নবীন প্রজন্মদের সাক্ষাৎকার সিরিজে এবার আমরা সাক্ষাৎকার নিয়েছি মাশরাফি বিন মোবারক এর। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদে সাইন্টিফিক অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন। । তার সাক্ষাৎকারটি পড়ুন:
প্রথমেই আপনার সম্বন্ধে আমরা জানতে চাই ?
আমার পৈত্রিক নিবাস চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলায়। আমার বাবা মো: মোবারক হোসেন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাউন্টস অফিসারের দায়িত্বে থেকে ২০১৭ সাথে অবসর গ্রহণ করেন। আমার মা শিরীন আক্তার, ঢাকাস্থ ওয়ারী এম.এ.আলীম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক থেকে বর্তমানে অবসর উত্তর ছুটিতে আছেন।
আমি দশম শ্রেণী পর্যন্ত কচুয়া উপজেলায় পড়াশোনা করেছি। পরবর্তীতে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ থেকে মাধ্যমিক (২০১১) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগ থেকে স্নাতক (সেশন ২০১১-১২) ও স্নাতকোত্তর (সেশন ২০১৬) সম্পন্ন করেছি।
আমি ২০১৯ সালের ২১ শে মে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদে সাইন্টিফিক অফিসার হিসেবে যোগদান করি। আমি এবং আমার স্ত্রী, আমরা দুজনই বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদে সাইন্টিফিক অফিসার হিসেবে কর্মরত আছি। আমাদের একজন পুত্রসন্তান (৩) আছে।
আপনার গবেষনার বিষয় কি ?
বিজ্ঞানী বা গবেষকদের গবেষণার বিষয় বলতে হলে প্রথমেই গবেষণার ক্ষেত্রটি উল্লেখ করতে হয়। আমি প্রধানত “ম্যাটেরিয়াল সাইন্স”, ” বায়ো-ম্যাটেরিয়াল”, “ন্যানো-সাইন্স এবং ন্যানো-টেকনোলজি”, “ড্রাগ ডেলিভারি” এবং “ওয়েস্ট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট” ক্ষেত্রগুলোতে কাজ করি।
প্রথমেই বায়ো-ম্যাটেরিয়াল নিয়ে আলোকপাত করা যাক। এখানে “বায়ো” শব্দটি দিয়ে বায়োলজিকাল বুঝানো হয়েছে, অর্থাৎ “বায়ো-ম্যাটেরিয়াল” বলতে সে সকল ম্যাটেরিয়ালকে বুঝানো হয়েছে যারা বায়োলজিকাল এনভায়রনমেন্টে কোনপ্রকার বিষক্রিয়া তৈরি করা ছাড়া সুসঙ্গতভাবে থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, মানবশরীরের হাড়ের প্রধান উপাদান “ক্যালসিয়াম ফসফেটস” একটি উতকৃষ্ট বায়ো-ম্যাটেরিয়াল। ক্যালসিয়াম ফসফেটস আসলে একক কোন যৌগ নয়, এটি একটি যৌগের পরিবার যেখানে বিভিন্ন অনুপাতে ক্যালসিয়াম এবং ফসফরাস থাকে। আমি প্রধানত যেই বায়ো-ম্যাটেরিয়াল নিয়ে কাজ করি সেটি ক্যালসিয়াম হাইড্রোক্সি-অ্যাপাটাইট (১০ অণু ক্যালসিয়াম, ৬ অণু ফসফেট এবং ২ অণু হাইড্রোক্সিল) নামে পরিচিত।
আমার প্রজেক্টের লক্ষ্য হচ্ছে আবর্জনায় পরিনত হয়েছে এমন অনেকগুলো উৎস, যেমন- পরিত্যাক্ত ডিমের খোসা, মাছের আঁশ কিংবা সামুদ্রিক ঝিনুক থেকে ক্যালসিয়াম হাইড্রোক্সি-অ্যাপাটাইট বিভিন্ন পদ্ধতিতে তৈরি করে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে এদের বৈশিষ্ট্য নিরুপণ করা। হাড়ের বিভিন্ন রোগের জন্য যেসকল ব্যাকটেরিয়া দায়ী সেসকল ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করতে পারে এমন কিছু এন্টিবায়োটিক ঔষধকে তৈরিকৃত ক্যালসিয়াম হাইড্রোক্সি-অ্যাপাটাইটে বোঝাই করে আক্রান্ত স্থানে স্থাপন করা হলে সময়ের সাথে তা কি পরিমাণে রিলিজ পাবে এই বিষয়টি নিয়ে আমি গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছি।
এছাড়া, বিভিন্ন টেক্সটাইল মিল থেকে নির্গত হওয়া ক্ষতিকর-বিষাক্ত কাপড়ের রঙ (যা ডাই নামে পরিচিত)-কে ক্যালসিয়াম হাইড্রোক্সি-অ্যাপাটাইট দ্বারা অপসারণ এবং ভেঙ্গে ফেলতে সক্ষম হয়েছি।
অন্যদিকে, পরিত্যক্ত মাছের আঁশকে কাজে লাগিয়ে আমি কপার অক্সাইড ন্যানোম্যাটেরিয়াল তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি যা ব্যাকটেরিয়াকে দক্ষতার সাথে ধ্বংস করতে সক্ষম। কামরাঙা গাছের পাতা ব্যবহার করেও আমি ব্যাকটেরিয়া বিধ্বংসী কপার অক্সাইড ন্যানোম্যাটেরিয়াল তৈরি করেছি।
কোভিড-১৯ মহামারীর সময় আমাদের দ্বারা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত এবং ফেলে দেয়া ফেসমাস্ক পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই পরিত্যক্ত ফেসমাস্ককে আমি পলিএস্টার রেজিনের সাথে সমাহার ঘটিয়ে একটি কম্পোজিট বা বিমিশ্র তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি যা খালি রেজিনের চেয়ে বেশি শক্তি ধারণ করে।
এছাড়াও ভুট্টার ফেলে দেয়া শিষকে আমরা আমাদের গবেষণাগারে নিজেদের তৈরি করা রি-অ্যাকটারের মাধ্যমে “বায়ো-চার” নামক কার্বন সমৃদ্ধ একটি ম্যাটেরিয়ালে রুপান্তর করেছি যা বিষাক্ত ভারী ধাতু এবং টেক্সটাইল রঙ অপসারণ করতে সক্ষম।
আপনার গবেষনার কাজগুলি কিভাবে আমাদের উপকৃত করছে কিংবা করবে ?
গবেষণার বিষয়বস্তু ঠিক করার আগে আমি প্রথমেই চিন্তা করি আমার দেশের জন্য কোন বিষয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমান সময়ে অতিরিক্ত মাত্রায় টেক্সটাইল ডাই নদ-নদীতে ফেলে দেয়ার কারণে ব্যাপক পরিবেশ বিপর্যয় হচ্ছে। তাই আমার গবেষণায় এই ব্যাপারটি সবসময়ই প্রাধান্য পায়৷ আমার তৈরিকৃত বায়ো-ম্যাটেরিয়াল এবং বায়ো-চার এর মাধ্যমে এই সমস্যাটির একটি সমাধান হিসেবে অধিষ্ঠিত করতে আমি নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছি।
আমার তৈরিকৃত বায়ো-ম্যাটেরিয়াল হাড়ক্ষয়-সংক্রান্ত অসুখে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসার একটা নতুন দিক উন্মোচন করতে পারবে বলে আমি আশা করি। এছাড়াও বিভিন্ন বর্জ্য পদার্থকে কাজে লাগিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ন্যানোম্যাটেরিয়াল তৈরির মাধ্যমে পরিবেশ দূষণের মাত্রা কিছুটা হলেও কমাতে সক্ষম হয়েছি।
গবেষনা কাজের বিশেষ কোন অভিজ্ঞতা কি আমাদের সাথে শেয়ার করবেন ?
মাছের আঁশ ব্যবহার করে আমার তৈরি করা কপার অক্সাইড ন্যানোপার্টিক্যাল-কে আমি একটা আকস্মিক উদ্ভাবন বলে আখ্যায়িত করবো৷ কেননা আমার আসল লক্ষ্য ছিলো অন্য একটা ম্যাটেরিয়াল তৈরি করা। সেটি না হওয়ায় আমি খুবই হতাশ ছিলাম। পুনঃ পুনঃ প্রচেষ্টায়ও সেটি বানাতে না পেরে আমি কাজটি প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম। পরে চিন্তা করলাম, যা বানাতে চেয়েছি তা যদি নাইবা হয়ে থাকে, তাহলে আসলে হয়েছেটা কি!
সেই অনুসন্ধান থেকেই আবিষ্কার করি যে আমি কপার অক্সাইড ন্যানোপার্টিক্যাল তৈরি করে ফেলেছি! পরবর্তীতে আমি এটি নিয়ে বিস্তর গবেষণা চালিয়ে যাই। আমার এই গবেষণাটির উপর ভিত্তি করে পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরে একটি প্যাটেন্ট দাখিল করেছি। তাই কেউ গবেষক হতে চাইলে আমার পরামর্শ থাকবে সহজেই হতাশ না হতে৷ ফলাফল আশানুরূপ না হলে হতাশ না হয়ে তা কেন হয়নি সেটি নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাওয়া উচিৎ। তাতে আরও উত্তম আবিস্কারও হয়ে যেতে পারে!
একজন বিজ্ঞানীর কি কি গুণ থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন ?
বিজ্ঞানী হতে হলে অনেক বেশি মেধাবী হতে হয়”- এটি আমি বিশ্বাস করি না। একজন সফল বিজ্ঞানী হতে হলে সবচেয়ে বেশি পরিশ্রমী এবং নাছোড়বান্দা হওয়া প্রয়োজন। প্রতিনিয়ত নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে এবং এর উত্তর খুঁজে বের করতে হবে/খোঁজ চালিয়ে যেতে হবে। এখানে সফলতার কোন শর্টকাট নেই। তাই সততার সাথে কঠোর পরিশ্রম করে যেতে হবে। প্রতিদিনই নিজেকে আগের দিনের চেয়ে বেটার করে তুলতে হবে।
বাংলাদেশের তরুণ শিক্ষার্থী যারা বিজ্ঞানে কাজ করতে চায় – তাদের জন্য আপনার কোন ম্যাসেজ কিংবা বার্তা কি ?
গবেষণায় অনেক বেশি ডেডিকেশনের প্রয়োজন হয়। মন থেকে এটি না আসলে এই পথে না হাঁটাই উত্তম হবে। তবে যদি কেউ গবেষক হওয়ার মনস্থির করে থাকে, তবে আমার প্রথম উপদেশ থাকবে এই পথে অলরেডি আছে এমন কারো সাথে কথা বলতে। কারণ প্রথম দিকনির্দেশনাটা প্রায় সবারই প্রয়োজন হয়।
জানার/শেখার জন্য একদমই লজ্জা বা অহং থাকলে চলবে না৷ ছোট-বড় সবার কাছে শেখার জন্য যাওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। গবেষণা একটি টিম-ওয়ার্ক, তাই সবার সাথে মানিয়ে চলার সক্ষমতা থাকতে হবে। প্রতিনিয়তই নতুন নতুন স্কিল অর্জন করে নিজেকে ঝালিয়ে নিতে হবে৷
আপনার ইমেইল : [email protected]
আপনার লিংকডইন : https://www.linkedin.com/in/mashrafi-bin-mobarak-5a6aa0138
আপনার ওয়েবসাইট বা গবেষনাকাজের লিংক : https://scholar.google.com/citations?user=IfO0R-8AAAAJ&hl=en&authuser=3
আমরা বিজ্ঞানী অর্গ এর পক্ষ এর থেকে মাশরাফি বিন মোবারক এর উত্তোরত্তর সাফল্য কামনা করি। তিনি আমাদের নবীন গবেষকদের জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
Leave a comment