অন্যান্য

ব্রডক্লাব কাট্লফিশ্

Share
Share

আপনাকে কেউ কোনদিন সম্মোহন (হিপ্নোটাইজ্) করেছে ? আসলে যে কোন মস্তিষ্ক সর্বদা নিজেকেই উপলব্ধি করে চলে – এই উপলব্ধিকেই বলে “চেতনা” বা “অ্যাওয়ারনেস্”। তবে এই উপলব্ধি দুইভাবে সম্ভব – সরাসরি এবং চারপাশের পরিবেশের মধ্য দিয়ে। আপনার মস্তিষ্কের সম্মোহিত অবস্থা বা “হিপ্নোসিস্” হলো এমন অবস্থা যখন আপনার চেতনা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় – একটি ভাগে মস্তিষ্ক নিজেকে সরাসরি উপলব্ধি করতে থাকে যা সম্মোহনকারী বা আপনার নিয়ন্ত্রণে থাকে না কিন্তু অপর ভাগটিতে মস্তিষ্ক পারিপার্শ্বিক পরিবেশের মাধ্যমে নিজেকে উপলব্ধি করতে থাকে যা অনেকটাই সম্মোহনকারীর বশে থাকে। তাহলে বুঝতেই পারছেন যে সম্মোহন করা খুব একটা সহজ কাজ নয়। রীতিমত প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরই একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে সম্মোহন করার কায়দাটা রপ্ত করতে পারেন।

তবে প্রকৃতিতে এমন প্রাণীও আছে যার সম্মোহন করার ক্ষমতাটি সহজাত ! এরা দ্বিতীয় বৃহত্তম “সেপাইডা” বা “কাট্লফিশ্”, অর্থাৎ এরা অক্টোপাস বা স্কুইডের মতই “কেফালোপোডা” শ্রেণীর অর্ন্তভুক্ত। এদের দেহকান্ড বলে কিছু নেই, তবে এদের বাহু থাকে আটটি। এদের আটটি বাহু সরাসরি এদের মাথার সাথে যুক্ত থাকে বলেই এদের “কেফালোপোড” বলে। কর্ষিকা বা টেনট্যাকল্ সমেত এরা সর্বাধিক পঞ্চাশ সেন্টিমিটার দীর্ঘ আর এদের ওজন হয় অন্তত দশ কেজি। ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্রবালপ্রাচীর হলো এদের বাসস্থান। এদের মধ্যে পুরুষেরা স্ত্রী অপেক্ষা আকারে কিছুটা বড় হয়। এদের সমগ্র শরীরের পরিধি বরাবর যে নরম পাখনাগুলি থাকে সেগুলিকে উপর থেকে নীচে ও নীচ থেকে উপরে ক্রমাগত কাঁপিয়ে ধীর গতিতে এরা সমুদ্রের জলে সাঁতার কেটে চলে। এদের শরীরে “ম্যান্টল্” নামক একটি ফাঁকা স্থান থাকে যেখানে এদের ফুলকাগুলি থাকে। এরা সমুদ্রের জল শোষণ করার পর সেই জল এই “ম্যান্টল্”-এ আসে যেখানে ফুলকাগুলি সেই জলে দ্রবীভূত অক্সিজেন শোষণ করে নিয়ে শ্বাসকার্য চালায়। কখনও জলের মধ্যে দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন পড়লে, এরা “ম্যান্টল্”-এ সংগৃহীত জলকেই “সাইফন” নামক পেশীময় নলের মত অংশের সাহায্যে স্রোতের আকারে তীব্র বেগে দেহের পশ্চাৎভাগ থেকে নিষ্কাশন করতে থাকে – ফলে এরা সহজেই জেট প্লেনের মত দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। শুধু তাই নয়, এদের শরীরের অন্তর্কঙ্কাল “কাট্লবোন্” হলো বস্তুত একটি ছিদ্রময় আভ্যন্তরীণ খোল যার মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রকোষ্ঠ থাকে। এই প্রকোষ্ঠগুলিতে তরল ও গ্যাসের পরিমাণ বাড়িয়ে বা কমিয়ে এরা এদের পুরো শরীরের উপর সমুদ্রের জল কর্তৃক প্রযুক্ত প্লবতা বলকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ফলস্বরূপ; খুব কম পরিশ্রম করেই এরা সমুদ্রের নির্দিষ্ট গভীরতায় ভেসে থাকতে পারে, যেমন শিকার ধরার সময় এরা সমুদ্রের তলদেশের কাছাকাছি ভেসে বেড়ায় ও পছন্দের শিকার যেমন কাঁকড়া, গলদা চিংড়ি, কুচো চিংড়ি, গুগলিশামুক, মাছ ইত্যাদি ধরে খায়। এরা এদের দুই কর্ষিকার সাহায্যে শিকারকে পাকড়াও করে মুহূর্তের মধ্যে তাকে মুখে চালান করে দেয়। শিকারকে শক্ত করে ধরার জন্য এদের কর্ষিকার ডগায় বাঁকা চওড়া প্যাড-র মত অংশ বা “ব্রডক্লাব” থাকে, এছাড়াও এদের শরীরে রয়েছে “কাট্লবোন্” যা আগেই বলেছি – এই দুই কারণে এদের নাম দেওয়া হয়েছে “ব্রডক্লাব কাট্লফিশ্”।

এখন “ব্রডক্লাব কাট্লফিশ্”-র সম্মোহন করার ক্ষমতা নিয়ে আলোচনা করব। জানলে হয়ত অবাক হবেন যে এদের এই ক্ষমতা নিহিত থাকে এদের দেহ-ত্বকে। এদের দেহ-ত্বকে মোট চারটি স্তর থাকে। প্রথম তিনটি স্তরে থাকে কয়েক মিলিয়ন রঞ্জক-কোষ। স্থিতিস্থাপক প্রতিটি রঞ্জক-কোষকে টেনে আকারে বড় করার জন্য প্রতিটি রঞ্জক-কোষ তার পরিধি বরাবর কয়েকটি পেশীর সাথে যুক্ত থাকে, আবার ঐ পেশীগুলি পরিচালিত হয় এদের মস্তিষ্কের এক-একটি স্নায়ুকোষ দ্বারা। দেহ-ত্বকের সবচেয়ে উপরের স্তরটিতে থাকে হলুদ রঙের রঞ্জক-কোষ। তার পরের দুটি স্তরের প্রথমটিতে লাল ও দ্বিতীয়টিতে বাদামী রঞ্জক-কোষ ছড়ানো থাকে। এক একটি হলুদ বা লাল বা বাদামী রঞ্জক-কোষের সাহায্যে এরা এদের ত্বকে যথাক্রমে হলুদ বা লাল বা বাদামী রঙের ছোট্ট ছোপ বা বিন্দু ফুটিয়ে তুলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ; দেহ-ত্বকে একটা ছোট্ট হলুদ রঙের বিন্দু ফুটিয়ে তোলার জন্য ব্রডক্লাব কাট্লফিশ্-র মস্তিষ্কের একটি নির্দিষ্ট স্নায়ুকোষ উদ্দীপিত হয়ে ওঠে যা তার দেহ-ত্বকের একটি হলুদ রঞ্জক-কোষের চারপাশের পেশীর উপর জোর দেয় যাতে পেশীগুলি রঞ্জক-কোষটিকে টেনে প্রসারিত করতে পারে, ফলে হলুদ রঞ্জক-কোষটি প্রসারিত হয়ে একটি ছোট্ট হলুদ রঙের ছোপ বা বিন্দুর রূপ নেয়। আবার স্নায়ুকোষটি নিস্তেজ হলে পেশীগুলিও শিথীল হয়ে যাওয়ায় হলুদ রঞ্জক-কোষটি আবার সঙ্কুচিত হয়ে পূর্বের আকারে ফিরে যায় ও ফলে হলুদ রঙের বিন্দুটিও অদৃশ্য হয়ে যায়। ব্রডক্লাব কাট্লফিশ্ তার ত্বকের রঞ্জক-কোষগুলিকে কয়েকটি ভিন্ন দলে বিভক্ত করে নিয়ে একটা নির্দিষ্ট ছন্দে যখন তাদেরকে প্রসারিত ও সঙ্কুচিত করে, তখন তাদের দেহ-ত্বকে রঙের খেলা দেখে আপনার মনে হবে যে আপনি যেন দূর্গাপূজো বা কালীপূজোয় বৈদ্যুতিক আলোর খেলা দেখছেন ! এরা অজস্র রকমভাবে এদের রঞ্জক-কোষগুলিকে ভিন্ন ভিন্ন দলে বিভক্ত করতে পারে এবং বিভিন্ন ছন্দে তাদেরকে প্রসারিত ও সঙ্কুচিত করতে পারে ! তাহলে বুঝতেই পারছেন যে এরা কত রকমের রঙের খেলা দেখাতে পারে ! এদের ত্বকের চতুর্থ তথা গভীরতম স্তরটি সাদা রঙের যেখানে ছড়ানো থাকে অজস্র ইরিডিসেন্ট প্রতিফলক কোষ। এই প্রতিফলক কোষগুলিকে বিভিন্ন কোণ থেকে দেখলে তারা নীল, সবুজ, লাল, বা গোলাপী ইত্যাদি বিভিন্ন উজ্জ্বল রঙ তুলে ধরে ! ব্রডক্লাব কাট্লফিশ্ তার শিকারের কাছাকাছি এলেই সে তার দেহ-ত্বকে এই বিভিন্ন রঙের খেলা শুরু করে দেয় যা তার শিকার কাঁকড়া (ডাইকপ্টিক চোখ), গলদা চিংড়ি বা কুচো চিংড়ি (পুঞ্জাক্ষি), অথবা গুগলিশামুকের চোখে (ওসেলাই) নজর কাড়া তো বটেই উপরন্তু তা অত্যন্ত সম্মোহক ! ফলে শিকারটির মধ্যে পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতাও খুব একটা দেখা যায় না !

প্রয়োজনে ব্রডক্লাব কাট্লফিশ্ দেহত্বকের শুধু রঙ নয় বরং ত্বকের টেক্সচার বা গাঠনিক বৈশিষ্ট্যও বদলে ফেলতে পারে ! এরা এই গুণকে কাজে লাগিয়ে অনেক সময়ই সমুদ্র-শৈবালের রূপ ধারণ করে শিকারের পিছু নেয় এবং সুযোগ বুঝে দুই কর্ষিকার সাহায্যে শিকারটিকে পাকড়াও করে মুহূর্তের মধ্যে তাকে মুখে চালান করে দেয় ! ব্রডক্লাব কাট্লফিশ্-র দেহত্বক তাকে শুধু শিকার করতে সাহায্য করে না বরং তাকে শিকার হওয়া থেকেও রক্ষা করে। এদের অন্যতম প্রধান খাদক হাঙর কাছাকাছি এলে এরা পারিপার্শ্বিক পরিবেশের মত করে নিজেদের দেহত্বকের রঙ ও দেহত্বকের গাঠনিক বৈশিষ্ট্য বদলে ফেলে হাঙরের চোখে একরকম অদৃশ্য হয়ে যায় ! কখনও কখনও পারিপার্শ্বিক পরিবেশের অনুরূপ রঙ বা গাঠনিক বৈশিষ্ট্য ধারণে অসমর্থ হলে এরা “সিপিয়া” নামক এক ধরনের কালি নির্গত করে নিজের চারপাশে সেই কালির এক ঘন মেঘ তৈরি করে এবং সেই কালির অনুকরণে নিজের ত্বকের রঙ ও গঠন বদলে ফেলে আত্মগোপন করে ! আত্মগোপন করার এই সকল পদ্ধতিকে আমরা বলি “ক্যামোফ্লাজ”।

প্রজননের সময়ে প্রত্যেক স্ত্রী ব্রডক্লাব কাট্লফিশ্ একাধিক বিভিন্ন পুরুষ ব্রডক্লাব কাট্লফিশ্-র সাথে প্রবালপ্রাচীরে মিলিত হয়ে তাদের কাছ থেকে শুক্রাণু সংগ্রহ করে নিজের দেহে সঞ্চয় করে রাখে। পরে সে সেগুলির মধ্য থেকেই নিজের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্দিষ্ট কোন পুরুষের শুক্রাণুগুলির সাহায্যে নিজের ডিম্বাণুগুলিকে নিষিক্ত করে। এরপর স্ত্রী ব্রডক্লাব কাট্লফিশ্ নিষিক্ত ডিম্বাণুগুলিকে প্রবালপ্রাচীরে বা অন্য কোন কঠিন পৃষ্ঠতলে শক্ত করে আটকে রেখে যায় ও পরে যথা সময়ে সেখানেই প্রতিটি নিষিক্ত ডিম্বাণু থেকে একটি করে নতুন ব্রডক্লাব কাট্লফিশ্-র জন্ম হয়।

Share
Written by
Diganta Paul -

জন্ম: ১৯৮৯ সালে ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হাওড়া জেলায়। শিক্ষা: প্রাথমিক, মাধ্যমিক, ও উচ্চ-মাধ্যমিক শিক্ষা হাওড়া জিলা স্কুলে। এরপর কলকাতার "সেইন্ট থমাস্ কলেজ অফ এঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনলজি" কলেজ থেকে বৈদ্যুতিক কারিগরিবিদ্যা নিয়ে প্রযুক্তিতে স্নাতক (B.Tech. in Electrical Engineering)। পেশা: তথ্যপ্রযুক্তি পেশাদার (IT Professional)। নেশা: বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা নিয়ে পড়াশোনা ও চিন্তাভাবনা। এছাড়াও বিভিন্ন পত্রিকায় বিজ্ঞান প্রবন্ধ, বিজ্ঞান নিবন্ধ, কল্পবিজ্ঞান ভিত্তিক গল্প, কল্পবিজ্ঞান কবিতা, গাণিতিক কল্পকাহিনী, বিজ্ঞান নাটক, ও বিজ্ঞান কবিতা লেখা। উল্লেখযোগ্য পুরস্কার: বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ কর্তৃক প্রদত্ত অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি রৌপ্য পদক। প্রকাশিত বই: উদ্দীপনার খেলাঘর। যোগাযোগ: [email protected]

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
অন্যান্য

মনসুর আলী জিসান: শিক্ষাক্ষেত্রে সততা, কঠোর পরিশ্রম এবং নৈতিকতার প্রয়োজনীয়তা !

লেখক: মনসুর আলী জিসান পিএইচডি করার ব্যাপারটা আসলে এতো সহজ না। আপনি...

অন্যান্য

গবেষণার মানেই প্রকৃত সাফল্য: পিএইচডি ডিগ্রির সংখ্যার প্রভাব কতটুকু?

মোঃ ইয়ামিন হোসেন একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গবেষক, যিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি...

অন্যান্য

জিনোম সিকোয়েন্স’ বিজ্ঞানের ভাষায় জীবন রহস্য!

প্রবন্ধটির লেখক আজিজুল হক। তিনি এই লেখায় জিনোম সিকোয়েন্সিং প্রযুক্তির গুরুত্ব এবং...

অন্যান্য

অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে সন্তান সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর: ভারতের গ্রাম থেকে উঠে এসে নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী!

প্রফেসর ড. মোহাঃ ইয়ামিন হোসেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখরের...

অন্যান্য

সোশ্যাল মিডিয়া বিশ্লেষণে লিলি দে-এর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ!

আমরা একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছি লিলি দে এর। তিনিএকজন কম্পিউটার প্রকৌশলী, প্রযুক্তিকে সহজ...

Three Columns Layout

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact

biggani.org❤️gmail.com

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

যোগাযোগ:

biggani.org@জিমেইল.com

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.