নতুন মার্কেটিংয়ের যুদ্ধক্ষেত্রে এআইই সিদ্ধান্ত নেয় আপনি কী কিনবেন
একটি বিকেলের গল্প দিয়ে শুরু করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অরিজিৎ, সদ্য বেতন পেয়ে ঠিক করলেন একটি নতুন ল্যাপটপ কিনবেন। আগে হলে হয়তো গুগলে গিয়ে লিখতেন, “সেরা ল্যাপটপ ১,০০০ ডলারের নিচে।” কিন্তু এবার তিনি যা করলেন, তা একটু আলাদা—তিনি চ্যাটজিপিটিতে জিজ্ঞেস করলেন, “১,০০০ ডলারের নিচে ভালো কোন ল্যাপটপ আছে?”
সেকেন্ডের মধ্যেই পরামর্শ এসে গেল—RAM, প্রসেসর, ব্যাটারি লাইফ আর ব্র্যান্ড রেপুটেশন বিবেচনায় কিছু নির্দিষ্ট মডেলের নাম। আর অরিজিৎ? তিনি সেই পরামর্শ অনুযায়ী একটিই কিনলেন, কোন ওয়েবসাইট ঘাঁটাঘাঁটি, ইউটিউব ভিডিও দেখা বা ব্লগ পড়া ছাড়াই।
“আমি ভাবলাম, এত রিভিউ পড়ে কী লাভ? চ্যাটজিপিটি তো সব জেনে গিয়েছে,” বলেন অরিজিৎ হাসতে হাসতে।
এই দৃশ্যপট শুধু অরিজিৎ নয়, বদলে দিচ্ছে বিশ্বব্যাপী বিপণন কৌশল ও গ্রাহক আচরণের সংজ্ঞা।
বাজারের নতুন যুদ্ধক্ষেত্র: মানুষের মন নয়, এআই-এর মন
এখন ব্র্যান্ডগুলো আর শুধু আমাদের মত মানুষকে নয়, চ্যাটজিপিটি, আলেক্সা কিংবা গেমিনির মত এআই মডেলগুলোকে নিয়েও ভাবছে। MIT Technology Review-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে স্কট জে মুলিগান লিখেছেন, “বিপণনের কেন্দ্রবিন্দু এখন ‘শেয়ার অব মডেল’ – অর্থাৎ একটি ব্র্যান্ড কতোটা দৃশ্যমান এবং পজিটিভভাবে উপস্থিত থাকে বড় ভাষা মডেলগুলোর কাছে।”
ডেটা বিশ্লেষকদের মতে, কনটেন্টের গুণমান, প্রডাক্ট ডিসক্রিপশনের স্বচ্ছতা এবং ব্র্যান্ড মেসেজিংয়ের ধারাবাহিকতা—এইসবই নির্ধারণ করছে কোন প্রডাক্ট বা ব্র্যান্ড AI সুপারিশ করবে।
“আগে ছিল গুগল র্যাঙ্কিং, এখন হল চ্যাটবট ফেভারিট,” বলেন মার্কেটিং কনসালটেন্ট তানভীর আহমেদ। “যে ব্র্যান্ডটি এআই-এর মন বুঝে গুছিয়ে উপস্থাপন করতে পারবে, সেটিই গ্রাহকের স্ক্রিনে আগে আসবে।”
ঢাকার জনপ্রিয় স্কিনকেয়ার ব্র্যান্ড ‘GlowBD’ এখন তাদের প্রতিটি প্রডাক্টের বিবরণ AI অনুযায়ী সাজিয়ে দিচ্ছে—যাতে চ্যাটবট সুপারিশে তাদের নাম উঠে আসে।
SEO-র নতুন নাম: LLM Optimization
SEO বা সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন বহুদিন ধরেই ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মেরুদণ্ড। কিন্তু এখন তার জায়গা নিচ্ছে LLMO—Large Language Model Optimization। (LLM মানে হলো Large Language Model, যেমন চ্যাটজিপিটি, যেগুলো অসংখ্য তথ্য পড়ে সিদ্ধান্ত নেয় কোন প্রডাক্ট ভালো)। যেখানে লক্ষ্য শুধু সার্চ ইঞ্জিনে র্যাঙ্ক করা নয়, বরং চ্যাটজিপিটির মত AI-এর চিন্তাপদ্ধতি বোঝা এবং সেই অনুযায়ী ব্র্যান্ডকে উপস্থাপন করা।
গবেষণা বলছে, AI যখন কোন প্রশ্নের উত্তর দেয়, তখন সে হাজারো অনলাইন কনটেন্ট স্ক্যান করে, বিভিন্ন সূত্রের গড় মূল্যায়ন করে এবং যে তথ্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য, প্রাসঙ্গিক ও সুষ্পষ্ট, সেটাকেই তুলে ধরে।
এখানেই চ্যালেঞ্জ: ব্র্যান্ডকে এমনভাবে অনলাইনে উপস্থাপন করতে হবে যেন AI বুঝতে পারে সেটা আসলে কোন ক্যাটাগরির প্রডাক্ট, কী বৈশিষ্ট্য তার আছে, এবং কেন সেটা গ্রাহকের জন্য উপযুক্ত হতে পারে।

মানুষ বনাম মেশিন: কাকে সন্তুষ্ট করবো আগে?
এটি শুধুই একটি প্রযুক্তিগত পরিবর্তন নয়, এটি একটি মনস্তাত্ত্বিকও। এক সময় কাস্টমার রিভিউ, ব্লগ বা ইউটিউবারদের মতামত নির্ধারণ করত আমরা কী কিনবো। এখন সেই ভূমিকায় আসছে এআই।
ঢাকার এক অনলাইন ব্যবসায়ী রুমানা খান বলেন, “আমরা এখন প্রডাক্ট ডিসক্রিপশন লেখার সময় ভাবি—একজন মানুষ না, বরং চ্যাটজিপিটি যেন সেটি পড়ে, বুঝতে পারে এবং অন্যদের জানায়।”
এই পরিবর্তনের গুরুত্ব অনুধাবন করে অনেক ব্র্যান্ড এখন নিজস্ব AI ফ্রেন্ডলি কনটেন্ট ডেভেলপমেন্ট টিম গঠন করছে। কিছু কোম্পানি এমনকি এআই-কে ‘টেস্ট ইউজার’ হিসেবে ব্যবহার করে দেখছে তাদের কনটেন্ট AI ঠিকভাবে ধরছে কি না।
“বাংলাদেশে এআই-কে গুরুত্ব না দিলে ভবিষ্যতের গ্রাহক হারানো অনিবার্য,” বলেন ডিজিটাল মার্কেটিং প্রশিক্ষক হাসান ইমাম।
ভবিষ্যতের বাজার: মানুষের মর্জি নয়, মডেলের মতামত
বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী দিনে ‘শেয়ার অব মডেল’ এমন এক গুরুত্বপূর্ণ মেট্রিক হয়ে উঠবে, যেটি মার্কেট শেয়ারের থেকেও শক্তিশালী হতে পারে।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ইলন মাস্ক একবার বলেছিলেন, “AI is the most powerful tool humanity has created. But like all tools, its influence depends on who’s wielding it.”
আজ সেই ‘wielding’ কেউ করছে চ্যাটজিপিটি, কেউ করছে গুগলের বার্ড, কেউ করছে মেটার LLaMA।
শেষ কথা: প্রস্তুতি নিন, প্রতিযোগী এখন আর মানুষ নয়
ব্র্যান্ডগুলোর সামনে এখন নতুন চ্যালেঞ্জ—তাদের প্রডাক্ট শুধু ভালো হলেই চলবে না, তা এআই-এর চোখে ‘বিশ্বাসযোগ্য’, ‘সম্পূর্ণ’ ও ‘প্রাসঙ্গিক’ হতে হবে।
এই লড়াইয়ে যে ব্র্যান্ডগুলো প্রথমে টের পাবে পরিবর্তনের ঢেউ, তারাই তৈরি হবে আগামী দিনের ‘AI-প্রিয় ব্র্যান্ড’ হয়ে উঠতে।
তাই হয়তো আজ অরিজিতের কেনা ল্যাপটপ একদিন ঠিক এই কারণে জনপ্রিয় হবে—কারণ চ্যাটজিপিটি তাকে ভালোবেসে বলেছিল, “এইটা কিনো।”
Leave a comment