কৃষি

হাওড়াঞ্চলে আফালের ফলে ভূমিক্ষয় রোধ ও ভূমি পুনরুদ্ধার ~ ড. মো. আনোয়ার হোসেন

Share
হাওড়াঞ্চলে আফালের ফলে ভূমিক্ষয় রোধ ও ভূমি পুনরুদ্ধার
Share

হাওড়াঞ্চলে আফাল

সম্প্রতি হাওড়ে বিধ্বংসী বন্যার পর শুরু হয়েছে আফাল আফালের (কালবৈশাখী বা সাধারণ ঝড়) ফলে হাওড়ের পানিতে তাফালিং বা আফালিং (বড় বড় ঢেউ) সৃষ্টি হয়, যা গ্রামের ভিটেজমি ভেঙে নিয়ে যাচ্ছে সাধারণত প্রতি বছর এমনই হয়ে থাকে, যা অনেকটা মড়ার উপর খাড়ার ঘাঁ বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল  অর্থাৎ সাবেক বৃহত্তর ময়মনসিংহ সিলেট জেলার বিশাল এলাকায় বিশেষ এক স্বাদু পানির জলাশয় অবস্থিত, যা হাওড় নামে পরিচিত সম্প্রতি হাওড়াঞ্চলে ভ্রমণের সময় প্রত্যক্ষ করা গ্রামগুলোর ভূমিক্ষয় নদীভাঙনের শিকার হওয়া এবং তার প্রতিকার নিয়ে আমার বিশ্লেষণমূলক মতামত প্রকৌশলগত সমাধান

হাওড় বাংলাদেশের এক বিচিত্র অদ্বিতীয় জলাভূমি, যার মতো পরিবেশপ্রতিবেশ বাংলাদেশের আর কোথাও নেই, তাই হাওড় অনন্য। হাওড় যেমন স্বাদু পানির মাছের অফুরান উত্স, তেমনি ধান উৎপাদনের এক বিস্তীর্ণ শস্যভাণ্ডার। হাওড় শুধু দেয় না, নেয়ও। ভরা বর্ষা মৌসুমে হাওড়ের মূল জলাশয় ধানি জমি পানিতে ডুবে বিশাল এক ঢেউময় জলাধারের সৃষ্টি করে। এই বিশাল বিপুল জলরাশি যেমন কৃষিফসলকে ভাসিয়ে নেয়, তেমনি ঘরবাড়ি ভেঙে ভিটেমাটি ধুয়েমুছে সাফ করে দেয়। ফি বছর বানের পানিতে তাই হাওড়বাসীদের সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হতে হয়

হাওড়ের গ্রাম জনপদগুলো সাধারণত প্রাকৃতিকভাবে উঁচু ভূমিতে গড়ে উঠেছে। ভরা বর্ষা মৌসুমে যখন হাওড় কানায় কানায় ভরে থাকে, তখন গ্রামগুলোকে দেখে মনে হয় গাছ আর আগাছার একেকটি ভাসমান দ্বীপ। সময় গ্রাম তথা জনগণের ভিটেজমির মাটি ভাঙনের কবলে পড়ে ধুয়ে যায়। কোনো কোনো জায়গায় কৃষিজমিও ভূমিক্ষয়ের শিকার হয়। এই ভূমিক্ষয় রোধ করতে হলে ভাঙনের কারণ এবং কীভাবে ভাঙে, তার মেকানিজম বা পদ্ধতি বুঝতে হবে। তারপর সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলে হাওড়ের ভূমিক্ষয় বন্ধ করা সম্ভব হবে

হাওড়ের ভূমির ভাঙন সাধারণত দুটি শক্তির দ্বারা দুভাবে হয়ে থাকে। হাওড়ের ঢেউ স্রোত দুই শক্তি। কোথাও কোথাও দুটি শক্তির দ্বারা ভাঙন পরিপূরকভাবে ঘটে থাকে আবার কোথাও আলাদাভাবে ঘটে। হাওড়ের বিপুল জলরাশি প্রতিনিয়ত যে ঢেউয়ের সৃষ্টি করে, তা উঁচু ভূমি তথা গ্রামের ভিটাভূমিতে প্রতিনিয়ত আঘাত করতে থাকে। আঘাতের সময় মাটির ওপর তীব্র চাপ পড়ে। ফলে মাটি সংকুচিত হয় বা চেপে যায়। কিন্তু তাত্ক্ষণিকভাবে ঢেউ ফেরত গেলে চাপ শূন্য হয়ে যায়। নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুসরণ করে চেপে যাওয়া মাটি সমান বিপরীত প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে। বিপরীত দিকে সে সময় চাপ না থাকায় মাটি আলগা হয়ে যায়। বারবার একই প্রক্রিয়া চলতে থাকে এবং একসময় মাটি ভেঙে যায়। পরবর্তী ঢেউ মাটিতে আঘাত করার পর ফেরত যাওয়ার সময় ভাঙা মাটি ওয়াশ করে নিয়ে যায়। সে সময় বিদ্যমান স্রোত ঢেউয়ের দ্বারা ওয়াশ করা মাটি ধুয়েমুছে দূরে নিয়ে চলে যায়। হাওড়ে আফালের সময় প্রক্রিয়া খুব দ্রুত ঘটে

হাওড়ের পানি পরিবাহিত হওয়ার জন্য হাওড়াঞ্চলের মধ্যে অনেক নদী খাল রয়েছে। ভরা বর্ষা মৌসুমে এসব নদী খাল দিয়ে প্রচুর পানি পরিবাহিত হয়। ফলে তীব্র স্রোতের সৃষ্টি হয়। সময় নদী খালের পাড়ে অবস্থিত জমি গ্রামগুলোয় ভাঙনের সৃষ্টি হয়। তীব্র স্রোত যখন পাড়ের মাটির নিচের অংশে আঘাত করতে থাকে, তখন নরম মাটি ভেঙে গিয়ে স্রোতের সঙ্গে ধুয়ে চলে যায়। প্রক্রিয়া প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকলে পাড়ের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। পাড়ের বেজের মাটি স্রোতের দ্বারা ধুয়ে যাওয়ার ফলে মাটিরসাম্যতার কোণবাএঙ্গেল অব রিপোজপরিবর্তন হয়ে যায়। সময় মাটির প্যাসিভ আর্থ প্রেসার সাম্য বা ব্যালান্স হারিয়ে ফেলে এবং মাটি ভেঙে পড়ে। মোদ্দাকথা পাড়ের নিচের মাটি স্রোতে ভেঙে নিয়ে যাওয়ায় সাম্য হারিয়ে পাড় ভেঙে পড়ে। সে সময় পাড়ে অবস্থিত ঘরবাড়ি ভিটেমাটি ভাঙনের কবলে পড়ে বিলীন হয়ে যায়। প্রতি বছর হাওড়ে প্রক্রিয়া চলতে থাকে। আর বছরের পর বছর জনমানুষের দুর্ভোগ প্রবহমান থাকে

পাঠ্যপুস্তকে পড়া এবং বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রয়োগকৃত বিভিন্ন নদী বা পানি নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি আমরা অনেকেই দেখেছি বা জানি। যেমনবালির বস্তা ফেলা, বোল্টার ফেলা, কংক্রিট ব্লক দেয়া, তারের জালে পাথর ভরে ফেলা, ঢাল বা স্লোপ নিয়ন্ত্রণের জন্য স্লাব দেয়া, অধুনা ব্যয়বহুল জিওটেক্সটাইল ব্লক দেয়া ইত্যাদি। হাওড়াঞ্চলে ব্যবহারের জন্য আমি এসব কোনো পদ্ধতির পক্ষে নই। কারণ এসব পদ্ধতি স্থায়ী সমাধান দিতে পারে না। জরুরি মুহূর্তে এসব পদ্ধতি কাজ করলেও দীর্ঘমেয়াদি নয়। আমি হাওড়ে স্থায়ী দীর্ঘমেয়াদে কর্মক্ষম থাকবে এমন পদ্ধতির পক্ষে। কারণ যে পদ্ধতি প্রত্যেক বছর প্রয়োগ করতে হবে বা প্রতি বছর ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মেরামতের প্রয়োজন পড়বে, তা বারবার করার জন্য বাজেট পাওয়া নাও যেতে পারে। তাছাড়া হাওড়ের উন্নয়নের গুরুত্ব ভবিষ্যত্ প্রশাসনের কাছে কম হতে পারে। সেজন্য একবারই প্রয়োগ করা যায় এবং দীর্ঘদিন কর্মক্ষম থাকে, এমন পদ্ধতিই আমার পছন্দ

হাওড়ের ভূমিক্ষয় ভাঙন রোধে আমার পছন্দ রিটেইনিং ওয়াল। বাট্রেস বা ক্যান্টিলিভার কিংবা পাইলিং রিটেইনিং ওয়াল ব্যবহার করা উচিত। নদীর পাড়ে অবস্থিত গ্রামগুলোয় পাইলিং রিটেইনিং ওয়াল ব্যবহার করা যেতে পারে। অন্য গ্রামগুলোয় বাট্রেস বা ক্যান্টিলিভার রিটেইনিং ওয়াল ব্যবহার করা যুক্তিযুক্ত। কিন্তু কেন রিটেইনিং ওয়াল ব্যবহার করা উচিত হাওড়ের গ্রামের ভাঙনে? কারণ রিটেইনিং ওয়াল যেমন ভিটের মাটি ধরে রাখবে, তেমনি ওয়ালে বা দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ঢেউ ফেরত চলে যাবে। পাইলিং রিটেইনিং ওয়াল মাটির গভীরে অর্থাত্ নদীর স্কাওয়ারিং লেভেলের নিচে থাকায় স্রোত আর ভাঙতে পারবে না। ফলে ভাঙন প্রতিরোধ হয়ে গ্রাম থাকবে অক্ষত

রিটেইনিং ওয়াল তৈরি প্রয়োগ করার জন্য আমার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব নির্দেশনা আছে। প্রতিটি গ্রাম, আশপাশের পতিত জমিসহ পুরো এলাকা রিটেইনিং ওয়াল দিয়ে ঘিরে দেয়া। তারপর আশপাশের নদী থেকে সুনিয়ন্ত্রিত ড্রেজিং (নাব্যতা বাড়ানোর জন্য) করে পলিকাদাবালি তুলে নির্দিষ্ট উচ্চতা পর্যন্ত ভরে দিতে হবে। ফলে পুরো গ্রাম একটি সুরক্ষিত ভূমিতে পরিণত হবে। গ্রামের এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে যেতে নৌকার প্রয়োজন হবে না। শুধু রিটেইনিং ওয়ালঘেরা এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতে নৌকার প্রয়োজন হবে। পতিত জমি, যা বর্ষার সময় পানিতে ডুবে থাকে, তা ভরাট করার ফলে বাড়তি জায়গা পাওয়া যাবে। যেখানে স্কুল, বাজার, খেলার মাঠ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের আবাসন, মসজিদ, কবরস্থান ইত্যাদি কাজে ব্যবহার করা যাবে। ব্যবস্থায় অনেক সুবিধা পাওয়া যাবে। প্রতি বছর মাটি কেটে ভিটেতে দিতে হবে না, স্যানিটেশন সুবিধা দেয়া যাবে। ফলে কাঁচা পায়খানা  থেকে পানিদূষণ হবে না, খাবার পানির সুবিধা পাওয়া যাবে, ছোটখাটো ব্যবসা বা কলকারখানা করার সুযোগ হবে ইত্যাদি

রিটেইনিং ওয়াল তৈরির আগে সঠিক প্রকৌশলগত ডিজাইন প্রয়োজন। মাটির চাপ বা প্যাসিভ আর্থ প্রেসার, সারচার্জ বা মাটির ওপর অতিরিক্ত ভর, বৃষ্টির পানির ড্রেনেজ ব্যবস্থা, মাটিতে প্রবেশ করা পারকোলেটেড বা সিপেজ পানি বের করার জন্য উইপিং হোল ফিল্টার ড্রেন, কনসলিডেশন বা সংকোচন, স্থায়িত্ব ইত্যাদি বিষয় ধরে প্রকৌশলগত ডিজাইন করতে হবে। ড্রেজিং করে ভরাটের সময় গ্রামের মধ্যে বিদ্যমান গোসল গৃহস্থালি কাজে ব্যবহূত পুকুর, বৃষ্টির পানি ড্রেনেজের জন্য প্রাকৃতিক জলাশয় ইত্যাদি প্রয়োজনীয় ধরে ভরাট থেকে বাদ রাখতে হবে। ব্যাপারে গ্রামের অধিবাসীরা প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে পারে। ১০০ বা ২০০ বছর স্থায়িত্ব হবেএমন রিটেইনিং ওয়াল তৈরি করা উচিত। সেজন্য এক নম্বর গ্রেডের কংক্রিটের রিটেইনিং ওয়াল হয়েছে কিনা, তা নিশ্চিত করতে হবে। শুকনো মৌসুমে গ্রামে প্রবেশ, কৃষি যন্ত্রপাতির চলাচল, গাড়ি চলাচল করার জন্য চতুর্দিকে ঢালু রাস্তার (র্যাম্প) সুবন্দোবস্ত থাকতে হবে ভরা বর্ষার হাওড়ে নৌচলাচলে সুবিধা নৌকা বেঁধে রাখার ব্যবস্থাসহ চারপাশে সিঁড়ির ব্যবস্থা রাখতে হবে

রিটেইনিং ওয়াল তৈরি করে ভাঙন রোধ করা নতুন কোনো পদ্ধতি নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এটি ব্যবহার হয়ে আসছে। তবে হাওড়ে ব্যবহার করা হবে অভিনব, কার্যকরী, স্থায়ী স্থান উপযোগী পদ্ধতি। যদিও খরচ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। বর্তমানে দেশের অর্থনীতি যে অবস্থায় আছে, সেখানে প্রশাসন সরকার চাইলে বিভিন্ন ফেজে গ্রামগুলোকে ভাগ করে ১০ বছরের মধ্যে রিটেইনিং ওয়াল তৈরি করে ভাঙন রোধ করে দিতে পারে। চির অবহেলিত মানুষগুলো একবার একটু বাড়তি সুবিধা পেয়ে যদি দীর্ঘদিন ভাঙনের চিন্তামুক্ত থাকে, তাতে দেশেরই তো মঙ্গল। চিন্তামুক্ত হয়ে দেশের উন্নয়নে তারা আত্মনিয়োগ করতে পারবে। এটাই সবার কাম্য হওয়া উচিত। প্রশাসন, সরকার সুধী সমাজ বিষয়ে এগিয়ে আসবে বলে আমি আশাবাদী

ড. মো. আনোয়ার হোসেন

লেখক: কৃষি পরিবেশ প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ

অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

[email protected]

Source:

http://bonikbarta.net/bangla/news/2017-08-29/129434/হাওড়াঞ্চলে-আফালের-ফলে-ভূমিক্ষয়-রোধ-ও-ভূমি-পুনরুদ্ধার–/

Picture Source: গুগল থেকে নেয়া।

 


বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কে আরো নতুন নতুন সংবাদ জানতে সাবস্ক্রাইব করুন।

[mc4wp_form id=”3448″]

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
কলামকৃষি

বাংলাদেশের পুনর্জাগরণ: ৮৭০০০ গ্রাম এবং প্রকৃত জনতার রাজনীতি – ড. আবেদ চৌধুরি

ড. আবেদের আহবান, বাংলাদেশের গ্রাম ও প্রকৃত জনতার পুনর্জাগরণ, খাদ্য ও জ্বালানি...

কৃষি

জৈব কৃষি এবং আমাদের প্রত্যাশা

জৈব কৃষি একটি বাস্তবসম্মত পদ্ধতি যা আজকের অর্থনীতির তুলনায় আগামীকালের বাস্তুসংস্থানকে আরো...

কৃষি

‘হুজ হু বাংলাদেশে ২০১৭’ পদক পেয়েছেন প্রফেসর ড ম আ রহিম

কৃষি ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ‘হুজ হু বাংলাদেশে ২০১৭’ পদক পেয়েছেন প্রফেসর...

ভাসমান সবজি চাষ
কৃষি

ভাসমান সবজি চাষ

বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ, কিন্তু দেশের বেশির ভাগ এলাকা নিন্মাঞ্চাল হওয়ায় বর্ষা...

কৃষি

গবেষণাপত্র: Increasing homestead Production through Microfinance

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার প্রবলচাপের ফলে প্রতিবছর ১% করে কৃষি জমি কমছে। আবাসন ব্যবস্থাপনার...

দেশ-বিদেশের গবেষক, বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের একটি অলাভজনক প্লাটফর্ম। বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে বাংলাকে আরো সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে আমাদের নিবেদন বিজ্ঞানী.org

যোগাযোগ

biggani.org [@]জিমেইল.com

Copyright 2024 biggani.org