নিউজ ডেস্ক, বিজ্ঞানী অর্গ | biggani.org
আজকের দিনটি জেনেটিক বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। ২০১২ সালের ২৮ জুন, ড. জেনিফার ডাউডনা (Jennifer Doudna) এবং ড. ইমানুয়েল শারপেনটিয়ার (Emmanuelle Charpentier) বিজ্ঞান পত্রিকায় একটি গবেষণা প্রকাশ করেন, যেখানে তারা এক নতুন পদ্ধতির বর্ণনা দেন—CRISPR/Cas9 নামক এক অত্যন্ত নিখুঁত জিন সম্পাদনা প্রযুক্তি। এই আবিষ্কার বৈজ্ঞানিক সমাজে এক বিপ্লব ঘটিয়েছিল। এই গবেষণার ফলস্বরূপ, ২০২০ সালে তাঁরা নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন রসায়ন শাখায়।
আজ, সেই ঐতিহাসিক গবেষণার এক দশক পার হয়েছে। এই সময়ে CRISPR শুধু পরীক্ষাগারেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, এটি হয়ে উঠেছে চিকিৎসা, কৃষি, এবং মৌলিক গবেষণার এক অপরিহার্য অংশ।
CRISPR: শব্দের অর্থ এবং উৎপত্তি
CRISPR (Clustered Regularly Interspaced Short Palindromic Repeats) মূলত একধরনের জিনগত কাঠামো যা ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএ-তে পাওয়া যায়। এই গঠনের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে—একটি প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। Cas9 (CRISPR-associated protein 9) হলো একটি এনজাইম যা ডিএনএ-র নির্দিষ্ট অংশ কেটে ফেলতে পারে।
২০১২ সালের গবেষণায়, ডাউডনা ও শারপেনটিয়ার দেখান কীভাবে এই প্রাকৃতিক ব্যবস্থাকে মানুষের জিন এডিটিংয়ে ব্যবহার করা যায়, এক ধরনের ‘জিনিয়তিক কাঁচি’ হিসেবে। তাদের কাজের মূল শক্তি ছিল ডিএনএ-র নির্দিষ্ট অংশ শনাক্ত করে তা কেটে পরিবর্তন আনার দক্ষতা।
কীভাবে কাজ করে এই “জিন কাঁচি”?
CRISPR প্রযুক্তিতে দুটি মূল উপাদান থাকে:
- Guide RNA (gRNA) – এটি লক্ষ্য ডিএনএ অংশ চিনে ফেলে।
- Cas9 এনজাইম – এটি সেই নির্দিষ্ট অংশ কেটে ফেলে।
উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো একটি অসুস্থতা কোনো নির্দিষ্ট জিনের কারণে হয়ে থাকে, তাহলে গবেষকেরা সেই জিনটি চিহ্নিত করে গাইড আরএনএ তৈরি করেন। Cas9 সেই নির্দেশনা অনুযায়ী ডিএনএ কাটে, এবং তারপর ডিএনএ নিজে থেকেই তা মেরামত করে অথবা গবেষকেরা নতুন তথ্য প্রবেশ করিয়ে দেন।
এই পুরো প্রক্রিয়া আগের জিন সম্পাদনা প্রযুক্তিগুলোর তুলনায় সহজ, সাশ্রয়ী এবং অনেক বেশি নিখুঁত।
চিকিৎসাক্ষেত্রে বিপ্লব
CRISPR-এর সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ ব্যবহার হয়েছে মানব চিকিৎসাক্ষেত্রে। এখন গবেষণার মাধ্যমে অনেক জেনেটিক রোগের চিকিৎসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, যেমন:
- সিকেল সেল অ্যানিমিয়া: একধরনের রক্তরোগ যা মূলত জিনগত কারণে হয়। ইতোমধ্যে কিছু রোগীর উপর এই প্রযুক্তি প্রয়োগ করে সফলতা দেখা গেছে।
- হান্টিংটন ডিজিজ, কর্নিয়ার অন্ধত্ব, এবং ডিউচেন মুসকুলার ডিসট্রোফিসহ অন্যান্য বিরল রোগের চিকিৎসায়ও CRISPR কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
এছাড়া, ক্যানসার চিকিৎসাতেও এই প্রযুক্তি সম্ভাবনার দিগন্ত খুলে দিয়েছে, যেখানে রোগীর ইমিউন সেলগুলোকে জিন সম্পাদনার মাধ্যমে এমনভাবে প্রস্তুত করা যায়, যাতে তারা ক্যানসার কোষকে আরও ভালোভাবে চিনতে ও ধ্বংস করতে পারে।
কৃষিতে ক্রান্তিকাল
CRISPR শুধু চিকিৎসাতেই নয়, কৃষিক্ষেত্রেও বিপ্লব ঘটিয়েছে। উদ্ভিদের জিন সম্পাদনার মাধ্যমে—
- শস্যকে কীটনাশক বা খরা সহনশীল করা যায়,
- পুষ্টিমান বৃদ্ধি করা যায়,
- সংরক্ষণক্ষমতা বাড়ানো যায়।
যেমন, CRISPR ব্যবহার করে চীনে চালের একটি জাত তৈরি করা হয়েছে যা কম নাইট্রোজেন সারে বেশি ফলন দেয়। এমনকি টমেটো, গম, ভুট্টা প্রভৃতি ফল ও শস্যে এই প্রযুক্তি প্রয়োগ করা হচ্ছে।
নৈতিকতা ও বিতর্ক
CRISPR প্রযুক্তি যতই সম্ভাবনাময় হোক না কেন, এটি নিয়ে অনেক বিতর্কও রয়েছে—বিশেষ করে মানব ভ্রূণের জিন সম্পাদনা নিয়ে। ২০১৮ সালে চীনা বিজ্ঞানী হি জিয়ানকুই মানব ভ্রূণের উপর CRISPR ব্যবহার করে যমজ শিশু জন্ম দেন, যা বিশ্বজুড়ে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। বিজ্ঞানীদের একটি বড় অংশ মনে করেন, মানব জীবনের ভবিষ্যৎ পরিবর্তন করার মতো এমন শক্তিশালী প্রযুক্তি ব্যবহারে কঠোর নিয়ম-কানুন থাকা উচিত।
বর্তমানে CRISPR ব্যবহারে আন্তর্জাতিক নীতিমালার জন্য নীতিনির্ধারক এবং বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন।
বাংলাদেশে CRISPR-এর সম্ভাবনা
বাংলাদেশে এই প্রযুক্তির ব্যবহার এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। তবে কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো, যেমন বিএআরআই (বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট) এবং বিআইডিএস সেন্টারসমূহ জিন প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছে। ভবিষ্যতে CRISPR-এর মতো উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন সহনশীল ফসল উৎপাদন সম্ভব হতে পারে।
চিকিৎসাক্ষেত্রেও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশে বিরল রোগের জিনোমিক গবেষণা বা চিকিৎসার ক্ষেত্রে দিক পরিবর্তন করা সম্ভব।
নোবেল পুরস্কার এবং সম্মান
২০১২ সালের সেই গবেষণাপত্র প্রকাশের পর থেকে বৈজ্ঞানিক সমাজে CRISPR নিয়ে বিস্ময় ও আশার আলোড়ন সৃষ্টি হয়। অবশেষে, ২০২০ সালে সুইডিশ রয়্যাল অ্যাকাডেমি ড. জেনিফার ডাউডনা এবং ড. ইমানুয়েল শারপেনটিয়ারকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করে “জিনোম সম্পাদনার পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য”।
এটি ছিল রসায়ন শাখায় প্রথমবারের মতো দুজন নারী বিজ্ঞানীর একসাথে পুরস্কার পাওয়ার ঘটনা—যা বিজ্ঞান ও নারীর ক্ষমতায়নের এক অনন্য নজির।
ভবিষ্যতের দিগন্ত
আগামী দিনগুলোতে CRISPR প্রযুক্তির আরও উন্নত সংস্করণ আসছে, যেমন:
- Base Editing: যেখানে জিন কাটা না করেই ডিএনএ-র নির্দিষ্ট বেস পরিবর্তন করা যায়।
- Prime Editing: যা জিনোমের আরও জটিল পরিবর্তন করতে পারে আরও নিখুঁতভাবে।
এছাড়া, CRISPR-কে ডায়াগনস্টিক টুল হিসেবে ব্যবহারেরও প্রচেষ্টা চলছে, যেমন সংক্রমণ রোগ সনাক্তকরণে এটি ব্যবহার করা হচ্ছে। করোনা মহামারির সময়ে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে দ্রুত টেস্ট কিট তৈরি করা হয়েছে।
উপসংহার
CRISPR প্রযুক্তি প্রমাণ করে যে বিজ্ঞান কীভাবে মানবজাতির সীমা ভেঙে নতুন সম্ভাবনার পথ খুলে দিতে পারে। চিকিৎসা থেকে কৃষি, গবেষণা থেকে প্রযুক্তি—সর্বত্র এর প্রভাব অনুভব করা যাচ্ছে। তবে এই শক্তিশালী প্রযুক্তির যথাযথ এবং নৈতিক ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা, গবেষণা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা।
২০১২ সালের সেই গবেষণা শুধু একটি কাগজে লেখা ছিল না, সেটি ছিল ভবিষ্যতের দরজা খোলার চাবি।
আজ CRISPR-এর জন্মদিনে, আমরা শ্রদ্ধা জানাই সেইসব বিজ্ঞানী ও গবেষকদের, যারা আমাদের ভবিষ্যৎকে আরও স্বাস্থ্যবান, খাদ্যনিরাপদ ও প্রযুক্তিনির্ভর করতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।
📌 তথ্যসূত্র:
Doudna, J.A., & Charpentier, E. (2012). A programmable dual-RNA-guided DNA endonuclease in adaptive bacterial immunity. Science
📌 লেখা ও সম্পাদনা:
নিউজ ডেস্ক, বিজ্ঞানী অর্গ
✉️ যোগাযোগ: biggani.org
Leave a comment