কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাপরিবেশ ও পৃথিবী

এআই ডিজাইন করা এনজাইম: প্লাস্টিক ধ্বংসের নতুন বিপ্লব!

Share
Share

একটি বোতল, এক হাজার বছর…

হাতের প্লাস্টিকের বোতলটি আপনি ফেলে দিলেন ডাস্টবিনে। তারপর?

সাধারণত এই বোতলটি ধীরে ধীরে মাটির নিচে বা কোনো সমুদ্রের ঢেউয়ে হারিয়ে যাবে। কিন্তু সত্যিকারের হারিয়ে যাবে কি? উত্তর হলো: না। বিজ্ঞানীদের মতে, প্লাস্টিকের সম্পূর্ণ ক্ষয় হতে এক হাজার বছর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। একদিকে, এই প্লাস্টিক আমাদের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছে, অন্যদিকে এটি খাদ্যশৃঙ্খল হয়ে ফিরে আসছে আমাদের খাবারের টেবিলে, মাইক্রোপ্লাস্টিক হয়ে প্রবেশ করছে আমাদের শরীরে।

বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর প্রায় ৩৮০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপাদিত হয়, যার ৯০%-ই পুনর্ব্যবহারযোগ্য নয়। প্রতি মিনিটে ১০ লাখ প্লাস্টিকের বোতল কেনা হয়, যার বেশিরভাগই রিসাইকেল হয় না।

কিন্তু যদি এমন কোনো উপায় থাকতো, যা প্লাস্টিককে দ্রুত ভেঙে ফেলতে পারতো?

এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে গবেষণা করছে Epoch Biodesign—একটি লন্ডন-ভিত্তিক স্টার্টআপ, যারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) সাহায্যে এমন এনজাইম তৈরি করেছে, যা প্লাস্টিক ভাঙতে পারে ২৫ গুণ দ্রুত!

প্রকৃতির গতি বাড়ানোর চেষ্টা

প্লাস্টিক-খেকো এনজাইমের ধারণা নতুন কিছু নয়। বিজ্ঞানীরা আগেও এমন এনজাইম খুঁজে পেয়েছেন, যা প্লাস্টিক ভাঙতে পারে। তবে সমস্যা একটাই—গতি।

“আমরা জানি যে কিছু এনজাইম প্লাস্টিক ভাঙতে পারে, কিন্তু তা এত ধীরে যে এটি শিল্পে ব্যবহার করা সম্ভব নয়,” বলছিলেন এক পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. অ্যাডাম ফোস্টার।

Epoch Biodesign এই সমস্যা সমাধানে এআইকে কাজে লাগিয়েছে। তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ এনজাইমের ভিন্ন সংস্করণ তৈরি করে পরীক্ষা করেছে, এবং শেষ পর্যন্ত এমন এনজাইম ডিজাইন করতে পেরেছে যা প্লাস্টিক ২৫ গুণ দ্রুত ভাঙতে সক্ষম।

“এআই এখানে প্রকৃতির সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করেছে। সাধারণ বিবর্তন যেখানে কয়েক মিলিয়ন বছর নিতো, এআই সেটি কয়েক মাসের মধ্যেই করে ফেলতে পারছে,” বলেন Epoch Biodesign-এর প্রতিষ্ঠাতা জেকব নাথান

এনজাইমটি প্লাস্টিকের পলিমারকে ছোট ছোট অংশে বিভক্ত করে, যা মাইক্রোঅর্গানিজম সহজে হজম করতে পারে। এর ফলে প্লাস্টিকের ক্ষয় প্রক্রিয়া কয়েকশ গুণ ত্বরান্বিত হয়।

কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?

বছরের পর বছর ধরে প্লাস্টিক রিসাইক্লিং একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ ছিল। এটি ব্যয়বহুল, সময়সাপেক্ষ এবং জ্বালানি-নির্ভর। তাছাড়া, বেশিরভাগ প্লাস্টিক পুনরায় ব্যবহার করা হয় না কারণ এটি যথেষ্ট কার্যকর প্রক্রিয়া নয়।

এই নতুন এআই-ডিজাইন করা এনজাইম পরিবেশবান্ধব ও স্বল্প ব্যয়ে প্লাস্টিক রিসাইক্লিংয়ের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। সাধারণত প্লাস্টিক রিসাইক্লিংয়ে উচ্চ তাপমাত্রার প্রক্রিয়া ব্যবহার করা হয়, যা প্রচুর জ্বালানি খরচ করে। কিন্তু এনজাইম ভিত্তিক প্রক্রিয়া এই খরচ কমিয়ে আনতে পারে, যার ফলে পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাবও কমবে।

ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি ও Epoch-এর বড় চুক্তি

প্লাস্টিক দূষণের অন্যতম বড় উৎস হলো ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি। আমাদের পরিধেয় পোশাকের বেশিরভাগই পলিয়েস্টার ও নাইলন দিয়ে তৈরি, যা মূলত প্লাস্টিক থেকেই আসে। যখন আমরা কাপড় ধুই, তখন ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা পানিতে মিশে যায় এবং সমুদ্রে গিয়ে জমা হয়।

এই সমস্যার সমাধান করতে Zara-এর মূল প্রতিষ্ঠান Inditex সম্প্রতি Epoch Biodesign-এর সঙ্গে একটি বহু-বছরের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। তাদের লক্ষ্য পুরোনো কাপড়কে নতুন কাপড়ে পরিণত করা—একটি সত্যিকারের সার্কুলার ইকোনমি তৈরির প্রথম পদক্ষেপ।

“এটি শুধু পরিবেশ সংরক্ষণ নয়, বরং শিল্পের দৃষ্টিভঙ্গিরই পরিবর্তন আনবে,” বলেন Inditex-এর একজন মুখপাত্র।

বিশ্বজুড়ে প্রতিযোগিতা ও গবেষণা

Epoch Biodesign ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্লাস্টিক ধ্বংসের সমাধান খুঁজছে। জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে প্লাস্টিক-ভক্ষণকারী ব্যাকটেরিয়া নিয়ে গবেষণা করছে। তবে Epoch Biodesign-এর এআই-ডিজাইন করা এনজাইম এ পর্যন্ত দ্রুততম সমাধান বলে বিবেচিত হচ্ছে।

বাংলাদেশের সম্ভাবনা

বাংলাদেশে প্লাস্টিক দূষণের সমস্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় ৬,০০০ টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ প্লাস্টিক। যদি এনজাইম-ভিত্তিক এই প্রযুক্তি দেশে আসতে পারে, তবে এটি পরিবেশের ওপর একটি বিশাল ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) একজন সদস্য বলেন, “এটি আশাব্যঞ্জক খবর। তবে আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপটে এই প্রযুক্তি কবে নাগাদ আসবে, সেটিই দেখার বিষয়।”

এনজাইম ভিত্তিক প্লাস্টিক রিসাইক্লিং প্রযুক্তি যদি শিল্পে সফলভাবে প্রয়োগ করা যায়, তবে এটি হতে পারে প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।

শেষ কথা

একটি স্কুলের বিজ্ঞান প্রকল্প থেকে শুরু হওয়া এই উদ্যোগ আজ বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক সমস্যার সমাধান দিতে চলেছে। Epoch Biodesign-এর এই গবেষণা যদি সফলভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তবে প্লাস্টিক হয়তো একদিন ইতিহাস হয়ে যাবে।

আপনি কি ভাবছেন? প্লাস্টিক দূষণ রোধে এই নতুন প্রযুক্তি কি সত্যিই কার্যকর হবে? মতামত জানান আমাদের ফেসবুক পেজে!

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক | বিজ্ঞানী.অর্গ

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিজ্ঞান বিষয়ক খবর

মানুষের চিন্তার গতি: মস্তিষ্কের রহস্য উন্মোচন

মানুষের চিন্তার লুকানো গতি আবিষ্কার করুন—প্রতি সেকেন্ডে মাত্র ১০ বিট! মস্তিষ্কের প্রক্রিয়াকরণ...

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাতথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক খবর

শুধু প্রযুক্তি নয়, এখন অপরাধেও AI: ইউরোপোলের সতর্কবার্তা

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন সাইবার অপরাধীদের জন্য একটি হাতিয়ার। ইউরোপোল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-চালিত স্ক্যাম,...

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাতথ্যপ্রযুক্তি

গুগল নয়, এবার ব্র্যান্ডগুলো লড়ছে চ্যাটজিপিটির মন জয় করতে

বাংলাদেশের ব্র্যান্ডগুলি কীভাবে ChatGPT-এর মতো AI টুলের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য তাদের...

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচিকিৎসা বিদ্যা

ক্যান্সার চিকিৎসায় বিপ্লব আনতে পারে Ataraxis AI

আবিষ্কার করুন কিভাবে Ataraxis AI যুগান্তকারী AI প্রযুক্তির সাহায্যে স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসায়...

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাতথ্যপ্রযুক্তি

এজেন্টদের আলাপচারিতা: এক ভবিষ্যতের গল্প

গুগলের এজেন্ট২এজেন্ট প্রোটোকল কীভাবে এআই যোগাযোগে বিপ্লব আনছে তা আবিষ্কার করুন। স্মার্ট...

Three Columns Layout

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact

biggani.org❤️gmail.com

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

যোগাযোগ:

biggani.org@জিমেইল.com

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.