রাতের পাড়ায় ছড়িয়ে থাকা নির্জনতার মধ্যে, দূর থেকে ভেসে আসছিল অসুস্থ শিশুর কান্না। একাকী সেই কান্নার আহ্বান যেন ডাক দিচ্ছিল কোনো পরম মমতাময় চিকিৎসকের—যিনি প্রয়োজনের মুহূর্তে সাড়া দেবেন। শোনা যায়, বহু শতাব্দী আগে এমনই এক আধ্যাত্মিক ডাক পেয়েছিলেন একজন মানুষ। তিনি আর কেউ নন—মুসলিম চিকিৎসাবিদ্যার উজ্জ্বল প্রতিভা আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া আল–রাজি; ইতিহাসে যিনি ‘আর–রাজি’ নামে অধিক পরিচিত।
শৈশব ও প্রথম জীবন
ইরানের রাই শহরে জন্ম নেওয়া আল–রাজি (৮৬৫–৯২৫ খ্রিষ্টাব্দ) শৈশব থেকে ছিলেন অনুসন্ধিৎসু। কেমিস্ট্রি থেকে দর্শন—প্রতিটি বিষয়েই ছিল তার অদম্য আগ্রহ। নিজ শহরেই প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে তিনি বেরিয়ে পড়েন জ্ঞানতীর্থে। শোনা যায়, তরুণ বয়সেই নিজস্ব ল্যাবরেটরি গড়ে তোলেন, যেখানে দীর্ঘ সময় কাটাতেন রসায়ন ও ওষুধের উপাদান নিয়ে নীরব গবেষণায়।
ক্যারিয়ারের শুরুর পথচলা
বাগদাদে অবস্থানের সময় আল–রাজির কৃতিত্ব ছড়িয়ে পড়ে দূরদূরান্তে। ধাপে ধাপে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞ হিসেবে। বিশেষ করে বসরা ও বাগদাদের বহু হাসপাতালে পরামর্শক ও প্রধান চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেছেন। তার অন্যতম বড় পরিচিতি—চিকিৎসাক্ষেত্রে বিজ্ঞাননির্ভর পরীক্ষা–নিরীক্ষার ভিত্তি স্থাপন।
আধুনিক চিকিৎসাবিদরা প্রায়ই তার অনন্য পাণ্ডুলিপি “আল-হাভি” বা “কিতাবুল হাওয়ি”-র কথা উল্লেখ করেন, যা একাধারে চিকিৎসাশাস্ত্রের তত্ত্ব, রোগনির্ণয় এবং ওষুধসংক্রান্ত তথ্যের একটি বৃহৎ ভাণ্ডার।
আল–রাজির প্রধান অবদান
ইতিহাসবিদ ড. নাসরুল ইসলাম বলছেন, “আল–রাজি শুধু মুসলিম সমাজেই নয়, সমগ্র বিশ্বে চিকিৎসাবিদ্যার বিকাশে অমূল্য অবদান রেখেছেন। তিনি প্রায়ই রোগীদের ক্ষেত্রে ‘ব্যক্তিক চিকিৎসা পরিকল্পনা’ অনুসরণ করতেন, যা রোগীর শারীরিক অবস্থা ও জীবনযাত্রার ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসার ধরন স্থির করত। আজকের দিনে এ পদ্ধতিকে বলা হচ্ছে পার্সোনালাইজড মেডিসিন।”
সেই সময়কালে বসন্ত (Smallpox) ও হাম (Measles) এর মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা ছিল বহুল আলোচিত একটি সাফল্য। আল–রাজি নিজস্ব ক্লিনিক্যাল পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বুঝেছিলেন, উভয়েই ম্যালিগন্যান্টভাবে ছড়ালেও আলাদা আলাদা লক্ষণ ও স্নায়বিক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে। এ আবিষ্কার চিকিৎসাশাস্ত্রে একটি নতুন মাত্রা নিয়ে আসে এবং পরবর্তীতে আধুনিক ইমিউনোলজির পথ প্রশস্ত করে।
পাঠকদের অনুভূতি
স্বাস্থ্যসচেতন নাগরিক ফাতিমা আলম এক অনুষ্ঠানে বলেন, “আমরা প্রায়ই গ্রিক কিংবা আধুনিক পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের নাম শুনে থাকি। কিন্তু আল–রাজির মতো মুসলিম মনীষীদের ব্যাপারে পর্যাপ্ত আলোচনার অভাব রয়ে গেছে। তারা কেবলমাত্র ইসলামি সভ্যতার নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের মনীষী।” ফাতিমার মতো অনেকেই মনে করেন, আল–রাজির নাম নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে পাঠ্যক্রম থেকে শুরু করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার প্রচারণার প্রয়োজন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ড. আহসান আলী বলেন, “আল–রাজি ছিলেন সত্যিকারের ‘চিকিৎসক দার্শনিক’। বর্তমান প্রজন্ম অনেক আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করছে, যার ভিত্তি খুঁজলে দেখা যাবে—আল–রাজি সহ তৎকালীন মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের তত্ত্ব ও গবেষণা ভূমিকা রেখেছে। তাদের কাজের সম্মান জানানোর জন্যই আমাদের উচিত আরো গবেষণা আর তথ্যসংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া।”
সমসাময়িক প্রভাব ও মূল্যায়ন
চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে আল–রাজির নাম জ্বলজ্বল করছে জ্ঞান, মানবসেবা ও যুক্তিনির্ভর গবেষণার প্রতীক হিসেবে। তার সময়ে বিজ্ঞানকে ধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক মনে করা হলেও, তিনি বারবার জোর দিয়েছেন যে সত্যিকারের জ্ঞান সবসময়ই মানবকল্যাণের পথে এগিয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে রোগনির্ণয় ও চিকিৎসা—উভয় ক্ষেত্রেই যুক্তিনির্ভর পদ্ধতির প্রয়োগ শুরু হয়, যা পরবর্তীতে পাশ্চাত্য জগতে রেনেসাঁর আমলে আরও বিকশিত হয়।
ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখা যায়, নিজের সময়ে চ্যালেঞ্জ ও সমাজের বাঁধাধরা নিয়ম সত্ত্বেও আল–রাজি কখনো গবেষণা ও পরীক্ষা–নিরীক্ষা থামাননি। মানবতার কল্যাণে বিজ্ঞানকে সম্পূর্ণভাবে কাজে লাগানোই ছিল তার সাধনা। এই প্রয়াস থেকেই তার মেধা ও অবদান আজও বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পাচ্ছে।
পরিশিষ্ট
আল–রাজির জীবন কেবল একজন বৈজ্ঞানিক চিকিৎসাবিদের কৃতিত্বের কথাই নয়, বরং মানুষের প্রতি অগাধ ভালোবাসার গল্প। রাতের অন্ধকারে অসহায় মানুষের আহ্বানে সাড়া দেওয়ার মধ্য দিয়ে তার পথচলা শুরু হয়েছিল, যা অব্যাহত ছিল আজীবন। ঠিক সেভাবেই আজও গবেষণাগারে, হাসপাতালের শয্যায়, কিংবা মেডিকেল শিক্ষাকেন্দ্রে—তার নাম উচ্চারিত হচ্ছে অবিচ্ছিন্ন শ্রদ্ধায়। সাম্প্রতিক কালের স্বাস্থ্যসেবা কাঠামোতে তার প্রদর্শিত পথ ও চিন্তা–দর্শন আরো প্রতিষ্ঠিত হোক, এটাই সবার কামনা।
সাংবাদিক হিসাবে আমরা শুধু ঘটনা ও তথ্যের নিরপেক্ষ প্রতিবেদন করছি। পাঠকদের কাছে অনুরোধ, আল–রাজির মতো মনীষীদের জীবনকাহিনি ও মূল্যবান অবদান সম্পর্কে যথেষ্ট জানুন ও জানিয়ে দিন পরবর্তী প্রজন্মকে।
Leave a comment