প্রফেসর- ড. মোহা: ইয়ামিন হোসেন
ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন মেন্টর হলো একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি, যিনি শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে উন্নতির জন্য দিকনির্দেশনা দেন। মেন্টর সাধারণত ছাত্রদের একাডেমিক, পেশাগত এবং ব্যক্তিগত লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করেন। মেন্টরিং সিস্টেম একটি সুশৃঙ্খল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চালু করলে তা শিক্ষার্থীদের মানসিক, একাডেমিক এবং পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে অনেক সহায়ক হতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে মেন্টরিং সিস্টেম শুরু করার কিছু ধাপ এবং উদাহরণ নিচে বিস্তারিতভাবে দেওয়া হলো:
১. মেন্টর কে হবেন:
একটি মেন্টরিং সিস্টেম চালু করার আগে মেন্টরদের নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়ে মেন্টর হিসেবে নিম্নলিখিত ব্যক্তিরা দায়িত্ব পালন করতে পারেন:
ফ্যাকাল্টি সদস্য:
একজন অধ্যাপক বা শিক্ষক, যিনি শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পরামর্শ এবং গবেষণায় দিকনির্দেশনা দিতে পারেন। যেমন, একজন অধ্যাপক গবেষণামূলক প্রশ্নের উত্তর দিতে, থিসিস লেখা বা গবেষণার গুণগত মান বৃদ্ধি করতে সহায়তা করতে পারেন।
২. সিনিয়র শিক্ষার্থী:
সিনিয়র শিক্ষার্থীরা জুনিয়রদের পরামর্শদাতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন। তারা ক্যাম্পাস জীবনের অভিজ্ঞতা, পড়াশোনার কৌশল এবং পেশাগত দিকনির্দেশনা দিতে পারেন।
3. অ্যালামনাই (প্রাক্তন শিক্ষার্থী):
যারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়েছেন এবং বর্তমানে পেশাগত জীবনে সফল আছেন, তারা শিক্ষার্থীদের জন্য মেন্টর হতে পারেন। তারা বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা এবং পেশাগত দক্ষতা শেয়ার করতে পারেন।
৪. বাহ্যিক পেশাজীবী:
অনেক বিশ্ববিদ্যালয় পেশাজীবীদের মেন্টর হিসেবে যুক্ত করে, যারা শিক্ষার্থীদের শিল্পের অভিজ্ঞতা, চাকরি প্রাপ্তির কৌশল এবং নেটওয়ার্কিং-এর সুযোগ তৈরি করতে সাহায্য করেন।
২. মেন্টরিং সিস্টেম চালু করার ধাপ:
(ক) মেন্টর এবং মেন্টি নির্ধারণ:
প্রথমে মেন্টর এবং মেন্টি নির্বাচন করা উচিত। শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুযায়ী মেন্টর নির্বাচন করা উচিত। যেমন, একাডেমিক চাহিদার জন্য একাডেমিক মেন্টর এবং পেশাগত উন্নতির জন্য পেশাগত মেন্টর নির্বাচন করা যেতে পারে। মেন্টিরা মেন্টরের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করে নিজেদের সমস্যার সমাধান পেতে পারে।
(খ) মেন্টরিং এর উদ্দেশ্য নির্ধারণ:
মেন্টরিং সিস্টেমের স্পষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকতে হবে। শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত এবং পেশাগত উন্নতি নিশ্চিত করার জন্য মেন্টরিং সেশনগুলোর উদ্দেশ্য পরিষ্কারভাবে নির্ধারণ করা জরুরি। যেমন, ক্যারিয়ার পরামর্শ, একাডেমিক সহায়তা, ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা ইত্যাদি।
(গ) রেগুলার মেন্টরিং সেশন:
মেন্টরিং সেশনগুলোর একটি নির্দিষ্ট রুটিন থাকা উচিত। নিয়মিত সেশন শিক্ষার্থীদের সাথে মেন্টরদের যোগাযোগ বজায় রাখবে এবং তাদের সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করতে সহায়ক হবে। উদাহরণস্বরূপ, মাসে একবার মেন্টরিং সেশন নির্ধারণ করা যেতে পারে, যেখানে শিক্ষার্থী তাদের সমস্যাগুলো শেয়ার করবে এবং মেন্টর তাদের সমাধান দিতে চেষ্টা করবেন।
(ঘ) ট্রেনিং ওয়ার্কশপ:
মেন্টরদের জন্য প্রাথমিকভাবে ট্রেনিং প্রোগ্রাম পরিচালনা করা উচিত। এতে তারা কীভাবে শিক্ষার্থীদের পরামর্শ দিবেন, কীভাবে তাদের সমস্যাগুলো বুঝবেন এবং কীভাবে সেগুলোর সমাধান করবেন তা শিখবেন। এছাড়া, মেন্টিদের জন্যও ওরিয়েন্টেশন সেশন পরিচালনা করা যেতে পারে, যাতে তারা মেন্টরদের কাছ থেকে কীভাবে সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে পারে তা শিখতে পারে।
(ঙ) ফিডব্যাক সংগ্রহ:
একটি কার্যকর মেন্টরিং সিস্টেম পরিচালনা করতে নিয়মিত ফিডব্যাক সংগ্রহ করা গুরুত্বপূর্ণ। মেন্টি বা শিক্ষার্থীরা মেন্টরদের কাছ থেকে কেমন সেবা পাচ্ছেন, তা নির্ধারণ করার জন্য ফিডব্যাক ফর্ম ব্যবহার করা যেতে পারে। ফিডব্যাকের মাধ্যমে সিস্টেমের কার্যকারিতা যাচাই করা যায় এবং প্রয়োজনে পরিবর্তন আনা যায়।
(চ) মেন্টর ও মেন্টি ম্যাচিং:
শিক্ষার্থীদের মেন্টরের সাথে সঠিকভাবে মিলিয়ে দেওয়া একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। শিক্ষার্থীর একাডেমিক, পেশাগত এবং ব্যক্তিগত লক্ষ্য বিবেচনা করে তাদের জন্য উপযুক্ত মেন্টর নির্বাচন করা উচিত। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো শিক্ষার্থী প্রযুক্তি শিল্পে কাজ করতে আগ্রহী হয়, তাহলে তার জন্য একজন আইটি বা সফটওয়্যার বিশেষজ্ঞ মেন্টর হিসেবে উপযুক্ত হবে।
(ছ) ডিজিটাল মেন্টরিং প্ল্যাটফর্ম:
একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা যেতে পারে, যেখানে মেন্টর এবং মেন্টি উভয়ই তাদের সেশন পরিচালনা করতে পারবে, প্রশ্ন-উত্তর বিনিময় করতে পারবে এবং প্রয়োজনীয় তথ্য পেতে পারবে। উদাহরণস্বরূপ, মাইক্রোসফট টিমস, জুম বা গুগল মিট ব্যবহার করে ভার্চুয়াল মেন্টরিং সেশনগুলো আয়োজন করা যেতে পারে।
উদাহরণ:
MIT (Massachusetts Institute of Technology) মেন্টরিং প্রোগ্রাম:
MIT-এর মেন্টরিং প্রোগ্রাম খুবই সফলভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এখানে শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন স্তরের মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম রয়েছে, যেমন একাডেমিক মেন্টরশিপ, পেশাগত মেন্টরশিপ এবং গবেষণামূলক মেন্টরশিপ। শিক্ষার্থীরা তাদের বিভাগের অধ্যাপক, গবেষণা বিজ্ঞানী এবং সিনিয়র শিক্ষার্থীদের থেকে মেন্টরশিপ পায়। তারা বিভিন্ন ওয়ার্কশপ, সেমিনার এবং সেশন আয়োজন করে, যেখানে শিক্ষার্থীরা নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারে।
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির BEAM প্রোগ্রাম:
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির BEAM (Bridging Education, Ambition & Meaningful Work) মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম শিক্ষার্থীদের পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নে সহায়তা করে। এখানে শিক্ষার্থীরা সফল পেশাজীবী এবং অ্যালামনাইদের কাছ থেকে পরামর্শ নেয়, যাতে তারা তাদের ক্যারিয়ারের জন্য সঠিক দিকনির্দেশনা পায়। এই প্রোগ্রামটি নিয়মিত ওয়ার্কশপ, নেটওয়ার্কিং ইভেন্ট এবং এক্সপার্ট সেশন পরিচালনার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করে।
উপসংহার:
একটি সুশৃঙ্খল মেন্টরিং সিস্টেম শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত, একাডেমিক এবং পেশাগত জীবনে উন্নতি ঘটাতে সক্ষম। মেন্টরদের সঠিকভাবে নির্বাচন এবং মেন্টরিং সেশন পরিচালনার মাধ্যমে একটি কার্যকর মেন্টরিং সিস্টেম গড়ে তোলা সম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই ধরনের সিস্টেম চালু করে শিক্ষার্থীদের উন্নয়ন ঘটাতে পারে এবং তাদের ভবিষ্যৎ সাফল্যের জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করতে পারে।
বিদ্র: ফেসবুক থেকে সংগ্রহীত—————–https://www.facebook.com/share/p/18XKowUEgZ/
Leave a comment