ঢাকার এক নির্মল সকালে, নারিন্দার গলিপথে দাঁড়িয়ে ছোট্ট মায়মূন সবে ফুটবল খেলা শেষ করে উঠছে। তার চোখে স্বপ্ন—ভবিষ্যতে সে বড় হয়ে আকাশে উড়তে চায়, পাইলট হতে চায়। মায়মূন জানে না, প্রায় এগারো শতাব্দী আগে এমনই এক স্বপ্ন দেখে বাস্তবের প্রয়াস করেছিলেন আরেক জ্ঞানতপস্বী: আব্বাস ফারনাস। ঠিক যেমন গাংচিল সূর্যাস্তের দিকে ডানা মেলে, তিনিও পাখির মতো আকাশ-মুক্তির পথে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন।
কিন্তু কে এই আব্বাস ফারনাস? কেন তাঁকে আজও ‘মুসলিম কিংবদন্তি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়? ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখা যায়, আব্বাস ইবনে ফিরনাস বা ফারনাস ছিলেন নবম শতকের আন্দালুসীয় এক বহুমুখী প্রতিভা। তিনি গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, রসায়ন ও সঙ্গীত-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছিলেন। অনেকে তাঁকে আধুনিক বৈমানিক প্রকৌশলের অগ্রদূত হিসেবে গণ্য করেন, কারণ তিনি নিজেই আকাশে ওড়ার চেষ্টা করে নতুন এক অধ্যায় রচনা করেছিলেন।
একটি নাটকীয় ঘটনা জানা যায়—গ্রানাডা অঞ্চলের পাহাড়ি স্তরে তিনি যথেষ্ট সাহস নিয়ে নিজের তৈরি ‘উড়ন্ত যন্ত্র’ বা নকল ডানা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। যদিও সে প্রচেষ্টা সম্পূর্ণভাবে সফল হয়নি, তবু সেই প্রচেষ্টা মধ্যযুগের ইউরোপে এক বৈপ্লবিক উদ্ভাবনার নিদর্শন হয়ে আছে। ফারনাসের এই প্রয়াস ছিল নিছক কৌতূহল নয়, বরং বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রতি অপরিমেয় এক অনুরাগের ফল। তাঁর অধ্যবসায় ও সাহসিকতা পরবর্তীতে বহু বিজ্ঞানীকে অনুপ্রাণিত করেছে, যা মুসলিম সভ্যতার স্বর্ণযুগের নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত।
ফারনাসের জীবন নিয়ে গবেষণা করা বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ডঃ রাশিদা নাসরিন বলেন, “আব্বাস ফারনাস ইতিহাসের এক বিস্মৃত নায়ক। তাঁর উদ্ভাবনী চিন্তাধারা যেমন ইসলামি সভ্যতার মুকুটে নতুন পালক যোগ করেছিল, তেমনি বিশ্বমানবতার জ্ঞানভাণ্ডারের পরিসরও বাড়িয়েছিল।” নাসরিনের মতে, বইপত্রের পাতায় আব্বাস ফারনাসকে স্থান দেওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। অথচ তিনিই ছিলেন প্রথম মানুষদের মধ্যে একজন, যিনি সান্ধ্যকালীন আকাশ দেখেই সময় গণনার যন্ত্র উদ্ভাবনে গবেষণা শুরু করেছিলেন।
ফারনাস বিষয়ক আলোচনা কেবল গবেষকদের মনোযোগেই সীমাবদ্ধ নয়। তেজগাঁও কলেজের এক শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদ জানান, “আমি প্রথমবার ফারনাসের কথা শুনি ইউটিলিটি ডিজাইনের ক্লাসে। শুনে অবাক হয়েছিলাম যে আমাদের গর্বের ঐতিহ্যে এইরকম এক বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ ছিলেন। এর পর থেকেই আমি ওঁকে নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি।” শুধু শিক্ষার্থী নয়, সাধারণ পাঠকরাও তাঁর সম্পর্কে আরও জানতে আগ্রহী।
এই কিংবদন্তির গল্প শুধু অতীত নয়; বতর্মান ও ভবিষ্যতের জন্যও এটি গুরুত্বপূর্ণ এক অনুপ্রেরণা। বিমানশিল্পে আজ যে বিপুল উন্নতি ঘটেছে, তার শেকড় খুঁজতে গেলেই পাওয়া যায় ফারনাসের মতো প্রাচীন উদ্ভাবকদের। এগুলোর নিট ফল হলো মানুষের শিখরে আরোহনের অদম্য চেষ্টা—যা কখনোই থেমে থাকে না। ইতিহাস যেমন পথ দেখায়, বর্তমানে সেই স্বপ্নকে সম্ভব করতে সভ্যতাও এগিয়ে চলেছে। সেই স্বপ্ন কীভাবে বাস্তবে রূপ নিচ্ছে, তারই প্রমাণ আজকের আধুনিক এয়ারক্রাফ্ট, স্পেস ক্রাফ্ট, এমনকি মহাকাশযান।
অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত দিক থেকেও আব্বাস ফারনাসের অবদান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মধ্যযুগীয় ইউরোপের মুসলিম প্রভাবশালী শহরগুলোয় বৈজ্ঞানিক ভাবনা বিকাশে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। ভ্রমণকারীরা তাঁদের রোজনামচায় ফারনাসের উদ্ভাবনী কর্মকাণ্ডের কথা উল্লেখ করেছেন, যা তাঁকে সমসাময়িক জ্ঞানচর্চার প্রধান প্রবক্তাদের কাতারে নিয়ে যায়।
আজকের আধুনিক যুগে এসে আব্বাস ফারনাসকে শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ের গর্ব হিসেবে নয়, বরং এক বৈশ্বিক সম্পদ হিসেবেও চিহ্নিত করা উচিত। প্রখ্যাত বিজ্ঞান-লেখিকা সাফিয়া হোসেনের ভাষ্য, “ফারনাসের আদর্শ আমাদের শিখিয়ে দেয়, জ্ঞান ও সাহসের মিশেলে বড় কিছু করা সম্ভব। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে এই ইতিহাস জানতে হবে।”
কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া অনেক ঘটনাই আজ নতুন করে আলোচনায় আসছে, ফারনাসের কীর্তিও তার ব্যতিক্রম নয়। তাঁর গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয় স্বপ্ন ও সংকল্পের শক্তি কতটা। ঠিক যেভাবে ছোট্ট মায়মূন আজ তার মহাকাশচুম্বী স্বপ্নের বীজ বপন করছে, আব্বাস ফারনাসও তাঁর সময়ে জ্ঞানপিপাসার আলো জ্বালাতে চেয়েছিলেন। বিশ্বজোড়া বিস্ময়ের সংগ্রহে এই কিংবদন্তির নাম আলোকিত হয়ে থাকবে চিরকাল।
Leave a comment