স্বাস্থ্য ও পরিবেশ

আকর্ষণীয়(য়া)

Share
Share

কথায় বলে – “আগে দর্শনধারী পরে গুণবিচারী”। আবার একথাও প্রচলিত আছে যে – “Don’t judge a book by its cover”। সত্যি কথা বলতে কি, প্রবাদের টানা-পোড়েনের ঊর্ধ্বে এই বিষয়টি একজন মানুষের নিতান্তই ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করে যে তিনি কোন ব্যক্তি, বস্তু, ঘটনা, বা বিষয়ের বাহ্যিক রূপ পর্যবেক্ষণ করবেন না তার ভেতরটা খতিয়ে দেখবেন; নাকি দুটোই তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তবে কোন ব্যক্তির বাহ্যিক রূপ পর্যবেক্ষণ করে আমাদের মস্তিষ্কে সেই ব্যক্তি সম্পর্কে যে উপলব্ধি জন্ম নেয় সেই উপলব্ধিতে একটি বিশেষ বিবেচনা প্রায়শই মিশে থাকে, তা হলো যে ব্যক্তিটি “আকর্ষণীয়” না “সাদামাটা” না “বিশ্রী”। আকর্ষণীয় ব্যক্তিকে বিশেষিত করার জন্য ইংরাজী ভাষায় বেশ কিছু শব্দের বহুল ব্যবহার দেখা যায় যেমন – “হট্”,“হ্যান্ডসাম্”,”বিউটিফুল” ইত্যাদি। এখন যে প্রশ্নের উত্তর আমরা খুঁজব তা হলো, আমাদের মস্তিষ্ক কোন ব্যক্তি বাহ্যিকভাবে আকর্ষণীয় কিনা তা কিভাবে বিবেচনা করে ! আমাদের মস্তিষ্ক ঠিক কিভাবে সিদ্ধান্ত নেয় যে কোন পুরুষকে “হট্” বা “হ্যান্ডসাম্” দেখাচ্ছে? কিসের ভিত্তিতে বড় পর্দায়, ছোট পর্দায়, ফ্যাশন্ ম্যাগাজিন বা গণ মাধ্যমে অভিনেত্রীদের “হট্” বা “বিউটিফুল” বিশেষণ দেওয়া হয়? আসলে এই বিষয়টি বিবেচিত হয় মানুষের মস্তিষ্কের স্বজ্ঞাত অঞ্চলে (ইন্টিউয়েটিভ পার্ট অফ ব্রেইন), তবে এই বিবেচনায় সমর্থ হওয়ার জন্য স্বজ্ঞাত অঞ্চলকে প্রস্তুতি নিতে হয় আর সেই প্রস্তুতিতে সাহায্য করে থাকে মস্তিষ্কের যৌক্তিক অঞ্চলটি (রাশানাল পার্ট অফ ব্রেইন)। অর্থাৎ সামনের মানুষটাকে আকর্ষণীয় বা আকর্ষণীয়া লাগছে কিনা অথবা ঘর থেকে বেরোনোর আগে সেজে গুজে আপনি যখন আয়নার সামনে দাঁড়ান, তখন আপনার নিজেকে সুদর্শন বা সুদর্শনা মনে হচ্ছে কিনা – এই ধরনের সকল সিদ্ধান্ত মস্তিষ্ক তার স্বজ্ঞার (ইন্টিউয়েশন্) সাহায্যে নেয়, আর মস্তিষ্কের যৌক্তিক অঞ্চলটি তার অর্জিত বিভিন্ন এই সম্পর্কিত ধারণা স্মরণ করে সেগুলি স্বজ্ঞাত অঞ্চলকে ক্রমাগত সরবরাহ করে ও সময়ের সাথে সাথে সেই স্বজ্ঞা গড়ে তুলতে সাহায্য করে। মানুষের বাহ্যিক আকর্ষণীয়তার বিজ্ঞানকে বিশদে বুঝতে হলে মনুষ্য-মস্তিষ্কের “স্বজ্ঞাত অঞ্চল” ও “যৌক্তিক অঞ্চল”-কে আমাদের বুঝতে হবে, তবে সেগুলি বোঝার জন্য মনুষ্য-মস্তিষ্কের কিছু ভিত্তিগত বিষয় আমাদের প্রথমে জেনে ফেলতে হবে।

স্বল্প মেয়াদী স্মৃতি, মস্তিষ্ক-তরঙ্গ, ও মস্তিষ্কে সংগ্রীহিত তথ্যের বিশ্লেষণ:

আমাদের মস্তিষ্কের “সেরিব্রাল কর্টেক্স” কতগুলি খণ্ডে (লোব) বিভক্ত – “ফ্রন্টাল লোব”, “প্যারাইটাল লোব”, “অকিপিটাল লোব”, ও “টেম্পোরাল লোব”।

সেরিব্রাল কর্টেক্স-র প্রধান চারটি খণ্ড

অকিপিটাল লোবে অবস্থিত “ভিসুয়াল কর্টেক্স”-র কাছাকাছি রয়েছে একটি নিউরাল লুপ (নিউরাল লুপ হলো কতগুলি স্নায়ুকোষের সমষ্টি যারা কোন একটি নির্দিষ্ট কাজ করার জন্য একটি ক্রমে সংযুক্ত থেকে স্নায়বিক উদ্দীপনাকে মস্তিষ্কের এক অংশ থেকে অন্য অংশে নিয়ে যায়) যা দৃষ্টি সম্বন্ধীয় তথ্যের (ভিসুয়াল ইনফরমেশন্) “স্বল্প মেয়াদী স্মৃতি”(শর্ট টার্ম মেমোরি) হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও একটি ফোনোলজিকাল নিউরাল লুপ আছে যা ফ্রন্টাল লোবে অবস্থিত “ব্রকাস্ এরিয়া”-র সাথে সম্মিলিতভাবে শব্দ ও ভাষা সম্বন্ধীয় তথ্যের (অডিও ইনফরমেশন্) “স্বল্প মেয়াদী স্মৃতি” হিসাবে কাজ করে। এই প্রসঙ্গে “স্বল্প মেয়াদী স্মৃতি” কি তা সহজ করে বলে দিই। আপনি এখন যে বাক্যটা পড়ছেন তার অর্থ বুঝতে গেলে বাক্যের শেষের দিকের অংশটা পড়ার সময় বাক্যের শুরুটাও আপনাকে মনে রাখতে হবে আর আপনার মস্তিষ্কের স্বল্প মেয়াদী স্মৃতিই এই কাজটা করে দেয় – অর্থাৎ অল্প সময়ের (১০ থেকে ১৫ সেকেন্ড অথবা কখনও ১ মিনিট) জন্য অল্প কিছু তথ্য সে ধরে রাখে।

মানুষের মস্তিষ্ক অজস্র স্নায়ুকোষ (নিউরোন) এবং বেশ কিছু স্নায়ুকোষের সাহায্যকারী কোষ বা “গ্লিয়াল কোষ” নিয়ে তৈরি হয়। কতগুলি স্নায়ুকোষের একই সাথে অথবা একটি ক্রমে উদ্দীপিত হয়ে ওঠা “উপলব্ধি”-র (অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে লব্ধ অনুভূতি অথবা কিছু স্মরণ করা অথবা যুক্তি ভিত্তিক নতুন কোন ভাবনা অথবা স্বজ্ঞা ভিত্তিক কোন সিদ্ধান্ত অথবা কোন কল্পনা) পরিভাষা। হারমোনিয়ামের কিবোর্ড-র উপর বাদকের চঞ্চল আঙুলগুলো লক্ষ্য করবেন – কিভাবে আঙুলগুলো হারমোনিয়ামের কি-গুলিকে ছন্দবদ্ধভাবে আঘাত করে চলে। কখনও কখনও মস্তিষ্কের কিছু স্নায়ুকোষ এরকম ছন্দবদ্ধভাবেও উদ্দীপিত হয়। ছন্দবদ্ধভাবে উদ্দীপিত হওয়ার সময় স্নায়ুকোষগুলির প্রত্যেকটি কিছুক্ষণ পর পরই  বারবার উদ্দীপিত হতে থাকে – স্নায়ুকোষগুলির উদ্দীপিত হওয়ার এই ছন্দকে “মস্তিষ্ক-তরঙ্গ” বলে যারা কম্পাঙ্কের ভিত্তিতে বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে।

বিভিন্ন প্রকার মস্তিষ্ক-তরঙ্গ

মস্তিষ্ক চোখের মাধ্যমে “দৃষ্টি সম্বন্ধীয় স্বল্পমেয়াদী স্মৃতি”-তে (ভিসুয়াল শর্ট টার্ম মেমোরি) দৃষ্টি সম্বন্ধীয় তথ্য (ভিসুয়াল ইনফরমেশন) সংগ্রহ করে তাকে দুটি উপাংশে বিশ্লেষণ করে – “স্থানিক দৃষ্টি সম্বন্ধীয় তথ্য”(স্পেসিয়াল ভিসুয়াল ইনফরমেশন) এবং “সময়গত দৃষ্টি সম্বন্ধীয় তথ্য”(টেম্পোরাল ভিসুয়াল ইনফরমেশন)। অনুরূপে মস্তিষ্ক কানের মাধ্যমে “শব্দ ও ভাষা সম্বন্ধীয় স্বল্পমেয়াদী স্মৃতি”-তে (অডিটারি শর্ট টার্ম মেমোরি) যে শব্দ ও ভাষা সম্বন্ধীয় তথ্য (অডিটারি ইনফরমেশন) সংগ্রহ করে তাকে “স্থানিক শব্দ ও ভাষা সংক্রান্ত তথ্য”(স্পেসিয়াল অডিটারি ইনফরমেশন) এবং “সময়গত শব্দ ও ভাষা সম্পর্কিত তথ্য”(টেম্পোরাল অডিটারি ইনফরমেশন) -এ বিশ্লেষণ করে। এখন প্রশ্ন হল যে মস্তিষ্ক কিভাবে সংগৃহীত তথ্যগুলিকে স্থানিক (স্পেসিয়াল কম্পোনেন্ট) ও সময়গত (টেম্পোরাল কম্পোনেন্ট) উপাংশে বিশ্লেষণ করে। মস্তিষ্ককে এই কাজে সাহায্য করে এক বিশেষ প্রকার মস্তিষ্ক-তরঙ্গ। মস্তিষ্ক-তরঙ্গ কি তা আগেই বলেছি। এখনও পর্যন্ত মানুষের মস্তিষ্কে যত রকম কম্পাঙ্কের তরঙ্গ আবিষ্কৃত হয়েছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী কম্পাঙ্কের মস্তিষ্ক-তরঙ্গ হলো “গামা তরঙ্গ”(৪০ – ১০০ হার্ৎজ কম্পাঙ্ক) যা ঘুমানোর সময় অথবা জাগ্রত বা ধ্যানমগ্ন অবস্থায় অন্যান্য মস্তিষ্ক-তরঙ্গের পাশাপাশি আমাদের মস্তিষ্কে খেলে বেড়ায়।

আসলে আমাদের মস্তিষ্কের “সেরিব্রাল কর্টেক্স” ও “থ্যালামাস” অংশদুটির সংযোগকারী যে নিউরাল লুপগুলিতে গামা তরঙ্গ বয়ে চলে সেগুলি আমাদের মস্তিষ্কে সংগৃহীত দৃষ্টি, শব্দ, ও ভাষা সম্বন্ধীয় তথ্যগুলি থেকে স্থানিক উপাংশকে নিষ্কাশন করে; এবং গামা তরঙ্গ বহনকারী যে নিউরাল লুপগুলি “সেরিব্রাল কর্টেক্স”-র সাথে “মিডব্রেইন” অংশকে সংযুক্ত করে সেগুলি সংগৃহীত তথ্যগুলি থেকে সময়গত উপাংশকে বেছে দেয়।

থ্যালামাস

মিডব্রেইন

মনুষ্য-মস্তিষ্কের স্বজ্ঞাত অঞ্চল:

শব্দ ও ভাষা সম্বন্ধীয় তথ্যসমূহের সময়গত উপাংশ অডিটারি শর্ট টার্ম মেমোরি থেকে প্রথমে মস্তিষ্কের “সুপিরিয়র টেম্পোরাল সালকাস”-এ সময়ের ভিত্তিতে ও তারপর “অ্যাসোসিয়েটিভ অডিটারি কর্টেক্স”-এ কম্পাঙ্কের ভিত্তিতে এনকোডেড্ (সংকেতাক্ষরে লিখিত) হওয়ার পর ভিসুয়াল কর্টেক্সে আসে। আবার ভিসুয়াল শর্ট টার্ম মেমোরি থেকে দৃষ্টি সম্বন্ধীয় তথ্যগুলোর সময়গত উপাংশ “সুপিরিয়র টেম্পোরাল সালকাস”-র পলিসেন্সরি অংশটিতে আসে। সেখানে তথ্যগুলি এনকোডেড্ হওয়ার পর ভিসুয়াল কর্টেক্সে আসে। ভিসুয়াল কর্টেক্স এই সকল এনকোডেড্ দৃষ্টি, শব্দ, ও ভাষা সম্বন্ধীয় তথ্যকে সার্চ ক্রাইটেরিয়া হিসাবে ব্যবহার করে “পদ্ধতিগত দীর্ঘ মেয়াদী স্মৃতি”(প্রোসিডিউরাল লং টার্ম মেমোরি)-তে অর্থাৎ মস্তিষ্কের “সেরিবেলাম”,“পুটামেন”,“কডেট নিউক্লিয়াস”, আর “মোটর কর্টেক্স” অংশগুলিতে এনকোডেড্ অবস্থায় সঞ্চিত বিভিন্ন “অর্জিত দক্ষতা”(স্কিল) ও “করণীয় কাজ”(টাস্ক) সম্বন্ধীয় তথ্যগুলির মধ্য থেকে কিছু তথ্য উদ্ধার (রিট্রিভ) করে তাদেরকে ডিকোড্ (পাঠোদ্ধার করা) করে – এই ডিকোডেড্ তথ্যগুলোই হলো “স্বজ্ঞাত সিদ্ধান্ত”(ইন্টিউয়েটিভ ডিসিশন্), আর মস্তিষ্কের এই স্বজ্ঞাত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার নাম “স্বজ্ঞা”(ইন্টিউয়েশন্)। বলাই বাহুল্য, এই “স্বজ্ঞাত সিদ্ধান্ত” বস্তুত মস্তিষ্কের স্বজ্ঞাত অঞ্চল (ইন্টিউয়েটিভ পার্ট অফ ব্রেইন)-র ফসল। অর্থাৎ মস্তিষ্কের স্বজ্ঞাত অঞ্চলটি প্রধানত “সুপিরিয়র টেম্পোরাল সালকাস”, “অ্যাসোসিয়েটিভ অডিটারি কর্টেক্স”, “ভিসুয়াল কর্টেক্স”, “সেরিবেলাম”,“পুটামেন”,“কডেট নিউক্লিয়াস”, ও “মোটর কর্টেক্স” অংশগুলি নিয়ে তৈরি হয়েছে।

ভিসুয়াল কর্টেক্স

মনুষ্য-মস্তিষ্কের যৌক্তিক অঞ্চল:

মনুষ্য-মস্তিষ্কের যৌক্তিক অঞ্চলটি (রাশানাল পার্ট অফ ব্রেইন) প্রধানত সেরিব্রাল কর্টেক্সের ফ্রন্টাল লোব এর সামনের দিকে অবস্থিত “প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স” এর কেন্দ্রীয় নির্বাহী অংশটি (সেন্ট্রাল এক্সিকিউটিভ পার্ট) এবং “ব্যক্ত দীর্ঘ মেয়াদী স্মৃতি”(ডিক্ল্যারেটিভ লং টার্ম মেমোরি) নিয়ে তৈরি হয়। মস্তিষ্কের “ব্যক্ত দীর্ঘ মেয়াদী স্মৃতি“ তৈরি হয় সেরিব্রাল কর্টেক্স এর টেম্পোরাল লোবের মধ্যভাগে অবস্থিত “হিপ্পোক্যাম্পাস”, “এন্টোরাইনাল কর্টেক্স”, “পেরিরাইনাল কর্টেক্স”, এবং “টেম্পোরাল কর্টেক্সে” অংশগুলি নিয়ে। এছাড়াও “ভেন্ট্রাল ইনট্রাপ্যারাইটাল এরিয়া”, ”ল্যাটারাল ইনট্রাপ্যারাইটাল এরিয়া”, “প্রাইমারী অডিটারি কর্টেক্স”, “কডাল অডিটারি বেল্ট ও প্যারাবেল্ট” অংশগুলিও মস্তিষ্কের যৌক্তিক অঞ্চলটির অর্ন্তগত। ভিসুয়াল শর্ট টার্ম মেমোরি থেকে দৃষ্টি সম্বন্ধীয় তথ্যগুলির স্থানিক উপাংশ “ভেন্ট্রাল ইনট্রাপ্যারাইটাল এরিয়া” ও ”ল্যাটারাল ইনট্রাপ্যারাইটাল এরিয়া”-য় আসে। সেখানে তথ্যগুলো এনকোডেড্ হওয়ার পর “প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স” এর কেন্দ্রীয় নির্বাহী অংশটি সেই তথ্যগুলোকে সংগ্রহ করে। আবার অডিটারি শর্ট টার্ম মেমোরি থেকে শব্দ ও ভাষা সম্বন্ধীয় তথ্যগুলোর স্থানিক উপাংশ “প্রাইমারী অডিটারি কর্টেক্স” এবং “কডাল অডিটারি বেল্ট ও প্যারাবেল্ট”-এ আসে। সেখানে তথ্যগুলি এনকোডেড্ হওয়ার পর তারাও “প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স” এর কেন্দ্রীয় নির্বাহী অংশটিতে সংগৃহীত হয়। এরপর “প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স” এর কেন্দ্রীয় নির্বাহী অংশটি এই সকল সংগৃহীত দৃষ্টি, শব্দ, ও ভাষা সম্বন্ধীয় এনকোডেড্ তথ্যকে সার্চ ক্রাইটেরিয়া হিসাবে ব্যবহার করে “ব্যক্ত দীর্ঘ মেয়াদী স্মৃতি”-তে এনকোডেড্ অবস্থায় সঞ্চিত নানান অভিজ্ঞতা (এক্সপিরিয়েন্স), ঘটনা (ইভেন্ট), সত্য (ফ্যাক্ট), ও ধারণা (কনসেপ্ট) সম্বন্ধীয় তথ্যগুলির মধ্য থেকে কিছু তথ্য উদ্ধার (রিট্রিভ) করে ও তাদেরকে ডিকোড্ করে – মস্তিষ্কে এই প্রক্রিয়ার নামই “স্মরণ করা”।

প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স

মনুষ্য-মস্তিষ্কের স্বজ্ঞাত অঞ্চল কিভাবে যৌক্তিক অঞ্চলের সাহায্য নিয়ে কোন ব্যক্তির বাহ্যিক রূপের আকর্ষণীয়তা বিবেচনা করে থাকে?

আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি যেপ্রোসিডিউরাল লং টার্ম মেমোরি হলো মস্তিষ্কের স্বজ্ঞাত অঞ্চলের একটি অংশ যা বিভিন্ন বিষয়ে অর্জিত দক্ষতা (স্কিল) ও করণীয় কাজ (টাস্ক) সম্বন্ধীয় তথ্যগুলি সঞ্চয় করে রাখে, এবং ডিক্ল্যারেটিভ লং টার্ম মেমোরি হলো যৌক্তিক অঞ্চলের অংশ যেখানে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা (এক্সপিরিয়েন্স), ঘটনা (ইভেন্ট), সত্য (ফ্যাক্ট), ধারণা (কনসেপ্ট) সম্বন্ধীয় তথ্যগুলি সঞ্চিত থাকে। আমাদের পূর্বপুরুষদের ও আদিম মানুষের সমাজ, সংস্কৃতি, জীবনযাপনের পদ্ধতি, ও মানুষের বাহ্যিক রূপ পর্যবেক্ষণের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা তাদের জিনগত তথ্যে বিবিধ প্রভাব ফেলেছিল ও বংশপরম্পরায় সেই সকল পরিবর্তিত জিনগত তথ্যের অনেকটা আমরাও বহন করছি যা আমাদের মস্তিষ্কের “সিম্যান্টিক মেমোরি”(ডিক্ল্যারেটিভ লং টার্ম মেমোরি-র একটি অংশ)-তে উপস্থিত স্নায়ুকোষগুলোর গঠন ও কার্যকারিতায় প্রভাব ফেলে। এছাড়াও আমাদের বর্তমান সমাজ, সংস্কৃতি, জীবনযাপন, এবং মানুষের বাহ্যিক রূপ পর্যবেক্ষণের অনেক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আমাদের মস্তিষ্কের “সিম্যান্টিক মেমোরি”-র বেশ কিছু স্নায়ুকোষের জিনে (নিউরাল জিন) পরিবর্তন ঘটিয়ে চলেছে। এসবের সম্মিলিত প্রভাবে মস্তিষ্কের “সিম্যান্টিক মেমোরি”-তে মানুষের বাহ্যিক রূপের আকর্ষণীয়তা বিষয়ক অনেক ধারণা (কনসেপ্ট) সঞ্চিত হতে থাকে। মস্তিষ্কের যৌক্তিক অঞ্চলটি এই ধারণাগুলি স্মরণ করে “শর্ট টার্ম মেমোরি”-তে পাঠাতে থাকে এবং স্বজ্ঞাত অঞ্চলটি “শর্ট টার্ম মেমোরি” থেকে এই ধারণাগুলি গ্রহণ করে সময়ের সাথে সাথে এই সকল ধারণার সাধারণীকরণ (জেনারেলাইজেশন্)-র মাধ্যমে প্রোসিডিউরাল লং টার্ম মেমোরি-তে কতগুলি “গুণগত বিশ্লেষণমূলক কাজ”(কোয়ালিটেটিভ অ্যানালিটিকাল টাস্ক) ও কতগুলি “পরিমাণগত বিশ্লেষণমূলক কাজ” (কোয়ান্টিটেটিভ অ্যানালিটিকাল টাস্ক)  নির্ধারণ (ডিফাইন্) করে সেই সম্বন্ধীয় তথ্যগুলিকে এনকোডেড্ অবস্থায় সঞ্চয় করে রাখে। কোন ব্যক্তির বাহ্যিক রূপ পর্যবেক্ষণ করার সময় মস্তিষ্কের স্বজ্ঞাত অঞ্চল সেই তথ্যগুলিকে ডিকোড্ করে বিশ্লেষণমূলক কাজগুলিকে (অ্যানালিটিকাল টাস্ক) একে একে সম্পাদন (এক্সিকিউট্) করে এবং ব্যক্তিটির বাহ্যিক রূপের আকর্ষণীয়তা বিষয়ক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়।

মস্তিষ্কের স্বজ্ঞাত অঞ্চলটি যে গুণগত বিশ্লেষণমূলক কাজগুলি ও যে সকল পরিমাণগত বিশ্লেষণমূলক কাজ সম্পাদন করে সেগুলি এখন আলোচনা করা যাক্ –

মুখমণ্ডলের প্রতিসমতা বিবেচনা

অধিকাংশ মানুষেরই মুখমণ্ডল প্রতিসম নয়, অর্থাৎ মুখমণ্ডলের বাম ও ডান অর্ধের একটি আরেকটি অপেক্ষা সামান্য বেশী চওড়া হয় অথবা চোখ দুটির আকৃতিতে খুব সামান্য পার্থক্য থাকতে পারে। আমাদের চোখ ও গালের মধ্যবর্তী স্থানে একটা হাড় থাকে। কারও কারও ঐ বাম ও ডান হাড় একই রকম স্পষ্ট হয় না। মুখমণ্ডলের এই ধরনের অনেক অপ্রতিসমতা তথাকথিত মেকআপ এর সাহায্যে লুকানো যায় বা সার্জারির সাহায্যে ঠিক করা যায়। মস্তিষ্কের স্বজ্ঞাত অঞ্চল সামনের মানুষটির মুখমণ্ডলের এই প্রতিসমতা বিবেচনা করার জন্য একটি গুণগত বিশ্লেষণমূলক কাজ নির্ধারণ করে। স্বজ্ঞাত অঞ্চল যে মুখমণ্ডলে যত কম অপ্রতিসমতা খুঁজে পায়, সেই মুখমণ্ডল তত বেশী আকর্ষণীয় বলে বিবেচিত হয়।

“গোল্ডেন রেশিও”-র সাথে তুলনা

আমাদের মস্তিষ্কের স্বজ্ঞাত অঞ্চল মুখমণ্ডলে কপাল ঠিক যেখান থেকে শুরু হয় সেখান থেকে নাকের ডগা পর্যন্ত লম্ব দৈর্ঘ্য ও নাকের ডগা থেকে চিবুক পর্যন্ত লম্ব দৈর্ঘ্যের অনুপাত নির্ণয় করার জন্য একটি পরিমাণগত বিশ্লেষণমূলক কাজ নির্ধারণ করে থাকে। এই অনুপাতের নির্ণীত মান “১.৬১৮০৩৩….” (গোল্ডেন রেশিও)-র যত কাছাকাছি হয়, মুখমণ্ডলটি মস্তিষ্কের স্বজ্ঞাত অঞ্চলের কাছে তত বেশী আকর্ষণীয় বলে বিবেচিত হয়।

ত্বকের রঙ ও ঠোঁটের প্রকৃতি বিবেচনা

মস্তিষ্কের স্বজ্ঞাত অঞ্চল মুখমণ্ডলের ত্বকের সর্বত্র সুষম রঙ দেখে একজন পুরুষকে খুঁজে পায় এবং সেই সুষমতাই হয়ে ওঠে পুরুষটির মুখমণ্ডলের আকর্ষণীয়তার পরিমাপ ! আপনি যদি নারী হন, আপনাকে একটা প্রশ্ন করি – আপনি কেন লিপস্টিক ব্যবহার করেন? আপনি যদি ব্যবহার নাও করেন, নিশ্চয়ই লক্ষ্য করে থাকবেন যে বহু মেয়ে ও মহিলা লিপস্টিক, আই শ্যাডো ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকেন। ছেলে ও পুরুষদের মধ্যে এগুলির ব্যবহার যে একদম দেখা যায় না তা নয়, তবে মেয়ে ও মহিলাদের মধ্যেই এগুলির ব্যবহার বেশী। যাই হোক্, প্রশ্নটার সহজ উত্তর হলো – “নিজেকে সুন্দর দেখানোর জন্য”। কিন্তু কখনও ভেবে দেখেছেন যে কেন লিপস্টিক ও আই শ্যাডো-র যথাযথ ব্যবহার আপনাকে আরও সুদর্শনা করে তোলে? মুখমণ্ডলের ত্বকের রঙের সাথে ঠোঁটের রঙের পার্থক্যে, দুচোখের চারপাশের ত্বকের রঙ মুখমণ্ডলের ত্বকের রঙ অপেক্ষা বেশী গাঢ় হলে মস্তিষ্কের স্বজ্ঞাত অঞ্চল একজন নারীকে আবিষ্কার করে! লিপস্টিক ও আই শ্যাডো-র ব্যবহার একজন নারীর মুখমণ্ডলে এই নারী সুলভ বৈশিষ্ট্যগুলোকে আরও বাড়িয়ে দেয়। এছাড়াও নারীর চওড়া, সুমসৃণ, ও পরিপুষ্ট দুটি ঠোঁট মানুষের স্বজ্ঞাত অঞ্চলের কাছে সন্তান প্রতিপালনে সক্ষমতার স্বাক্ষর (ঠোঁটে এই বৈশিষ্ট্যগুলো তৈরি করার জন্য বা ঠোঁটের এই বৈশিষ্ট্যগুলো দৃষ্টগোচর করার জন্যও লিপস্টিকের ব্যবহার হয়)। শুধু তাই নয়; মস্তিষ্কের স্বজ্ঞাত অঞ্চল মনে করে যে; সময়, পরিস্থিতি, ও বেশভূষার ভিত্তিতে ঠোঁটের রঙ নির্বাচন এক শৈল্পিক নৈপুণ্যের বহিঃপ্রকাশ। অর্থাৎ নারীত্ব, মাতৃত্ব, আর শিল্পীসত্ত্বা – এই তিন মাপকাঠির ভিত্তিতে দর্শকের মস্তিষ্কের স্বজ্ঞাত অঞ্চল একজন নারীর মুখমণ্ডল দেখে তাঁকে সুন্দরী বা আকর্ষণীয়া হিসাবে বিবেচনা করে।

কণ্ঠস্বরের কম্পাঙ্ক বিবেচনা

মস্তিষ্কের স্বজ্ঞাত অঞ্চলের একটি পরিমাণগত বিশ্লেষণমূলক কাজ হলো সামনের মানুষটির কণ্ঠস্বরের কম্পাঙ্ক নির্ণয় করা। সে ১৬৫-২৫৫ হার্ৎজ্ কম্পাঙ্কের মনুষ্য-কণ্ঠস্বরকে পূর্ণবয়স্কা নারীর কণ্ঠস্বর এবং ৮৫-১৫৫ হার্ৎজ্ কম্পাঙ্কের কণ্ঠস্বরকে পূর্ণবয়স্ক পুরুষের কণ্ঠস্বর বলে মনে করে। ১৬৫ হার্ৎজ্ থেকে ২৫৫ হার্ৎজ্ কম্পাঙ্কের পরিসরে একজন নারীর কণ্ঠস্বরের কম্পাঙ্ক যত বেশী হয়, স্বজ্ঞাত অঞ্চল তাঁকে তত আকর্ষণীয়া বলে বিবেচনা করে। আবার একজন পুরুষের কণ্ঠস্বরের কম্পাঙ্ক ৮৫ হার্ৎজ্ থেকে ১৫৫ হার্ৎজ্ কম্পাঙ্কের পরিসরে যত কম হয়, তিনি স্বজ্ঞাত অঞ্চলের কাছে তত আকর্ষণীয় হয়ে ওঠেন।

পা ও ধড়ের দৈর্ঘ্যের অনুপাত নির্ণয়

আমাদের মস্তিষ্কের স্বজ্ঞাত অঞ্চল সামনের মানুষটার পায়ের দৈর্ঘ্য ও হাত-পা-মাথা বাদে দেহকান্ড অর্থাৎ ধড়ের দৈর্ঘ্যের অনুপাত নির্ণয় করে যা পরিমাণগত বিশ্লেষণমূলক কাজগুলির মধ্যে একটি। অনুপাতটির মান প্রায় ১.৬৭ হলে স্বজ্ঞাত অঞ্চল মানুষটিকে নারী এবং প্রায় ১.৩৭ হলে মানুষটিকে পুরুষ বিবেচনা করে, কিন্তু ১.৬৭ অপেক্ষা প্রায় ৫% বেশী এমন অনুপাত বিশিষ্ট নারীদের আকর্ষণীয়া এবং ১.৩৭ অপেক্ষা প্রায় ৭.৫% বেশী এমন অনুপাত বিশিষ্ট পুরুষদের আকর্ষণীয় মনে করে। উঁচু হীল যুক্ত জুতো ব্যবহার করলে পায়ের কার্যকরী দৈর্ঘ্য বেড়ে যায়, অর্থাৎ পা-দুটি অপেক্ষাকৃত লম্বা দেখায়, ফলতঃ পা ও ধড়ের দৈর্ঘ্যের কার্যকরী অনুপাতও বৃদ্ধি পায়। ফলে মেয়ে ও মহিলারা উঁচু হীল যুক্ত জুতো ব্যবহার করে তাঁদের ঐ অনুপাতটি সহজেই ৫% বাড়িয়ে নিতে পারেন। কিন্তু পুরুষদের ঐ অনুপাতটি ৭.৫% বাড়াতে যতখানি উঁচু হীল প্রয়োজন ততখানি উঁচু হীল যুক্ত জুতো পায়ে দিলে ভারসাম্যের এতটাই অভাব ঘটে যে যথেষ্ট অভ্যাস সত্ত্বেও তা অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সেইজন্য প্রধানত মেয়ে ও মহিলাদের মধ্যেই উঁচু হীল যুক্ত জুতো পরার চল দেখা যায়।

পৃষ্ঠ খিলান পর্যবেক্ষণ

বহু মানুষের পৃষ্ঠভাগ ও নিতম্বের সংযোগস্থলে একটা সূক্ষ্মকোণ তৈরি হয়, তাই তাদের ধড়ের পিছন দিকে একটি খিলান তৈরি হয়। একে আমরা বলতে পারি “পৃষ্ঠ খিলান”। পুরুষ ও নারী উভয়ের ধড়েই এই খিলান দেখতে পাওয়া গেলেও আমাদের মস্তিষ্কের স্বজ্ঞাত অঞ্চল এই খিলান বা বক্রতাকে প্রধানত নারী-দেহের বৈশিষ্ট্য বলে গণ্য করে। যে নারীর দেহে এই সূক্ষ্মকোণের মান ঠিক ৪৫.৫ ডিগ্রী হয়, সেই নারীর কোমর বিপরীতকামী নারী ও সমকামী পুরুষদের মস্তিষ্কের স্বজ্ঞাত অঞ্চলে আকর্ষণীয় বলে বিবেচিত হয় এবং সেই নারীর নিতম্ব সমকামী নারী ও বিপরীতকামী পুরুষদের মস্তিষ্কের স্বজ্ঞাত অঞ্চলকে আকর্ষণ করে। তবে সূক্ষ্মকোণটির মান ৪৫.৫ ডিগ্রীর কম বা বেশী হলে এই আকর্ষণীয়তায় কিছু ঘাটতি দেখা যায়। মেয়ে বা মহিলারা উঁচু হীল যুক্ত জুতো পরে দাঁড়ানোর সময় বা হাঁটার সময় তাঁদের দেহের ভারকেন্দ্র (সেন্টার অফ গ্র্যাভিটি) ভূমি থেকে অনেকটা উপরে থাকে বলে তাঁদের দেহে অতিরিক্ত অভিকর্ষীয় স্থিতিশক্তি (গ্র্যাভিটেশানাল পোটেন্শিয়াল এনার্জি) সঞ্চিত হয় যা কমিয়ে তাঁদের দেহ অন্যান্য মেক্যানিকাল সিস্টেমের মতই  ভারসাম্য অর্জন করতে চায়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের ধড়ের পিছন দিকে কিছু অতিরিক্ত বক্রতা বা খিলান সৃষ্টি হয় যাতে দেহের কিছু পরিমাণ অতিরিক্ত অভিকর্ষীয় স্থিতিশক্তি স্থিতিস্থাপক শক্তিতে (ইলাস্টিক পোটেন্শিয়াল এনার্জি) রূপান্তরিত হতে পারে। এইভাবেও উঁচু হীল যুক্ত জুতোর ব্যবহার মেয়ে ও মহিলাদের দেহে নারী-সুলভ বৈশিষ্ট্যটিকে আরও সুস্পষ্ট করে তোলে ও দর্শকের মস্তিষ্কের স্বজ্ঞাত অঞ্চলের কাছে তাদেরকে করে তোলে আকর্ষণীয়া।

কোমর ও নিতম্বের পরিধির অনুপাত নির্ণয়

দর্শকের মস্তিষ্কের স্বজ্ঞাত অঞ্চলের কাছে একজন মানুষের কোমর ও নিতম্বের পরিধির অনুপাত ০.৬৭ থেকে ০.৮ এর মধ্যে হলে তা সুস্থ নারী-দেহের পরিচায়ক এবং অনুপাতটির মান ০.৮ ও ০.৯৫ এর মধ্যে হলে তা সুস্থ পুরুষ-দেহের পরিচায়ক। তবে একটি নারী-দেহ তখনই আকর্ষণীয় হিসাবে বিবেচিত হয় যখন স্বজ্ঞাত অঞ্চল কোমরের পরিধি ও নিতম্বের পরিধি পরিমাপ করে অনুপাতটির মান পায় ০.৭ বা ০.৮। আকর্ষণীয় পুরুষ-দেহের ক্ষেত্রে এই অনুপাতটি ০.৯।

একক সময়ে পদক্ষেপের সংখ্যা, পদক্ষেপের দৈর্ঘ্য, পায়ের পাতার দৈর্ঘ্য, ও “পেলভিস”-র দোলন বিবেচনা

ক্লান্তি ও বিরাম বিবেচনা না করলে একজন পূর্ণবয়স্ক পুরুষ দিনে গড়ে ৫৩৪০ টি পদক্ষেপ ফেলতে সমর্থ কিন্তু একজন পূর্ণবয়স্ক নারী পদক্ষেপ ফেলতে পারেন দিনে গড়ে ৪৯১২ টি । এই হিসাব থেকে বোঝাই যায় যে নারীর একক সময়ে পদক্ষেপের সংখ্যা সাধারণত পুরুষ অপেক্ষা কম। শুধু তাই নয়, নারীর পদক্ষেপের গড় দৈর্ঘ্য (২.২ ফুট) পুরুষের পদক্ষেপের গড় দৈর্ঘ্য (২.৫ ফুট) অপেক্ষা কম। নারীর পায়ের পাতার দৈর্ঘ্যও পুরুষ অপেক্ষা কম। কিন্তু হাঁটার সময়ে নারীর “পেলভিস”(“পেলভিস” হলো মেরুদণ্ডের ভিতের কাছে অবস্থিত অস্থি নির্মিত একটি কাঠামো যার সাথে পা দুটি যুক্ত থাকে)-র দোলন পুরুষ অপেক্ষা খানিকটা বেশী। একক সময়ে পদক্ষেপের সংখ্যা, পদক্ষেপের দৈর্ঘ্য, পায়ের পাতার দৈর্ঘ্য, “পেলভিস”এর দোলন – এই অপেক্ষকগুলো পর্যবেক্ষণ করাও মস্তিষ্কের স্বজ্ঞাত অঞ্চলের করণীয় কাজগুলোর মধ্যে পড়ে কারণ এই পরিমাণগত অপেক্ষকগুলিও (কোয়ান্টিটেটিভ প্যারামিটার) মস্তিষ্কের স্বজ্ঞাত অঞ্চলকে একজন মানুষ পুরুষ না নারী সেই ধারণা পেতে সাহায্য করে। উঁচু হীল যুক্ত জুতো এক্ষেত্রেও নারীসুলভ বৈশিষ্ট্যগুলিকে আরও স্পষ্ট করে দিয়ে নারীকে দর্শকের মস্তিষ্কের স্বজ্ঞাত অঞ্চলের কাছে আকর্ষণীয়া করে তোলে – উঁচু হীল যুক্ত জুতো যেমন পায়ের পাতার কার্যকরী দৈর্ঘ্য কমিয়ে দেয়, তেমনই এই জুতো পরে হাঁটার সময় দেহের ভারসাম্য রক্ষার্থে পদক্ষেপের দৈর্ঘ্য ও একক সময়ে পদক্ষেপের সংখ্যা উভয়ই কমে যায়। এছাড়াও পূর্বে বর্ণিত দেহের অতিরিক্ত অভিকর্ষীয় স্থিতিশক্তির কিছুটা “পেলভিস”-র দোলন শক্তিতে (অসিলেশন এনার্জি) রূপান্তরিত হয় বলে উঁচু হীল যুক্ত জুতো পরে হাঁটলে “পেলভিস”-এর দোলন অনেক বেড়ে যায়। তবে একটা কথা কখনও ভোলা উচিত নয় যে উঁচু হীল যুক্ত জুতোর দীর্ঘদিন ব্যবহারে পায়ের পাতা ও গোড়ালিতে নানান সমস্যা দেখা দিতে পারে !

নিজের সাথে সাদৃশ্যের খোঁজ

বিবাহ ও বংশবৃদ্ধি প্রসঙ্গে আকর্ষণীয়তা বিবেচনা করার সময় আমাদের মস্তিষ্কের স্বজ্ঞাত অঞ্চল একটি অতিরিক্ত বিশ্লেষণমূলক কাজ সম্পাদন করে – সে আমাদের নিজেদের বাহ্যিক রূপ, ব্যক্তিত্ব, ও সামাজিক বৈশিষ্ট্য সংক্রান্ত “ফেনোটাইপ”-গুলির সাথে সামনের মানুষটার বাহ্যিক রূপ, ব্যক্তিত্ব, ও সামাজিক বৈশিষ্ট্য সংক্রান্ত “ফেনোটাইপ”-গুলোর সাদৃশ্য কতটা তা খতিয়ে দেখে; যত বেশী সাদৃশ্য সে খুঁজে পায়, সামনের মানুষটা তত বেশী আকর্ষণীয় বলে বিবেচিত হন। একটি বিশেষ কারণে মস্তিষ্কের স্বজ্ঞাত অঞ্চল এই সাদৃশ্য খোঁজে। যে কোন জীবের বৈশিষ্ট্যগুলি নির্ধারিত হয় তার জিনগুলি দ্বারা। জিন দ্বারা নির্ধারিত এই বৈশিষ্ট্যকে বলা হয় “ট্রেইট্”। কোন জীবের মধ্যে কোন “ট্রেইট্” পর্যবেক্ষণযোগ্য তখনই হয় যখন সেই “ট্রেইট্” জীবটিকে পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে কোন কার্যকরী ভূমিকা পালন করে ও এইরকম পর্যবেক্ষণযোগ্য কতগুলি “ট্রেইট্” নিয়েই তৈরি হয় এক একটি “ফেনোটাইপ”। কোন কোন “ফেনোটাইপ”-র মধ্যে এমন একাধিক “ট্রেইট্” থাকে যারা পরস্পরের উপর নির্ভরশীল হয় অর্থাৎ “ট্রেইট্”-গুলির মধ্যে একটি “ট্রেইট্” যদি অনুপস্থিত থাকে, বাকি “ট্রেইট্”-গুলি কোন কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে অক্ষম হয়; ফলে জীবটির অস্তিত্ত্ব সংকটাপন্ন হয় ! পিতা ও মাতার “ফেনোটাইপ”-গুলির মধ্যে খুব বেশী বৈসাদৃশ্য থাকলে সন্তানের “ফেনোটাইপ”-গুলিতে কোন কোন “ট্রেইট্” নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয় ! এখন বুঝতে পারছেন যে কেন বিয়ের প্রসঙ্গে আমরা আমাদের হবু জীবনসঙ্গিনী বা জীবনসঙ্গীর মধ্যে নিজের সাথে কি কি মিল আছে তা খুঁজি?

উপসংহার:

উপরে বর্ণিত বিশ্লেষণমূলক কাজগুলির তাৎপর্য্য সংক্ষিপ্ত আকারে বললে – মস্তিষ্কের স্বজ্ঞাত অঞ্চল নির্দিষ্ট বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য খতিয়ে দেখতে নির্দিষ্ট বিশ্লেষণমূলক কাজ সম্পাদন করে। কিছু বৈশিষ্ট্য মস্তিষ্কের স্বজ্ঞাত অঞ্চলকে সামনের মানুষটি পুরুষ না স্ত্রী সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সাহায্য করে। এক্ষেত্রে যদি স্বজ্ঞাত অঞ্চল এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে মানুষটি পুরুষ, তবে মানুষটির পুরুষসুলভ বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যগুলি স্বজ্ঞাত অঞ্চলের কাছে যত বেশী সুস্পষ্ট হয়, মানুষটি স্বজ্ঞাত অঞ্চলের কাছে তত বেশী আকর্ষণীয় বলে বিবেচিত হন। একইভাবে মস্তিষ্কের স্বজ্ঞাত অঞ্চল একজন নারী বাহ্যিকভাবে কতখানি আকর্ষণীয়া তা বিবেচনা করে। আবার এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যা মস্তিষ্কের স্বজ্ঞাত অঞ্চলকে লিঙ্গ নির্বিশেষে একজন মানুষের বাহ্যিক রূপ আকর্ষণীয় কিনা সেই সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সাহায্য করে।

মস্তিষ্কের প্রোসিডিউরাল লং টার্ম মেমোরি-কে বলা হয় “অচেতন স্মৃতি”। তাই আমাদের প্রোসিডিউরাল লং টার্ম মেমোরি-তে নির্ধারিত এই বিশ্লেষণমূলক কাজগুলির ব্যাপারে আমরা কিছু টের পাই না, স্বজ্ঞাত অঞ্চল কাজগুলি সম্পাদন করার সময়ও কাজগুলিকে আমরা বিশদে উপলব্ধি করি না, কিন্তু স্বজ্ঞাত অঞ্চল সামনের মানুষটার বাহ্যিক রূপের আকর্ষণীয়তা সম্পর্কে যে সিদ্ধান্ত নেয় সেটা আমরা টের পাই – আমাদের উপলব্ধি হয় যে মানুষটা আকর্ষণীয় বা সাদামাটা বা কুৎসিত।

Share
Written by
Diganta Paul -

জন্ম: ১৯৮৯ সালে ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হাওড়া জেলায়। শিক্ষা: প্রাথমিক, মাধ্যমিক, ও উচ্চ-মাধ্যমিক শিক্ষা হাওড়া জিলা স্কুলে। এরপর কলকাতার "সেইন্ট থমাস্ কলেজ অফ এঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনলজি" কলেজ থেকে বৈদ্যুতিক কারিগরিবিদ্যা নিয়ে প্রযুক্তিতে স্নাতক (B.Tech. in Electrical Engineering)। পেশা: তথ্য প্রযুক্তি পেশাদার (IT Professional)। নেশা: বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা নিয়ে পড়াশোনা ও চিন্তাভাবনা। এছাড়াও বিজ্ঞান প্রবন্ধ, বিজ্ঞান নিবন্ধ, কল্পবিজ্ঞান ভিত্তিক গল্প, কল্পবিজ্ঞান কবিতা, গাণিতিক কল্পকাহিনী, বিজ্ঞান নাটক, ও বিজ্ঞান কবিতা লেখা। উল্লেখযোগ্য পুরস্কার: বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ কর্তৃক প্রদত্ত অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি রৌপ্য পদক। যোগাযোগ: [email protected]

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচিকিৎসা বিদ্যাসাক্ষাৎকারস্বাস্থ্য ও পরিবেশ

আমাদের গর্ব ড. ফারিয়াহ মাহযাবীন

কৃতি বিজ্ঞানীদের সিরিজে আমি কথা বলেছি ড. ফারিয়াহ মাহযাবীন এর সাথে। তিনি...

GenZপরিবেশ ও পৃথিবীসাক্ষাৎকারস্বাস্থ্য ও পরিবেশ

ই-বর্জ্য এর গবেষক হৃদয় রায়

ই-বর্জ এর গবেষক হৃদয় রায়। বাংলাদেশের মধ্যে ই-বর্জ নিয়ে কাজ করছে এমন...

স্বাস্থ্য ও পরিবেশ

অন্ধকারে ভয়

কোন ব্যক্তি বাস্তবে যতই সাহসী হোন না কেন, গভীর রাতে অন্ধকার জনশূন্য...

স্বাস্থ্য ও পরিবেশ

পাখার শব্দে নাম যে পাখির

ঈগল, বাজ ইত্যাদি পাখি মানুষকে এরোপ্লেন আবিষ্কারের অনুপ্রেরণা জোগালেও ফড়িং, মৌমাছি ইত্যাদি...

স্বাস্থ্য ও পরিবেশ

মাছরাঙার মাছ ধরা

একটি মাছরাঙা প্রতিদিন নিজের ওজনের প্রায় সম পরিমাণ ছোটো মাছ শিকার করে...

Three Columns Layout

বাংলাদেশি গবেষকদের কমিউনিটি বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org), যা বাংলা ভাষায় গবেষণা সংক্রান্ত তথ্য ও সাক্ষাৎকার শেয়ার করে নতুনদের গবেষণায় প্রেরণা দেয়।

যোগাযোগ

[email protected]

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

যোগাযোগ:

biggani.org@জিমেইল.com

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.