প্রফেসর ড. মোহা: ইয়ামিন হোসেন
ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশের কৃষি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বৈশ্বিক মানে উন্নীত করতে এবং তাদের র্যাঙ্কিং উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করতে, প্রচলিত ভিসি নিয়োগ পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। বৈষম্যহীনভাবে স্বনামধন্য ও খ্যাতিমান বিজ্ঞানীদের উপাচার্য (ভিসি) হিসেবে নিয়োগ দিলে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিং বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হবে। নিচে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
১. ভিসি নিয়োগের প্রচলিত পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা:
বর্তমান নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ভিসি হিসেবে নির্বাচিতদের অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক সংযোগ বা ব্যক্তিগত পরিচিতি প্রাধান্য পায়। এর ফলে বিভিন্ন সময়ে এমন ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হয় যারা সুশিক্ষিত এবং অভিজ্ঞ হলেও, বৈজ্ঞানিক গবেষণা বা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সুনাম অর্জনের ক্ষেত্রে তাদের অবদান সীমিত। এই পদ্ধতির মাধ্যমে খ্যাতিমান এবং দক্ষ বিজ্ঞানী বা শিক্ষাবিদদের উপেক্ষা করা হয়, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
২. খ্যাতিমান বিজ্ঞানী হিসেবে ভিসি নিয়োগের প্রভাব:
গবেষণা এবং উদ্ভাবনের মানোন্নয়ন:
খ্যাতিমান বিজ্ঞানীরা সাধারণত গবেষণার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন কাজ করে থাকেন এবং তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা সংস্কৃতিতে বিশাল পরিবর্তন আনতে সক্ষম। তাদের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণা করার প্রবণতা ও সুযোগ বৃদ্ধি পায় এবং নতুন নতুন উদ্ভাবনের সূচনা হয়।
আন্তর্জাতিক যোগাযোগ এবং সহযোগিতা:
খ্যাতিমান বিজ্ঞানীরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত এবং তাদের যোগাযোগের ক্ষেত্রটি বিস্তৃত। তারা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহযোগিতামূলক গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেন যা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগত মান বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।
র্যাঙ্কিংয়ে উন্নয়ন:
খ্যাতিমান ভিসির নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা এবং উদ্ভাবনের মান বৃদ্ধি পাওয়ায় আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিং এ উন্নয়ন ঘটে। কারণ, বৈশ্বিক র্যাঙ্কিং অনেকাংশেই গবেষণা প্রকাশনা, উদ্ধৃতি সংখ্যা, এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল।
৩. বৈষম্যহীন নিয়োগ প্রক্রিয়া:
যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ:
বৈষম্যহীন নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ভিসি নিয়োগের জন্য মূলত তার গবেষণা কাজ, আন্তর্জাতিক সুনাম, শিক্ষাদানের অভিজ্ঞতা এবং নেতৃত্বের গুণাবলীকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। রাজনৈতিক সংযোগ বা অন্য কোনো বাহ্যিক প্রভাব থেকে মুক্ত থেকে এ ধরনের যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রদান করা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক মান বৃদ্ধি পাবে।
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা:
নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বজায় রাখা এবং যোগ্য প্রার্থীদের নিয়ে একটি নিরপেক্ষ কমিটি গঠন করে তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হলে মেধাবী বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদদেরকে ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। এতে কোনো ধরনের পক্ষপাত বা বৈষম্যের সুযোগ থাকে না।
৪. বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নে প্রভাব:
শিক্ষার মান বৃদ্ধি:
অভিজ্ঞ এবং খ্যাতিমান ভিসির নেতৃত্বে শিক্ষার মান উন্নত হয়। শিক্ষার্থীদের মধ্যে গবেষণার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয় এবং তারা উন্নত মানের শিক্ষার মাধ্যমে নিজেদের গড়ে তুলতে পারে।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি:
খ্যাতিমান বিজ্ঞানীদের ভিসি হিসেবে নিয়োগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আনার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করা সম্ভব হয়, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈচিত্র্য এবং গুণগত মানকে আরও সমৃদ্ধ করে।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন:
বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং উদ্ভাবন দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলি বিভিন্ন শিল্পের সাথে সহযোগিতা করতে পারে এবং এর ফলে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে।
৫. সামাজিক এবং নৈতিক দিক:
সমতার প্রতিষ্ঠা:
বৈষম্যহীনভাবে যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ করা হলে সমাজে এক ধরনের সমতা প্রতিষ্ঠা পায়। এর ফলে সবাই যোগ্যতার ভিত্তিতে মূল্যায়িত হয় এবং সমাজে ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠা হয়।
নেতৃত্বের উদাহরণ:
খ্যাতিমান বিজ্ঞানীদের ভিসি হিসেবে নিয়োগ সমাজের অন্যান্য অংশেও একটি উদাহরণ তৈরি করে। এটি প্রতিভাবান এবং মেধাবী ব্যক্তিদেরকে উদ্বুদ্ধ করে, যা সামগ্রিকভাবে দেশের জন্য ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনে।
প্রস্তাবিত ভিসি নিয়োগ পদ্ধতির বিশদ বিশ্লেষণ
বাংলাদেশের কৃষি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন পদ্ধতির অধীনে, ভিসি হিসেবে যোগ্যতা নির্ধারণের জন্য নিম্নোক্ত মানদণ্ডগুলি বিবেচনা করা যেতে পারে:
১. গবেষণা ও প্রকাশনার মানদণ্ড:
@ মোট প্রকাশনার সংখ্যা: একটি প্রার্থীর প্রকাশিত গবেষণাপত্রের সংখ্যা তার গবেষণা কর্মের পরিমাণ (কমপক্ষে ১০০ হতে হবে) এবং বিস্তৃতির একটি সূচক। উচ্চ মানের গবেষণা এবং গবেষণার গভীরতা এই মানদণ্ডের মাধ্যমে প্রতিফলিত হতে পারে।
স্কোপাসে প্রকাশিত পেপারের সংখ্যা:
স্কোপাস বা অন্যান্য উচ্চ প্রভাবশালী ডেটাবেসে প্রকাশিত গবেষণাপত্রের সংখ্যা (কমপক্ষে ৫০টা হতে হবে) গবেষণার মান এবং বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতার একটি সূচক।
পেপারের সাইটেশন সংখ্যা:
গবেষণাপত্রের সাইটেশন সংখ্যা (কমপক্ষে ২০০০ হতে হবে) গবেষণার প্রভাব ও স্বীকৃতির অন্যতম মাপকাঠি। এটি গবেষণা কতটা প্রভাব ফেলছে বা অন্য গবেষকরা কতোটা তা ব্যবহার করছেন তার একটি ধারণা দেয়।
h-ইনডেক্স ও i10-ইনডেক্স:
গবেষকের h-ইনডেক্স (কমপক্ষে ৩০ হতে হবে) এবং i10-ইনডেক্স (কমপক্ষে ৫০ হতে হবে) গবেষণার মান, ধারাবাহিকতা এবং গ্রহণযোগ্যতার পরিমাপ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
২. শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা:
Ph.D. এবং Postdoc ডিগ্রি:
একটি প্রার্থীর উচ্চশিক্ষাগত যোগ্যতা তার একাডেমিক দক্ষতা (পিএইচডি থাকতেই হবে) এবং গবেষণার প্রতি তার প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন করে (পোস্ট-ডক থাকতে হবে)।
সুপারভাইজর হিসেবে অভিজ্ঞতা:
পিএইচডি (কমপক্ষে ৫টা), এমফিল/ এমএস (কমপক্ষে ১৫ টা) এবং ব্যাচেলর ডিগ্রি (কমপক্ষে ৫ টা) পর্যায়ে সুপারভাইজর হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীদের গবেষণা কর্মে দিকনির্দেশনা প্রদান এবং তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।
৩. গবেষণা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক:
দেশী-বিদেশী এওয়ার্ড ও গবেষণা কলাবরেশন:
দেশী-বিদেশী গবেষণা পুরস্কার (কমপক্ষে ১ টা এওয়ার্ড) ও সহযোগিতা প্রার্থীর গবেষণার মান এবং আন্তর্জাতিক গবেষণা সম্প্রদায়ে (দেশি বিদেশী মিলে ৩-৫ টা কলাবরেশন) তার অবদানকে নির্দেশ করে।
গবেষণা প্রজেক্টের সংখ্যা:
একজন প্রার্থী কতগুলি গবেষণা প্রকল্পে নেতৃত্ব দিয়েছেন বা অংশগ্রহণ করেছেন(দেশী বিদেশি মিলে কমপক্ষে ৫টা থাকতে হবে) তা তার গবেষণা কার্যক্রমের পরিসর এবং গভীরতার মাপকাঠি হতে পারে।
গবেষক হিসেবে ফেলোদের প্রতি কতব্য ও প্রাপ্তি:
দেশি ও বিদেশি ফেলোদের গবেষণা কর্মে সহযোগিতা করা এবং তাদের জন্য গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করা প্রার্থীর নেতৃত্ব ও সমর্থনের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
৪. শিক্ষার্থীদের উন্নয়ন ও প্রশাসনিক দক্ষতা:
ছাত্র-ছাত্রী ও ফেলোদের উন্নয়নে ভূমিকা:
শিক্ষার্থীদের একাডেমিক এবং পেশাগত উন্নয়নে প্রার্থীর অবদান তার নেতৃত্বের ক্ষমতা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রভাবিত করার সামর্থ্যের সূচক।
প্রশাসনিক দায়িত্ব:
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্ব যেমন প্রজেক্ট ডিরেক্টর (PD) হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা প্রার্থীর প্রশাসনিক দক্ষতা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নির্দেশ করে।
৫. ভিসি হওয়ার পরে ভিশন ও মিশন:
দেশের ও আন্তর্জাতিক উন্নয়নে অবদান:
প্রার্থীর ভিশন ও মিশন যা শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, বরং দেশের শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং সামগ্রিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
দুর্নীতিমুক্ত এবং জনপ্রিয়তা:
দুর্নীতিমুক্ত থাকা এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা প্রার্থীর ব্যক্তিত্বের সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
৬. গবেষণা ও একাডেমিক ক্ষেত্রে অবদান:
গবেষণার র্যাঙ্কিং এবং জার্নালের এডিটরের দায়িত্ব:
প্রার্থীর গবেষণাপত্রের র্যাঙ্কিং এবং আন্তর্জাতিক জার্নালগুলোর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন তার গবেষণার গুণগত মান এবং দক্ষতা প্রতিফলিত করে।
রিভিউয়ার এবং থিসিসের পরীক্ষক হিসেবে দায়িত্ব:
গবেষণাপত্রের পর্যালোচক বা থিসিস পরীক্ষক হিসেবে কাজ করা প্রার্থীর দক্ষতা এবং একাডেমিক পরিবেশে তার অবদান নির্দেশ করে।
৭. সামাজিক ও প্রশাসনিক দায়িত্ব:
সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ:
সাধারণ মানুষের উন্নয়নে প্রার্থীর অবদান, সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ এবং নেতৃত্বের গুণাবলী তার সম্প্রদায় ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা নির্দেশ করে।
কনফারেন্সে কি-নোট স্পিকার ও দায়িত্ব পালন:
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে কি-নোট স্পিকার হিসেবে বক্তব্য দেওয়া এবং কনফারেন্সের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন প্রার্থীর বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা এবং দক্ষতা প্রদর্শন করে।
৮. শিক্ষা ও গবেষণার প্রতি প্রতিশ্রুতি:
নিয়মিত ক্লাস ও পরীক্ষা কমিটিতে দায়িত্ব পালন:
প্রার্থীর নিয়মিত ক্লাস নেওয়া, পরীক্ষার কমিটিতে দায়িত্ব পালন, এবং স্বেচ্ছাসেবী সেবায় অংশগ্রহণ তার শিক্ষার প্রতি দায়বদ্ধতা এবং প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত করে।
উপসংহার:
উপরোক্ত সকল যোগ্যতা বিবেচনা করে খ্যাতিমান বিজ্ঞানীদের ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলে, এটি বাংলাদেশে কৃষি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাঙ্কিং উন্নয়নের জন্য একটি অত্যন্ত কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে। এভাবে একটি বৈষম্যহীন, দক্ষ এবং স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা যাবে যা শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতি নয়, বরং দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হতে পারে।
Leave a comment