বায়োটেকনলজি

উন্নয়নশীল দেশের প্রয়োজন ক্লোনিং প্রযুক্তি

Share
Share

মূল নিবন্ধ:  ক্যালটাস জুমা (Calestous Juma)
বিবিসি
র দ্য গ্রীন রুম
থেকে ভাষান্তর এনায়েতুর রহীম

উন্নয়নশীল
দেশে ক্লোনিং পরিবেশগত সুবিধা বয়ে আনতে পারে
বলেছেন অধ্যাপক ক্যালটাস জুমা। তিনি যুক্তি
দেখানে যে বায়োটেকনলজির মাধ্যমে কৃষি কাজে ব্যবহারযোগ্য দুর্লভ পশুর উৎপাদন করা
সম্ভব যেগুলি পরিবর্তিত পরিবেশে অধিকতর অভিযোজন করতে সক্ষম

 

গত পাঁচ বছর গবেষণার পর আমেরিকার খাদ্য ও
ঔষধ প্রশাসন
(Food and Drug Administration, FDA) ঘোষণা
দিয়েছে যে ক্লোনিং পদ্ধতিতে উৎপাদিত পশুর মাংস খাদ্য হিসেবে নিরাপদ। কিন্তু তার পরও
কিছু ভোক্তা সংগঠন এব্যাপারে পুরোপুরি সন্দেহ মুক্ত হতে পারেনি এবং তারা ক্লোনিংএর নীতিগত দিকগুলি পরীক্ষা করে দেখার দাবি জানিয়েছে।

যদিও তাদের দাবি সঙ্গত, কিন্তু এর সাথে
ক্লোনিংএর পরিবেশগত সুবিধার বিষয়টিও বিবেচনা করে দেখতে হবে, বিশেষত: উন্নয়নশীল
দেশের এর প্রভাবের কথা বিবেচনা করে।

উদাহরণস্বরুপ বলা যায়, জলবায়ুর পরিবর্তন পরিবেশের
উপর সম্ভাব্য যতখানি প্রভাব ফেলবে তারচে বেশী প্রভাব পড়বে উন্নয়নশীল দেশের
গবাদিপশুর উপর। বিশেষত: আফ্রিকার অনেক উন্নয়নশীল দেশ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

এই বিপর্যয় সামলানোর জন্য দরকার হবে
উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং তার জন্য প্রয়োজন অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগ। এসব
প্রযুক্তির মধ্যে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার ও সংরক্ষণের জন্য গবাদি পশুর ক্লোনিং
অন্যতম।

জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংগঠনের (Food and
Agricultural Organization, FAO) হিসাব অনুযায়ি
প্রায় ১৫০০ বা মোট গবাদিপশু প্রজাতির ৩০ভাগই আজ বিলুপ্তির হুমকির সম্মুখিন। এদের
অধিকাংশই উন্নয়নশীল দেশের। বর্তমানে এসবের ১শ
র ও কম প্রজাতি
সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

বাস্তুগত বিপর্যয় এই গতিকে ত্বরান্বিত
করবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। বিলুপ্তির গতি ধীর করার জন্য দরকার প্রজননের আধুনিক
কৌশল, যেমন, ক্লোনিং। এর ফলে যেসব গবাদি পশুর সংখ্যা আশংকাজনক ভাবে কমে গিয়েছে বা
বিলুপ্তির পথে তাদের সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে।

প্রজাতির সংরক্ষণের মাধ্যমে বাস্তুতন্ত্রের
এই বিপর্যয়ের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার ফলে ক্লোনিং অর্থনৈতিক স্থিতি নিশ্চিত করতে
পারে। উন্নত প্রজাতির গবাদি পশু থেকে অধিকতর দুধ, মাংস পাওয়া সম্ভব যা সাধারণ
মানের পশু থেকে পাওয়া সম্ভব নয়। এসবের ফলে সামগ্রিক পরিবেশের উপর ফলদায়ক (ধনাত্বক)
প্রভাব পড়বে।

গবেষকগণ ইতোমধ্যেই সংরক্ষণের (conservation) কাজে ক্লোনিং এর ব্যবহার শুরু করেছেন।  উদাহরনস্বরুপ, ২০০৪ সালে ভারতীয় বিজ্ঞানীরা ১
মিলিয়ন ডলারের (প্রায় ৭ কোটি টাকা) একটি গবেষণা প্রকল্প ঘোষণা করে। এ প্রকল্পের
আওতায় ক্লোনিং এর মাধ্যমে বিপন্নপ্রায় ভারতীয় সিংহ  সংরক্ষণ করা হবে। এই সিংহ বর্তমানে ৩শ
র ও কম আছে বলে অনুমান করা হয়। তেমনিভাবে অন্যান্য বিপন্ন
প্রাণি যেমন মাছ, সরিসৃপ, উভচর  প্রাণিদেরও
সংক্ষণ করা সম্ভব হবে। বিজ্ঞানীগণ আশাবাদি যে ক্লোনিংএর মাধ্যমে ভিয়েতনামের
বিলুপ্তপ্রায় সাওলা
(Pseudoryx nghetinhensis), গাউর (Bos javanicus) এবং
ওয়াইল্ড ওয়াটার বাফেলো
(Bubalus arnee) ইত্যাদি
প্রজাতি বাঁচানো সম্ভব।

ভোক্তা সংগঠনগুলো অবশ্য ক্লোনিং এর  নীতিগত দিক এবং ক্লোন করা পশুর মাংস খাদ্য
হিসেবে ব্যবহারের নিরাপত্তা নিয়ে তাদের সঙ্গত উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। উন্নয়নশীল
দেশের প্রেক্ষাপটে এসব দাবির প্রয়োজনীয়তা এবং বিজ্ঞানসম্মত প্রমান সাপেক্ষে তাদের
দাবিগুলো বিচার করা প্রয়োজন। 

ক্লোন করা পশুর মাংস খাদ্য হিসেবে নিরাপদ
কি না সেটির কথাই ধরা যাক। বিখ্যাত জার্নাল
Theriogenology তে ক্লোন
করা পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে এর পুষ্টি গুনাগুন বিচার করে কয়েক পর্বের প্রবন্ধ
প্রকাশ করেছে। দেখা যায়, জার্ণালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রের বক্তব্য এবং
FDA-প্রকাশিত তথ্যের মূল বক্তব্য একই। অর্থাৎ ক্লোন করা পশুর
মাংস খাবার হিসেবে মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর নয়। এছাড়া ফ্রান্সের জাতীয় কৃষি
গবেষণা প্রতিষ্ঠান গবেষণা করে জানতে পেরেছে ক্লোন করা পশুর মাংস ও দুধ আর স্বাভাবিক
পশুর মাংস ও দুধের মধ্যে গুনগত কোন পার্থক্য নেই। জাপানের কাগোশিমা গবাদিপশু
প্রজনন ইনস্টিটিউট এবং আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ কানেকটিকাট এক যৌথ গবেষণায় ক্লোন
করা পশুর মাংস আর স্বাভাবিক প্রজননের মাধ্যমে জন্মানো পশুর মাংসের মধ্যে কোন
পার্থক্য করতে পারেনি। তাই এটা বলা যায় ক্লোন করা পশুর মাংস খাদ্য হিসেবে নিরাপদ।

জাপানের ইনস্টিটিউট ফর এ্যনিম্যাল সাইন্স
ইন বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড টক্সোকোলজি ইদুরের উপর এক গবেষণা করেছে। এতে ইঁদুরকে ক্লোন
পশুর মাংস ও দুধ খাওয়ানো হয় এবং অপর কিছু ইঁদুরকে স্বাভাবিক পশুর মাংস ও দুধ
খাওয়ানো হয়। এর পর এসব ইঁদুরের মূত্র পরীক্ষা করা হয় কোন পার্থক্য আছে কি না তা
দেখার জন্য। পরীক্ষায় ইঁদুরগুলোর মধ্যে কোন পার্থক্য ধরা পড়েনি।

তবে এর বিপরীত চিত্রও আছে। আমেরিকান ও
ব্রাজিলিয়ান বিজ্ঞানীরা আর্জেন্টিনায় পরিচালিত এক গবেষণায় দেখেছেন ক্লোন করা পশুর
জীবনচক্রে স্বাস্থ্যগত কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে। কিন্তু ক্লোন পশুর স্বাস্থ্যগত
সমস্যা মানুষের উপর কোন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারেন কি-না এই গবেষণায় তা বলা হয়নি।

প্রাণিজগতের কল্যাণ ও এর উন্নয়ন সাধন
মানুষের প্রয়োজনেই গুরুত্বপূর্ণ। বৈজ্ঞানিক সমাজের উচিৎ প্রাণিবিদদের সাথে নিয়ে
তাদের গবেষণা কার্য পরিচালনা করা।

নীতিগত বিড়ম্বনা

উন্নয়নশীল দেশে ক্লোনিংএর প্রয়োজনীয়তার
পাশাপাশি সেসব দেশে এটা গ্রহনযোগ্য হবে কী না তার নীতিগত দিকটা আলোচ্য থেকেই
যাচ্ছে। ক্লোনিং স্বাভাবিক প্রজননের চাইতে অনেক বেশী ব্যয় সাপেক্ষ। এক একটি ক্লোন
করতে খরচ সর্বোচ্চ ২০ হাজার ডলার বা প্রায় ১৪ লক্ষ টাকা। যদিও ক্লোনিংএর ফলে
অর্থনৈতিক লাভের পরিমান এ প্রযু্ক্তি গ্রহণের খরচের চেয়ে অনেক বেশী, বিশ্বের অধিকাংশ
দেশের গরিব কৃষকরাই পশু ক্লোন করার খরচ বহন করতে পারবে না। এর প্রধান কারণ সেসব
দেশের প্রযুক্তিগত পশ্চাদপদতা এবং ক্লোন পদ্ধতি প্রয়োগ করার মত যোগ্য
প্রযুক্তিবিদের অভাব।

এই সমস্যার সমাধানের জন্য উন্নত দেশের
সাথে উন্নয়নশীল দেশের গবেষণা চুক্তি করা যেতে পারে। ফলে ক্লোন প্রযুক্তি উন্নয়নশীল
দেশে হস্তান্তর যেমন সহজ হবে তেমনি ক্লোন পশু খাদ্য হিসেবেও গ্রহনযোগ্যতা পাবে। উন্নত
প্রযুক্তি উন্নয়নশীল দেশে হস্তান্তের মাধ্যমে তারা একদিকে মান সম্পন্ন ডেইরী পণ্য
প্রস্তুত করার সুযোগ পাবে, অন্যদিকে বিপন্ন প্রজাতির সংরক্ষণেও ভূমিকা রাখবে।

মূল নিবন্ধ:
http://news.bbc.co.uk/2/hi/science/nature/6288941.stm

মূল লেখক: Calestous Juma is a professor of international
development at Harvard University’s Kennedy School of Government, and co-chairs
a high-level expert panel of the African Union
on modern biotechnology

গ্রীন রুম বিবিসির পরিবেশ বিষয়ক মতামত ভিত্তিক একটি ধারাবাহিক
প্রকাশনা। এতে বিবিসি

বিজ্ঞান ও পরিবেশ বিভাগে প্রতি সপ্তাহে একজন বিশেষজ্ঞের মতামত নিবন্ধ আকারে
প্রকাশিত হয়। বিশ্ব পরিবেশ ও এর সংরক্ষণ পরিকল্পনায় এসব নিবন্ধ অত্যন্ত গুরুত্ব
বহন করে। আর তাই সেখান থেকে বেছে বেছে কিছু নিবন্ধ বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য অনুবাদ
করে প্রকাশ করা হচ্ছে।

ভাষান্তরিত নিবন্ধ মানে এই নয়
যে এসব মতামত বাংলাদেশের জন্য উপকার বয়ে আনবে। বিশ্ব পরিবেশ সংরক্ষণ ও এর
ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে পৃথিবীর কে কোথায় কি ভাবছে তা আমাদের দেশের পাঠকের জন্য
সহজপাঠ্য করাই আমাদের এই আয়োজন। প্রকাশিত নিবন্ধগুলি আপনাদের মতামত বা সমালোচনার
জন্য উন্মুক্ত। এসব নিবন্ধের বিষয়বস্তু আমাদের দেশের জন্য মঙ্গল না অমঙ্গল বয়ে
আনবে সে বিষয়ে আপনার মতামত জানান।

Share

3 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
জেনেটিকসপরিবেশ ও পৃথিবীবায়োটেকনলজিসাক্ষাৎকার

প্রোফেসর ড. আবিদুর রহমান: উদ্ভিদ বিজ্ঞান এবং পরিবেশবান্ধব গবেষণার পথিকৃৎ

অধ্যাপক আবিদুর রহমান বর্তমানে জাপানের ইওয়াতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদে উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের...

জেনেটিকসবায়োটেকনলজিবিজ্ঞান বিষয়ক খবর

গ্রীনল্যান্ড শার্ক: দীর্ঘায়ু জীবনের রহস্য উন্মোচন

গ্রীনল্যান্ড শার্ক, যা বৈজ্ঞানিক নাম “Somniosus microcephalus” নামে পরিচিত, বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘজীবী...

বায়োটেকনলজি

বায়োটেকনেলোজি এবং ভবিষ্যৎ পৃথিবী

সিজানুররহমান বায়োটেকনোলোজিএন্ডজেনেটিকইঞ্জিনিয়ারিংবিভাগ ইসলামীবিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া। যদি হঠাৎকেউ আমাকে প্রশ্ন করে,’আচ্ছা বায়োটেকনোলোজি কি?’ তাহলে...

বায়োটেকনলজি

স্বপ্ন সঞ্চারী – ড. আবেদ চৌধুরী (♥♪♥)

{mosimage}   'এই স্মৃতি-ঝলমল সবুজ মাঠের কাছে আমার অনেক ঋণ আছে…।'  এই...

Three Columns Layout

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact

biggani.org❤️gmail.com

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

যোগাযোগ:

biggani.org@জিমেইল.com

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.