি দোকান থেকে হীরা কেনা এবং সার্টিফিকেশন চেক করা আপনার বিনিয়োগকে সুরক্ষিত রাখার প্রথম ধাপ। মনে রাখবেন, আসল হীরা শুধুমাত্র সৌন্দর্যই নয়, এটি একটি মূল্যবান সম্পদও। তাই, কেনার আগে এবং পরে সবসময় সতর্ক থাকুন এবং হীরার সত্যতা যাচাই করুন।
Leave a comment