ড. এম. আর. খান (১৯১৬–২০০৯) ছিলেন বাংলাদেশের শিশুস্বাস্থ্য সেবার অন্যতম প্রবক্তা, যিনি পাঁচের দশক থেকে শুরু করে প্রায় অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে দেশের শিশুস্বাস্থ্য, জনস্বাস্থ্য নীতি ও মেডিকেল শিক্ষা কাঠামোর উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রেখেছেন। তিনি ছিলেন স্বনামধন্য শিশু বিশেষজ্ঞ (পেডিয়াট্রিশিয়ান) এবং গবেষক, যিনি কেবলমাত্র চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন না; বরং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নীতিগত প্রেক্ষিত বিবেচনায় নিয়ে দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে বদলে দিতে চেয়েছিলেন।
প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা:
এম. আর. খানের জন্ম তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতের অধীনে বর্তমান বাংলাদেশের ভূখণ্ডে। শৈশব থেকেই তিনি শিক্ষা ও সমাজসেবার গুরুত্ব বুঝতে শিখেছিলেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য তিনি দেশ-বিদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করেন। অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান সঞ্চয়ের পর দেশে ফিরে এসে তিনি শিশুস্বাস্থ্য সেবা ও জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর ও গণমুখী করে তুলতে ব্রতী হন।
শিশুস্বাস্থ্য ও মেডিকেল গবেষণায় অগ্রণী ভূমিকা:
পঞ্চাশের দশক থেকেই এম. আর. খান শিশুস্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষণা ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে এক নতুন ধারা তৈরি করেন। সে সময় ডায়রিয়া, অপুষ্টি, সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া সহ শিশুমৃত্যুর হার ছিল উদ্বেগজনকভাবে বেশি। তিনি শিশুদের পুষ্টি, পরিচ্ছন্নতা, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিস্তৃত গবেষণা করেন। এর ফলে দেশীয় প্রেক্ষাপটে শিশুস্বাস্থ্য নিয়ে এক নতুন মাত্রা যুক্ত হয়।
তিনি বুঝেছিলেন যে শুধু হাসপাতালকেন্দ্রিক চিকিৎসাই যথেষ্ট নয়; দরকার সামাজিক সচেতনতা, পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহণ, এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার পরিসর বাড়ানো। তাঁর গবেষণা ও নির্দেশনা অনুযায়ী শিশুস্বাস্থ্য সেবা উন্নত করতে বিভিন্ন কর্মসূচি গৃহীত হয়, যা পরবর্তীতে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে প্রতিফলিত হয়।
জনস্বাস্থ্যনীতি ও নীতিনির্ধারণে অবদান:
এম. আর. খান চিকিৎসা সেবাকে কেবলমাত্র একটি ক্লিনিক্যাল পদ্ধতিতে সীমাবদ্ধ থাকতে দেননি। তিনি জনস্বাস্থ্য নীতিগুলি কিভাবে শিশুদের জন্য অনুকূল করা যায়, সেই প্রশ্নে সবসময় সোচ্চার ছিলেন। শিশুদের জন্য টিকাদান কর্মসূচির প্রসার, দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় স্বাস্থ্যশিক্ষার সম্প্রসারণ, এবং মাতৃস্বাস্থ্য-শিশুস্বাস্থ্য সংযোগ স্থাপনে তাঁর সুপারিশসমূহ ছিল দূরদর্শী।
জনস্বাস্থ্য নীতি নির্ধারণে তাঁর গবেষণালব্ধ তথ্য ও পরামর্শ নীতিনির্ধারকদের জন্য ছিল অত্যন্ত মূল্যবান। তিনি স্বাস্থ্যনীতিতে টেকসই উন্নয়ন, স্থানীয় চাহিদার মূল্যায়ন, এবং স্বাস্থ্যবিষয়ক অবকাঠামোর উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ওপর জোর দিয়েছিলেন। এর ফলে শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি হ্রাস, জন্মের পর থেকে নিরাপদ শৈশব নিশ্চিতকরণ, এবং শিশুমৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়।
মেডিকেল শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও প্রতিষ্ঠান গঠন:
ড. এম. আর. খান উপলব্ধি করেছিলেন যে এক পরিণত স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়তে গেলে দক্ষ চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী তৈরি করা অপরিহার্য। তাই তিনি মেডিকেল শিক্ষার কাঠামো ও পাঠ্যক্রম সংস্কারে মনোনিবেশ করেন। পাঠ্যক্রমে শিশুস্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়সমূহকে আরও গুরুত্ব দেওয়া, গবেষণা-নির্ভর শিক্ষা, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কিভাবে কার্যকর করা যায় সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের মানবিক মূল্যবোধে দৃঢ় করতে তিনি অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।
একটি কার্যকর স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য চিকিৎসকদের শুধু রোগ চিকিৎসা নয়, প্রাথমিক প্রতিরোধ, পুষ্টি ব্যবস্থাপনা, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং শিশুস্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যাগুলোর অন্তর্নিহিত কারণ চিহ্নিত করার ওপর জোর দেন। তাঁর এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি নতুন প্রজন্মের চিকিৎসক, নার্স, প্যারামেডিক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের অনুপ্রাণিত করে।
সামাজিক সচেতনতা ও স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম:
হাসপাতালের গণ্ডির বাইরে গিয়ে ড. এম. আর. খান সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর কাজ করতেন। তিনি স্বাস্থ্যবিষয়ক সেমিনার, কর্মশালা, ও প্রশিক্ষণমূলক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পিতা-মাতা, অভিভাবক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় কমিউনিটিগুলোকে শিশুস্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন করে তোলেন। গ্রামীণ ও অনগ্রসর এলাকায় স্বাস্থ্যসেবার প্রসার ঘটাতে এবং সবার জন্য সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে তিনি নিরলস প্রচেষ্টা চালান।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সম্মাননা:
ড. এম. আর. খান একজন বিশ্বমানের শিশু চিকিৎসাবিদ হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেন। তাঁর গবেষণা ও নীতিনির্ধারণী পরামর্শ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছেও সমাদৃত হয়। বাংলাদেশের শিশুস্বাস্থ্য সেবার উন্নয়ন এবং জনস্বাস্থ্যনীতিতে পরিবর্তন আনতে তাঁর অবদান দেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরেও মূল্যায়িত হয়।
উত্তরাধিকার ও প্রভাব:
২০০৯ সালে তাঁর মৃত্যু হলেও তিনি রেখে গেছেন সুদৃঢ় একটি ভিত্তি। বাংলাদেশের শিশুস্বাস্থ্য এখন আগের চেয়ে অনেক উন্নত, অপুষ্টি ও সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে, এবং টিকাদান কর্মসূচির প্রসারের ফলে শিশুদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমান প্রজন্মের চিকিৎসক, গবেষক এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা এম. আর. খানের দর্শন ও কর্মধারাকে অনুসরণ করে শিশুস্বাস্থ্য সম্পর্কে আরও ব্যাপক গবেষণা, নীতিমালা প্রণয়ন, এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির কাজে লাগাচ্ছেন।
উপসংহার:
ড. এম. আর. খান ছিলেন এমন একজন অগ্রপথিক, যিনি শুধু চিকিৎসা বা গবেষণার গণ্ডিতে আটকে থাকেননি। তিনি বুঝেছিলেন যে সত্যিকার স্বাস্থ্যসেবা হলো জীবনব্যাপী সচেতনতা, প্রতিরোধ, এবং সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির একটি সামগ্রিক প্রক্রিয়া। শিশুস্বাস্থ্যের উন্নয়ন, জনস্বাস্থ্য নীতিতে পরিবর্তন, এবং মেডিকেল শিক্ষায় দূরদৃষ্টি ছিল তাঁর অনন্য অবদান। তাঁর জীবনগাঁথা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে মানবিক বিবেচনা, গবেষণামূলক চিন্তাভাবনা, এবং নিবেদিত মনোভাব মিলে যখন কাজ করে, তখন একটি জাতির শিশুদের জন্য সুরক্ষিত ও স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।
Leave a comment