কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) আমাদের জীবনকে দ্রুত বদলে দিচ্ছে। চ্যাটজিপিটি, ক্লড ও জেমিনির মতো আধুনিক প্রযুক্তিগুলো এখন কাজের গতি ও দক্ষতা বাড়ানোর অন্যতম হাতিয়ার। তবে, সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, এআই প্রযুক্তি ব্যবহারে পুরুষের তুলনায় নারীরা উল্লেখযোগ্যভাবে পিছিয়ে রয়েছেন। এটি শুধু বাংলাদেশের নয়, বরং বৈশ্বিক সমস্যা, যার ফলাফল অর্থনীতি ও সমাজের জন্য দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় ও ডেনমার্কের কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা ডেনমার্কের ১ লাখ কর্মীর ওপর জরিপ চালিয়ে দেখেছেন, একই কোম্পানি ও একই ধরনের কাজের ক্ষেত্রেও নারীরা পুরুষদের তুলনায় প্রায় ২০% কম চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করেন। এমনকি একই প্রতিষ্ঠানের ভেতরেও এই ব্যবধান স্পষ্টভাবে লক্ষ্যণীয়। গবেষণায় দেখা গেছে, পুরুষেরা সাধারণত কোডিং বা প্রযুক্তিগত জটিল সমস্যা সমাধানের জন্য বেশি এআই ব্যবহার করেন, যেখানে নারীরা মূলত কম্পোজিশন, যোগাযোগ এবং ডকুমেন্টেশন সংশোধনে এআই-এর সাহায্য নেন।
বাংলাদেশের জন্য এই চিত্র আরও উদ্বেগজনক। আমাদের দেশের নারী শ্রমিকরা অনেক ক্ষেত্রে এমন পেশায় নিয়োজিত, যেগুলো স্বয়ংক্রিয়করণের ঝুঁকিতে বেশি। বিশেষত গার্মেন্টস, ডাটা এন্ট্রি ও গ্রাহকসেবার মতো কাজগুলো অটোমেশনের ফলে বিলুপ্তির পথে রয়েছে। এই প্রযুক্তিগত দক্ষতায় পিছিয়ে থাকার অর্থ হলো ভবিষ্যতের চাকরি বাজারে নারীদের আরও পিছিয়ে পড়া। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশের নারীদের মৌলিক ডিজিটাল দক্ষতায় পুরুষদের তুলনায় ২৫% পিছিয়ে থাকার তথ্য উঠে এসেছে।
কেন এই পার্থক্য? কারণগুলোর মধ্যে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য হলো—নারীদের মধ্যে এআই ব্যবহারের শুরু করার সুযোগ এবং নির্দিষ্ট দিকনির্দেশনার অভাব। নতুন প্রযুক্তি দ্রুত পরিবর্তনশীল, এবং এর সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত সময় ও প্রশিক্ষণ। কিন্তু নারীরা পরিবার, সন্তান লালন-পালন, এবং গৃহস্থালির অবৈতনিক কাজে সময় বেশি ব্যয় করেন, ফলে তাদের জন্য সময় বের করা কঠিন হয়ে পড়ে।
এছাড়া সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কিছু ধারণা নারীদের প্রযুক্তিতে পিছিয়ে রাখে। “নারীরা প্রযুক্তিতে দুর্বল”—এমন ধারণা আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি তৈরি করে। কর্মক্ষেত্রেও নারী কর্মীদের জন্য প্রয়োজনীয় সমর্থন এবং প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। এমনকি অনেক সময় নারী কর্মীদের এআই ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়া হয় না, বা তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না।
এই ব্যবধান শুধু ব্যক্তি নারীদের জন্যই ক্ষতিকর নয়, এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে এআই কর্মশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ মাত্র ৩০%-এর কম। এর ফলে যে প্রযুক্তি আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে, তা অনেকাংশে পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি হচ্ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে এআই প্রযুক্তির পক্ষপাতিত্ব আরও বাড়বে, যা চাকরির সুযোগ, স্বাস্থ্যসেবা এবং অর্থনৈতিক সেবাগুলোতে নারীদের প্রতি বৈষম্য আরও বৃদ্ধি করবে।
তাহলে কীভাবে ভাঙবে এই ব্যবধান? সমাধানের জন্য প্রয়োজন বহুমুখী পদক্ষেপ। স্কুল-কলেজ পর্যায় থেকেই নারীদের এআই এবং ডিজিটাল সাক্ষরতা নিশ্চিত করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে নারীদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ, মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম, এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। সামাজিক সচেতনতা এবং স্টেরিওটাইপ দূরীকরণের উদ্যোগও অপরিহার্য।
এছাড়া নারীদের জন্য বিশেষ প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা, যেখানে তারা সহজে ও আরামদায়ক পরিবেশে এআই ব্যবহার শিখতে পারবেন। উদাহরণস্বরূপ, এমপ্লিফাই প্ল্যাটফর্ম নারীদের জন্য ডিজাইন করা একটি সম্ভাবনাময় উদ্যোগ হতে পারে। এই ধরনের প্ল্যাটফর্মগুলোতে শেখার নমনীয়তা, কমিউনিটি সাপোর্ট, এবং ক্যারিয়ার উন্নয়নের দিকনির্দেশনা থাকবে।
সর্বোপরি, নারীদের জন্য এআই শেখার পথ সুগম করা একটি অপরিহার্য বিনিয়োগ। কারণ, বৈচিত্র্যের মাধ্যমেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হবে সত্যিকার অর্থে মানবিক এবং সবার জন্য উপযোগী। বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন ও ডিজিটাল রূপান্তরের সাফল্যের জন্য নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে এআই প্রযুক্তির কেন্দ্রে নিয়ে আসা অত্যন্ত জরুরি।
Leave a comment