কোয়ান্টাম কম্পিউটিংসাক্ষাৎকার

GenZ নতুন প্রজন্মের বিজ্ঞানী আরমান সৈকত

Share
Share

নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা যে শুধু আমাদের সমাজকে পরিবর্তন করার জন্য কাজ করছে তাই নয়, পাশাপাশি তারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়গুলিতেও কাজ করছে। সামনের বিশ্বে যে কয়েকটি প্রযুক্তি নিয়ে সবাই আশাবাদী তার মধ্যে আলোচিত হল কোয়ান্টাম কম্পিউটিং। আর এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে নতুন প্রজন্মের এক বিজ্ঞানী আরমান সৈকত।


নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মাহাদি রহমানের সাথে আমার যোগাযোগ ছিল। তাঁরই ফেসবুকে একটি ছোট পোস্ট আমার নজর কাড়লো। তিনি শেয়ার করেছেন তারই এক ছাত্রের গবেষনা কাজ। একটু বিস্তারিত সেই গবেষণা প্রবন্ধটি পড়ে চমৎকৃত হলাম। কোয়ান্টাম মেকানিক্স এবং ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স এই দুটি প্রযুক্তি ব্যবহার করে একধরনের হাইব্রিড প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন যেটি কোনো তথ্যকে গোপনীয়তার কাজে (প্রযুক্তির ভাষায় যাকে এনক্রিপ্ট অথবা ডিক্রিপ্ট বলা হয়) ব্যবহার করা যাবে। এই গবেষনার কাজটি করেছেন আমাদেরই নতুন প্রজন্মের বিজ্ঞানী আরমান সৈকত। তার প্রবন্ধ এবং গবেষনার কাজটি দেখে সত্যিই অবিভূত হলাম।

নিচে আরমান সৈকত এর ফেসবুকের পোস্টটি শেয়ার করলাম:

দেরি না করে আমি যোগাযোগ করি আরমান সৈকত এর সাথে এবং বিজ্ঞানী ডট অর্গ এ এই নবীন বিজ্ঞানীর সাক্ষাৎকার নিতে আগ্রহ প্রকাশ করি। নিম্নে তার সাক্ষাৎকারটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো। নতুন প্রজন্মের এই বিজ্ঞানীরা সঠিক দিকনির্দেশনা এবং সাপোর্ট পেলে তারা অনেক বড় কিছু করতে পারে। তাই আমাদের উচিত আরমান সৈকত এর মতন নবীন বিজ্ঞানীদেরকে আরো বড় হওয়ার জন্য সাপোর্ট দেয়া।

আরমান সৈকত এর সাক্ষাৎকার

আপনার একটা সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিন

আমি আরমান সৈকত, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় এর কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, অন্ডারগ্রাডে অধ্যায়নরত। এটিই আমার শেষ সেমিস্টার।

কে আপনাকে বিজ্ঞানী হতে উদ্বুদ্ধ করলো

ছোটবেলা থেকেই আমার সায়েন্স ফিকশন বই এবং সিনেমা অনেক ভালো লাগতো। সব সময় একটা ইচ্ছা ছিল যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা বানাতে হবে। মূলত সেখান থেকেই প্রথম ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিনেমা থেকে আমি অনেক মোটিভেটেড হই, যেমন: A beautiful mind, The man who knew infinity, APJ Abdul Kalam Biography by Gulzar Saab. যদিও সত্য বলতে এখনও কিছুই করি নি, কিন্তু প্রবল ইচ্ছা আছে। 

বিজ্ঞানের এত বিষয়ে থাকতে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং নিয়ে আগ্রহ কেন?

আমার সিজিপিএ অসম্ভব রকমের কম। অবিশ্বাস্য রকমের কম। অ্যাকাডেমিক ফলাফলের দিক দিয়ে আমি অনেক পিছনের সারির একজন ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকার পরে আমার তেমন কোনো কিছু পড়তে ভালো লাগতো না। তখন অনেকের কাছে শুনতাম যে, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং বিষয় টা অনেক কঠিন এবং সবাই বুঝে না। তখন আমি এটিকে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিই এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্স এর প্রযুক্তি সম্বন্ধে বিস্তারিত পড়ি। অনেকটা  সায়েন্স ফিকশন বইয়ের মতন করে যেভাবে সবাই পড়ে। আমার মধ্যে প্রবল একটি ইচ্ছে হয় এবং উত্তরোত্তর আগ্রহ আরো বেড়ে গেল। আমার কোনো কিছুর প্রতি একবার আগ্রহ বেড়ে গেলে সেটি আমার অনেক প্রিয় হয়ে যায়। সেই সময়ে আমার সুপারভাইজার ড. মাহদি রহমান চৌধুরী কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এর উপরে তার কিছু লেকচার ভিডিও দেন। ওগুলো দেখার পর মনে হয় যে “আমি তো আমার জীবনে এমন কিছুই খুঁজছিলাম”। সেই সময়ে চতুর্থ বর্ষে ফাইনাল ইয়ারের  থিসিস এর জন্য আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি এই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করবো এবং এটিতে কন্ট্রিবিউট বা অবদান করতেই হবে। একটি তীব্র ইচ্ছা আমার মধ্যে জেগে উঠে। 

আপনার এই গবেষণার প্রবন্ধ টা একটু সংক্ষেপে আমাদের বুঝিয়ে বলুন।

মূলত আমার উদ্ভাবিত এই প্রযুক্তিটিতে কোয়ান্টাম মেকানিক্স এবং ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স এর সমন্বয়ে উদ্ভাবিত একটি হাইব্রিড টেকনোলজি। মূলত এটি ব্যবহৃত হবে যেকোনো তথ্য এনক্রিপ্ট (সুরক্ষা) অথবা ডিক্রিপ্ট (পুনরুদ্ধার) করার জন্য। যখন আমরা কোনো কিছু এনক্রিপ্ট করতে চাই তখন আমাদের প্রয়োজন হয় key (চাবি) এর, এই key কিছুটা পাসওয়ার্ড এর মতো কাজ করবে। বর্তমানে যে সকল ক্লাসিক্যাল উপায়ে key গুলো তৈরি হয় ওই সকল উপায়গুলি ভবিষ্যতের কোয়ান্টাম প্রযুক্তির যুগে নিরাপদ হবে না। কোয়ান্টাম কম্পিউটার অনেক শক্তিশালী বলে সেই নিরাপত্তার চাবি (key) গুলি খুবই সহজে ভেঙ্গে ফেলতে পারবে বা জেনে ফেলতে পারবে। ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সব থেকে মজার বিষয় হল এনট্যাঙ্গলমেন্ট। ২i টা qubit entangled state এ থাকলে আপনি qubit দুইটাকে যতই আলাদা করেন না কেন, এরা সবসময় একটা entangled সম্পর্ক বজায় রাখবে। এই entanglement কনসেপ্ট থেকে একার্ট ১৯৯১ সালে E৯১ প্রোটোকল নিয়ে আসে, যেটি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সূত্র অনুসরণ করে key ডিস্ট্রিবিউট করবে এবং বর্তমানের কোনও প্রযুক্তি এটি ব্রিচ বা ভাঙ্গতে পারবে না। এই E৯১ প্রোটোকল থেকে key তৈরির পর এটিকে ক্লাসিক্যাল হ্যাশিং দিয়ে হ্যাশ করা হচ্ছে। ফলে কেউ কখনই ধরতে না পারে যে key জেনারেটার আসলে কতগুলো qubit ব্যবহার করেছে। যেমন আপনি যদি ২০ qubit ব্যবহার করেন এবং ২৫৬bit হ্যাশ ব্যবহার করেন, তাহলে আপনি ২০ qubit দিয়ে ২৫৬bit এর স্ট্রিং পাবেন, এখন আপনি ৩০ qubit ব্যবহার করলেন, তখনও আপনি ২৫৬bit এর স্ট্রিং পাবেন। তারপর এই হ্যাশ স্ট্রিং টা যাবে AES (Advanced Encryption Standard) এর মধ্যে যা কিনা আরেকটি ক্লাসিক্যাল পদ্ধতি। AES যেকোনো তথ্যকে এনক্রিপ্ট বা সুরক্ষা করতে সাহায্য করবে, কোনো প্রযুক্তি এখন পর্যন্ত AES ভাঙতে পারে নি। কোয়ান্টাম টেকনোলজি দিয়ে key ডিস্ট্রিবিউশন এবং AES, হ্যাশ দিয়ে এনক্রিপ্ট করা, সার্বিকভাবে একসাথে যে সিকিউরিটি সিস্টেম তৈরি করে তা বর্তমানে কোনো প্রযুক্তি তা ভাঙতে পারবে না, এবং সাথে স্টেগনোগ্রাফি (Steganography) যদি ব্যবহার করা হয়, তাহলে তো আরো শক্তিশালী হবে যেমনটি আমি আমার বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধে আমি দেখিয়েছি।

স্টেগনোগ্রাফি কি?

স্টেগনোগ্রাফি (Steganography) হলো এমন একটি কৌশল যার মাধ্যমে তথ্য বা বার্তা লুকানো হয় অন্য কোনো তথ্যের মধ্যে, যাতে বাহ্যিকভাবে কেউ বুঝতে না পারে যে সেখানে আসলে লুকানো তথ্য রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, একটি ছবির মধ্যে আপনি কোনো গোপন বার্তা লুকিয়ে রাখতে পারেন, যেটা ছবি দেখলে সাধারণভাবে বোঝা যাবে না। স্টেগনোগ্রাফি শব্দটি এসেছে গ্রিক ভাষা থেকে, যেখানে “steganos” মানে “গোপন” এবং “graphy” মানে “লেখা”। এটি সাধারণত বিভিন্ন ধরনের ডিজিটাল মিডিয়াতে, যেমন ছবি, অডিও, ভিডিও ইত্যাদির মধ্যে গোপন বার্তা লুকিয়ে রাখার জন্য ব্যবহৃত হয়। স্টেগনোগ্রাফির উদ্দেশ্য হলো, তথ্য লুকানো এমনভাবে যাতে কেউ সহজে তা শনাক্ত করতে না পারে। এটি সাধারণত সাইবার সিকিউরিটি, গোপন বার্তা প্রেরণ, এবং তথ্য সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়।

অনেকেই বলে বাংলাদেশের বসে গবেষণা করা কঠিন, আপনার মতামত কি?

আমি যেহেতু কখনোও বাংলাদেশের বাইরে গিয়ে গবেষণা করিনি, তাই সঠিকভাব বলতে পারব না। যদি কখনও অন্য দেশে গিয়ে গবেষণা করি, তখন আমি বলতে পারব যে বাংলাদেশে গবেষণা কঠিন নাকি সহজ।

তরুণ প্রজন্ম যারা আপনার মতন গবেষণা করতে চায় তাদের জন্য আপনার ম্যাসেজ বা বর্তা কি?

একটা খুব সাধারণ বার্ত দিতে চাই, “discipline over anything”. আর এই ডিসিপ্লিন (শৃঙ্খলা) এমনিতেই চলে আসবে যদি নিজের ভালোলাগার কোনো বিষয় খুঁজে পাওয়া যায়।

একজন গবেষকের কোন গুণ গুলি থাকা জরুরি বলে মনে করেন ?

আমার মনে হয় ডিসিপ্লিন (শৃঙ্খলা), ডেডিকেশন (আত্মোৎসর্গ), কখনও নিজেকে underestimate (underestimate) করা যাবে না, এবং ধৈর্য। কোনও আইডিয়া (কল্পনা) মাথার মধ্যে ২-৩ দিনে আসে না, হুট করে চলে আসবে, কখন আসবে কেউ জানে না। আর ততক্ষণ পর্যন্ত পড়াশুনা করতে হবে, তাই ধৈর্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

প্রবন্ধটির নাম: Multi-Layered Security System: Integrating Quantum Key Distribution with Classical Cryptography to Enhance Steganographic Security

বিজ্ঞানীদের নাম: Arman Sykot, Md Shawmoon Azad, Wahida Rahman Tanha, BM Monjur Morshed, Syed Emad Uddin Shubha, M.R.C. Mahdy

বিষয়: Subjects: Quantum Physics; Cryptography and Security

প্রবন্ধটির লিংক: https://arxiv.org/abs/2408.06964


বিজ্ঞানী ডট অর্গ এর পক্ষ থেকে আরমান সৈকত এবং তার সাথে কাজ করা অন্যান্য বিজ্ঞানী মো. সৌমুন আজাদ, ওয়াহিদা রহমান তানহা, বি.এম. মঞ্জুর মোরশেদ, সৈয়দ ইমাদ উদ্দিন শুভ কে শুভেচ্ছা জানাই। আর অবশ্যই এই নবীন বিজ্ঞানীদের তৈরির কাজটি করার জন্য ড. মাহাদি রহমান-কে স্যালুট। ড. মাহাদি রহমান এর কাজ এবং উদ্যোগ আমাদের বাংলাদেশের অন্যান্য শিক্ষকদেরও নবীন বিজ্ঞানী তৈরিতে ভূমিকা রাখবে বলেই বিশ্বাস করি।

লেখক: ড. মশিউর রহমান, বিজ্ঞানী ডট অর্গ এর সম্পাদক।

Share
Written by
ড. মশিউর রহমান -

ড. মশিউর রহমান বিজ্ঞানী.অর্গ এর cofounder যার যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০০৬ সনে। পেশাগত জীবনে কাজ করেছেন প্রযুক্তিবিদ, বিজ্ঞানী ও শিক্ষক হিসাবে আমেরিকা, জাপান, বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুরে। বর্তমানে তিনি কাজ করছেন ডিজিটাল হেল্থকেয়ারে যেখানে তার টিম তথ্যকে ব্যবহার করছেন বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবার জন্য। বিস্তারিত এর জন্য দেখুন: DrMashiur.com

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
বিজ্ঞান বিষয়ক খবরসাক্ষাৎকার

রউফুল আলম: বিজ্ঞানচর্চার পথ ধরে এক অনুসন্ধিৎসু গবেষকের গল্প!

বিজ্ঞানচর্চা মানেই এক অজানা জগতে প্রবেশ, যেখানে নতুন আবিষ্কার এবং উদ্ভাবনের পথ...

সাক্ষাৎকার

ড. নওরীন হক: একজন উদ্ভাবনী গবেষক ও শিক্ষিকা!

ড. নওরীন হক গবেষণার পাশাপাশি RIT-এর সাইবার সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টে কোর্স ইন্সট্রাক্টর হিসেবে...

বিজ্ঞান বিষয়ক খবরসাক্ষাৎকার

মহাবিশ্বের অজানা রহস্য: ড. সৈয়দ আশরাফ উদ্দিনের গবেষণা এবং ভাবনা!

ড. সৈয়দ আশরাফ উদ্দিন, একজন নিবেদিত শিক্ষক ও গবেষক, বর্তমানে University of...

বিজ্ঞান বিষয়ক খবরসাক্ষাৎকার

রেডিও ওভার ফাইবার: উচ্চগতির ডেটা ট্রান্সমিশনে ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি ও এর সম্ভাবনা!

বর্তমানে প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতির যুগে, উচ্চগতির ডেটা ট্রান্সমিশন একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে...

চিকিৎসা বিদ্যাসাক্ষাৎকার

ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন দিগন্ত: ড. ইশতিয়াক রশিদের পথচলার গল্প!

ইশতিয়াক রশিদ, একজন প্রক্রিয়া উন্নয়ন বিজ্ঞানী, ক্যান্সার চিকিৎসায় ডিএনএ সংশোধন প্রক্রিয়ার ভূমিকা...

Three Columns Layout

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact

biggani.org❤️gmail.com

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

যোগাযোগ:

biggani.org@জিমেইল.com

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.