AI-এর সহায়তায় প্রাণীদের ভাষা অনুবাদের চেষ্টা বৈপ্লবিক সম্ভাবনা তৈরি করছে বিজ্ঞানীদের গবেষণায়
গভীর সমুদ্রের নীলাভ অন্ধকারে এক বিশাল স্পার্ম তিমি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। আশেপাশের নীরবতা ভেঙে দিয়ে সে হঠাৎ এক ধরনের শব্দ উচ্চারণ করল—যেন কিছু বলতে চাচ্ছে। তীর থেকে বেশ দূরে, ডমিনিকার সাগরের জলে বসানো একটি বয়ায় সংযুক্ত হাইড্রোফোন (জলতলের মাইক্রোফোন) সেই শব্দ রেকর্ড করছে। বিজ্ঞানী শেন গেরো উত্তেজিত কণ্ঠে বলেন, “প্রায় ২০ বছরের পর্যবেক্ষণে বুঝতে পেরেছি, এই তিমিগুলো নিজেদের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু শব্দ ব্যবহার করে। মানুষ যেমন ভাষার মাধ্যমে চিন্তা বিনিময় করে, তেমনই তারা এই শব্দের মাধ্যমে একে অপরকে চেনে।”
এই গল্প যেন কল্পবিজ্ঞানের মতো শোনালেও বাস্তবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) এই কল্পনাকে সত্য করে তুলতে পারে। সাম্প্রতিক কালে সারা বিশ্বেই বিজ্ঞানীরা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে প্রাণীদের ভাষা বোঝার চেষ্টায় ব্যাপকভাবে মনোনিবেশ করছেন।
বেশিরভাগ মানুষ বিশ্বাস করেন যে, প্রাণীদের নিজেদের আলাদা ভাষা রয়েছে। পশ্চিমা বিজ্ঞানীরা এতদিন মানুষের সাথে প্রাণীদের ভাষাগত তুলনা এড়িয়ে গেছেন। কিন্তু নিউ ক্যালেডোনিয়ার একটি নির্জন দ্বীপের বনে বসবাসকারী কাকের অসাধারণ হাতিয়ার তৈরির ক্ষমতা নিয়ে গবেষণা করা আচরণ বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান রুটজ মনে করেন, “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে প্রাণীদের যোগাযোগ পদ্ধতি বুঝতে আমরা বড় একটি বিপ্লবের মুখোমুখি।”
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, নিউ ক্যালেডোনিয়ার কাকরা সরঞ্জাম তৈরির পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য ভিন্ন ভোকালাইজেশন ব্যবহার করে, যা একে অন্যের কাছে প্রজন্মান্তরে পৌঁছায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এই ধরনের ভাষার ‘উপভাষা’ বা ডায়ালেক্টগুলোর অর্থ বুঝতে সহায়তা করতে পারে।
“এক সময় পশ্চিমা বিজ্ঞানীরা প্রাণীদের মানবিক গুণ দেওয়ার ভয়ে এই ধরনের গবেষণা এড়িয়ে যেতেন,” বলছিলেন বিজ্ঞান লেখিকা ক্যারেন বাক্কার, “কিন্তু আজ প্রযুক্তি এবং ডেটার অগ্রগতির কারণে বিজ্ঞানীরা সাহস করে এই ক্ষেত্রটি অনুসন্ধানে নেমেছেন।”
পৃথিবীর প্রাণী রাজ্যে ভাষা বোঝার জন্য বর্তমানে দুটি বড় উদ্যোগ চলছে: প্রোজেক্ট CETI (Cetacean Translation Initiative) এবং আর্থ স্পিসিজ প্রজেক্ট। CETI স্পার্ম তিমির ভাষা বুঝতে কাজ করছে, অন্যদিকে আর্থ স্পিসিজ প্রজেক্ট কাক, জেব্রা ফিঞ্চসহ বিভিন্ন প্রাণীর ভাষা বুঝতে উদ্যোগ নিয়েছে।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে প্রাণীর ভাষার ‘অনুবাদ’ করতে পারলে বিপন্ন প্রাণীদের রক্ষার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা যাবে। হাওয়াইয়ান কাকের ভাষা বিশ্লেষণে আর্থ স্পিসিজ প্রজেক্টের গবেষণা প্রাণী সংরক্ষণের নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে।
তবে গবেষকদের মতে, শুধুমাত্র ভাষার অর্থ বোঝাই যথেষ্ট নয়। এ বিষয়ে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (MIT)-এর অধ্যাপক ড্যানিয়েলা রুস বলেন, “ভাষার কাঠামো বোঝার আগে থেকেই AI সেই ভাষায় কথা বলতে পারবে।” এটি নতুন ধরনের নৈতিক প্রশ্নও তৈরি করছে, যেখানে প্রাণীদের ভাষা বুঝতে পারা সুবিধার পাশাপাশি অপব্যবহারের ঝুঁকিও তৈরি হতে পারে।
শেষ পর্যন্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই নতুন সম্ভাবনা শুধু প্রাণীজগতই নয়, বরং মানুষ হিসেবে আমাদের নিজেদের দেখার দৃষ্টিভঙ্গিও আমূল বদলে দিতে পারে। যেমন আর্থ স্পিসিজ প্রজেক্টের প্রতিষ্ঠাতা আজা রাসকিন বলেন, “আমরা এমন এক সময়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে হয়তো প্রাণীদের সঙ্গে আমাদের কথোপকথনের সুযোগ তৈরি হবে, যা আমরা এখনও পুরোপুরি বুঝিনি। আর সেটা হবে এক অনন্য অধ্যায়ের শুরু।”
Leave a comment