ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গ্রীষ্মের দুপুর। ক্যাম্পাসের ক্যান্টিনে বসে গরম চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে মাস্টার্সের ছাত্র রাশেদ। নোটবুকে হঠাৎ কলম থামিয়ে তার মুখে বিষণ্ণ ভাব। বন্ধুর প্রশ্ন, “কী নিয়ে এত চিন্তা করছিস?”
রাশেদের দীর্ঘশ্বাস, “ছয় মাস ধরে প্রজেক্টে দিনরাত কাজ করলাম, অথচ লেখক তালিকায় আমার নাম নেই! এটা কি ন্যায্য?”
গবেষণা জগতে রাশেদের গল্প বিচ্ছিন্ন নয়। হাজারো তরুণ গবেষক এই একই অভিজ্ঞতায় হতাশ হন। লেখকত্বের মানদণ্ড কী হওয়া উচিত—এ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞরাও।
🎓 লেখকত্ব: কেবল স্বীকৃতি নয়, দায়িত্বও
লেখকত্ব গবেষকের সম্মান, স্বীকৃতি ও ক্যারিয়ার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু এই সম্মানের সঙ্গে রয়েছে দায়বদ্ধতার সম্পর্কও। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত International Committee of Medical Journal Editors (ICMJE) চারটি শর্ত দিয়েছে লেখক হওয়ার জন্য:
- গবেষণার ধারণা, পরিকল্পনা বা তথ্য বিশ্লেষণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান;
- গবেষণাপত্রের খসড়া লেখা বা গভীরভাবে পর্যালোচনা করা;
- প্রকাশিত হতে যাওয়া সংস্করণের অনুমোদন দেওয়া;
- গবেষণার যেকোনো প্রশ্ন বা সমালোচনার ক্ষেত্রে জবাবদিহি করা।
🗣️ “নাম না থাকলে মনে হয়, আমি অদৃশ্য!”
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সোহান জানান, “জরিপ, তথ্য বিশ্লেষণ, এমনকি ড্রাফট তৈরিতে কাজ করেছি। অথচ নাম acknowledgements-এ চলে গেল।” তাঁর মতো বহু তরুণ গবেষক লেখকত্ব নিয়ে হতাশার শিকার।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. মুনীর হাসান বলেন, “কেবল অর্থায়ন বা সিনিয়র হওয়ায় নাম যোগ করাটা অনৈতিক। লেখকত্ব নির্ভর করতে হবে কাজের প্রকৃত অবদানের উপর।”
📊 লেখক ক্রম: কে প্রথম, কে শেষ?
সাধারণত প্রথম লেখক হন গবেষণার মূল কাজটি সম্পন্নকারী। শেষ লেখক হন সুপারভাইজার বা গবেষণা পরিচালক। মাঝের ক্রম নির্ধারিত হয় কাজের গুরুত্ব অনুযায়ী। তবে এই বিষয়টি নিয়েও ভুল বোঝাবুঝির ঘটনা কম নয়। জার্মানির হুমবোল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. লিয়েনা রোথ বলেন, “লেখক ক্রম নিয়ে স্পষ্টতা না থাকলে গবেষণার বিশ্বাসযোগ্যতাই প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।”
📚 বৈশ্বিক ও নৈতিক বাস্তবতা
গবেষণায় ghost authorship (যিনি কাজ করেছেন কিন্তু নাম নেই) এবং gift authorship (অবদান ছাড়াই নাম থাকা) বড় নৈতিক সমস্যা। Elsevier-এর একটি জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ১৩ শতাংশ গবেষণাপত্রে এমন ঘটনা ঘটে। এজন্য লেখকদের অবদান স্পষ্টভাবে উল্লেখ করার নিয়ম চালু হয়েছে। বাংলাদেশেও এর প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে। গবেষকরা বলছেন, গবেষণার নীতিমালায় স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা জরুরি।
✅ সমস্যা এড়াতে আগাম আলোচনা জরুরি
গবেষণার শুরুর পর্যায় থেকেই লেখকত্ব নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ ভুল বোঝাবুঝি এড়ানো সম্ভব। অধ্যাপক নাজনীন আকতার বলেন, “আমরা গবেষণার শুরুতেই পরিষ্কার করি কার কী ভূমিকা থাকবে। এতে নতুনরা উৎসাহী হয়, সিনিয়ররাও নির্ভার থাকেন।”
🧾 শেষ কথা: অবদানের মূল্যায়ন হোক ন্যায্যতার ভিত্তিতে
গবেষণা যৌথ প্রয়াস। তাই নামের পাশাপাশি অবদানের স্বীকৃতি হওয়া উচিত ন্যায্য ও স্পষ্ট। লেখকদের জন্য এটি যেমন সম্মানের, তেমনি গবেষণার মানও নির্ভর করে এর উপর।
আপনার অভিজ্ঞতা কী? লেখকত্ব নিয়ে সমস্যায় পড়েছেন কখনো? আপনার মতামত পাঠান আমাদের ইমেইলে বা ফেসবুক পেজে।
Leave a comment