গবেষণায় হাতে খড়ি

কিভাবে একটা গবেষণা প্রজেক্ট প্রস্তাবনা লেখা হয়?

Share
Share

প্রফেসর- ড. মোহা: ইয়ামিন হোসেন

ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

একটি গবেষণা প্রজেক্ট প্রস্তাবনা (Research Project Proposal) হলো গবেষণা শুরু করার আগে প্রস্তাবিত পরিকল্পনা যেখানে আপনার গবেষণার বিষয়, উদ্দেশ্য, পদ্ধতি এবং তাৎপর্য বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়। এটি গবেষণার গুরুত্ব এবং পদ্ধতি বোঝানোর একটি মাধ্যম। নিচে প্রস্তাবনা লেখার ধাপ এবং মৎস্য সম্পদের উপর ভিত্তি করে উদাহরণসহ আলোচনা করা হলো:

১. শিরোনাম (Title):

প্রস্তাবনার শিরোনাম সংক্ষিপ্ত ও সুনির্দিষ্ট হওয়া উচিত। শিরোনাম থেকে গবেষণার মূল বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন।

উদাহরণ:

“বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ইলিশ মাছের সংরক্ষণে চ্যালেঞ্জ এবং টেকসই কৌশল”

২. সারসংক্ষেপ (Summary):

এটি প্রস্তাবনার একটি সংক্ষিপ্তসার যেখানে গবেষণার মূল বিষয়, উদ্দেশ্য, পদ্ধতি, এবং প্রত্যাশিত ফলাফল তুলে ধরা হয়। এটি ১৫০-২৫০ শব্দের মধ্যে হওয়া উচিত।

উদাহরণ:

এই গবেষণার মূল লক্ষ্য হলো বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ইলিশ মাছের জনসংখ্যার উপর অতিরিক্ত মাছ ধরার প্রভাব বিশ্লেষণ করা। গবেষণাটি মাছের প্রজনন, মাছ ধরার মৌসুমী নিষেধাজ্ঞা এবং সংরক্ষণ কৌশলগুলির কার্যকারিতা মূল্যায়ন করবে। প্রাপ্ত ফলাফল ইলিশ সংরক্ষণের টেকসই কৌশল উন্নয়নে সহায়তা করবে।

৩. পটভূমি (Background):

এখানে আপনার গবেষণার প্রেক্ষাপট এবং বিষয়টির গুরুত্ব বর্ণনা করবেন। আগের গবেষণার সংক্ষিপ্তসার এবং গবেষণার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরবেন।

উদাহরণ:

ইলিশ মাছ বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং খাদ্য নিরাপত্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ (মিয়া, ২০১৮)। তবে অতিরিক্ত মাছ ধরা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং নদীর দূষণের কারণে ইলিশের জনসংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। যদিও সরকার ইলিশ সংরক্ষণে কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে, তবুও আরও কার্যকর কৌশল প্রয়োজন। এই গবেষণার মাধ্যমে ইলিশের বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ করা এবং টেকসই সংরক্ষণ কৌশল প্রস্তাব করা হবে।

৪. সমস্যা বিবৃতি (Problem Statement):

এখানে গবেষণার মূল সমস্যা বা প্রশ্নটি উল্লেখ করবেন যা আপনি সমাধান করতে চান। সমস্যাটি পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা উচিত।

উদাহরণ:

পদ্মা ও মেঘনা নদীর ইলিশ মাছের প্রজনন মৌসুমে অতিরিক্ত মাছ ধরা এবং মাছের সংখ্যা ক্রমাগত হ্রাস পাওয়ার ফলে সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থান হুমকির মুখে পড়েছে। প্রয়োজনীয় নীতি এবং সংরক্ষণ কৌশল বাস্তবায়নে দুর্বলতা দেখা দিয়েছে, যা মাছের জনসংখ্যা পুনরুদ্ধারে ব্যর্থ হয়েছে।

৫. গবেষণার উদ্দেশ্য (Objectives):

গবেষণার প্রধান উদ্দেশ্যগুলো সংক্ষিপ্ত ও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করুন।

উদাহরণ:

১. ইলিশের বর্তমান জনসংখ্যা এবং বাস্তুসংস্থান মূল্যায়ন করা।

২. মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা এবং সংরক্ষণ প্রচেষ্টার কার্যকারিতা নির্ধারণ করা।

৩. স্থানীয় সম্প্রদায়ের মাধ্যমে ইলিশ সংরক্ষণের টেকসই কৌশল প্রস্তাব করা।

৬. গবেষণার গুরুত্ব (Significance of the Study):

এখানে বর্ণনা করবেন কেন এই গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ এবং এর ফলাফল কিভাবে মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের জন্য উপকারী হবে।

উদাহরণ:

গবেষণার ফলাফল ইলিশ সংরক্ষণে নীতি-নির্ধারকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করবে। এটি স্থানীয় সম্প্রদায়ের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ হবে, কারণ টেকসই মাছ ধরার কৌশল তাদের জীবিকা বজায় রাখতে সহায়তা করবে। তাছাড়া, এই গবেষণা ভবিষ্যতের পরিবেশগত সংরক্ষণ উদ্যোগে অবদান রাখবে।

৭. সাহিত্য পর্যালোচনা (Literature Review):

গবেষণা বিষয়ক পূর্ববর্তী গবেষণার উপর ভিত্তি করে এই অংশে মূল তথ্য এবং গবেষণার বর্তমান অবস্থা আলোচনা করা হবে। কী ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে এবং কী তথ্যের ঘাটতি রয়েছে তা উল্লেখ করুন।

উদাহরণ:

মিয়া এবং সহকর্মীরা (২০১৮) তাদের গবেষণায় ইলিশ মাছের জনসংখ্যার ওপর অতিরিক্ত মাছ ধরার প্রভাব দেখিয়েছেন। তবে, স্থানীয় সম্প্রদায়ের ভূমিকা এবং সরকারের নীতিগুলো নিয়ে খুব কম গবেষণা হয়েছে। এই গবেষণাটি সেই ঘাটতিগুলো পূরণ করতে চেষ্টা করবে।

৮. গবেষণার উপকরণ ও পদ্ধতি (Materials and Methods):

এই অংশে আপনি গবেষণার পদ্ধতি এবং কীভাবে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করবেন তা উল্লেখ করবেন। আপনার গবেষণার সাইট, নমুনা সংগ্রহ পদ্ধতি, ডেটা বিশ্লেষণ পদ্ধতি ইত্যাদি পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা উচিত।

উদাহরণ:

গবেষণা এলাকা: পদ্মা নদীর ইলিশ প্রজনন এলাকা।

নমুনা সংগ্রহ পদ্ধতি: জাল এবং ট্রলিং ব্যবহার করে ইলিশ মাছের সংখ্যা ও আকারের তথ্য সংগ্রহ করা হবে।

তথ্য সংগ্রহ পদ্ধতি: স্থানীয় মৎস্যজীবীদের সাথে সাক্ষাৎকার, মাছ ধরার ডেটা বিশ্লেষণ এবং নদীর পানি মান বিশ্লেষণ করা হবে।

তথ্য বিশ্লেষণ পদ্ধতি: ডেটা বিশ্লেষণে পরিসংখ্যানগত মডেল ব্যবহার করা হবে, যেমন SPSS বা R ব্যবহার করে মৎস্য জনসংখ্যার পরিবর্তন বিশ্লেষণ।

৯. সময়সূচি (Time Frame):

গবেষণার জন্য সময়সূচি নির্ধারণ করুন এবং গবেষণার প্রতিটি ধাপের জন্য সময় নির্দিষ্ট করুন।

উদাহরণ:

– মাস ১-২: সাহিত্য পর্যালোচনা এবং প্রস্তুতি।

-মাস ৩-৬: মাঠ পর্যবেক্ষণ এবং নমুনা সংগ্রহ।

– মাস ৭-৯: ডেটা বিশ্লেষণ।

– মাস ১০-১২: প্রতিবেদন প্রস্তুতি এবং সুপারিশ।

১০. প্রত্যাশিত ফলাফল (Expected Outcomes):

গবেষণার মাধ্যমে কী ধরনের ফলাফল পাওয়া যাবে এবং সেগুলো কীভাবে সমস্যার সমাধানে সহায়ক হবে তা উল্লেখ করুন।

উদাহরণ:

গবেষণার প্রত্যাশিত ফলাফল হলো ইলিশের জনসংখ্যার বর্তমান অবস্থা নির্ধারণ এবং সংরক্ষণ প্রচেষ্টাগুলোর উন্নয়ন করা। এর মাধ্যমে সরকার এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের জন্য কার্যকর নীতি সুপারিশ তৈরি করা হবে। এছাড়াও, গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য ভবিষ্যতের পরিবেশগত সংরক্ষণ পরিকল্পনায় সাহায্য করবে।

-১১. তথ্যসূত্র (References):

আপনার প্রস্তাবনায় ব্যবহৃত সব তথ্যসূত্রের একটি তালিকা প্রদান করুন এবং সঠিক রেফারেন্স স্টাইল অনুসরণ করুন (যেমন APA, MLA)।

উদাহরণ:

– মিয়া, এম. স., হোসেন, এ. ও রহমান, এম. (২০১৮)। বাংলাদেশে ইলিশ মাছ সংরক্ষণের চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ। মৎস্য বিজ্ঞান জার্নাল, ১২(৩), ১০০-১১২।

– রহমান, এ. (২০১৯)। ইলিশ মাছ এবং বাংলাদেশের অর্থনীতি। বাংলাদেশ পরিবেশ গবেষণা, ১১(২), ৩৪-৫০।

ইন-টেক্সট সাইটেশন (In-text Citation):

প্রস্তাবনায় যেখানে পূর্ববর্তী গবেষণা বা তথ্য ব্যবহার করবেন সেখানে ইন-টেক্সট সাইটেশন ব্যবহার করুন।

উদাহরণ:

ইলিশ মাছের জনসংখ্যা হ্রাস পেয়েছে অতিরিক্ত মাছ ধরার কারণে (মিয়া, ২০১৮)।

এই কাঠামো অনুসরণ করে আপনি একটি সুনির্দিষ্ট এবং গঠনমূলক গবেষণা প্রস্তাবনা তৈরি করতে পারবেন, যা গবেষণার উদ্দেশ্য, তাৎপর্য, পদ্ধতি এবং সম্ভাব্য ফলাফল পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করবে।

বিদ্র: ফেসবুক থেকে সংগ্রহীত:——–https://www.facebook.com/share/p/14qyb4zFWD/

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
গবেষণায় হাতে খড়ি

গবেষণার বিষয়ে কিছুই জানি না, কিভাবে শুরু করবো, কার কাছে যাবো, কিভাবে স্কলারশিপ পাবো?

প্রফেসর- ড. মোহা: ইয়ামিন হোসেন ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের গবেষণার...

গবেষণায় হাতে খড়ি

গবেষণার প্রস্তুতি ছাড়া বিদেশে উচ্চশিক্ষায় নয়!

প্রফেসর- ড. মোহা: ইয়ামিন হোসেন ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। গবেষণা না শিখে...

গবেষণায় হাতে খড়ি

উচ্চশিক্ষার জন্য স্কলারশিপ পেতে বাংলাদেশী ফেলো কিভাবে বিদেশী প্রফেসরকে ম্যানেজ করবেন?

প্রফেসর- ড. মোহা: ইয়ামিন হোসেন ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য...

গবেষণায় হাতে খড়ি

প্রাকটিকাল ক্লাস দিয়ে শুরু হোক গবেষণা ও পাবলিকেশন!

প্রফেসর- ড. মোহা: ইয়ামিন হোসেন ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। গবেষণা এবং পাবলিকেশন...

গবেষণায় হাতে খড়ি

দেশের টেকসই উন্নয়ন ও মানবকল্যাণ: জরুরি প্রয়োজন ও করণীয়!

লেখক: প্রফেসর ড মোহাঃ ইয়ামিন হোসেনফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের শিক্ষার মান...

Three Columns Layout

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact

biggani.org❤️gmail.com

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

যোগাযোগ:

biggani.org@জিমেইল.com

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.