ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী (১৯৪৩–২০২০) ছিলেন বাংলাদেশের প্রকৌশল ও প্রযুক্তিখাতে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব, যিনি স্থাপনা, অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষা, এবং তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই মনে আসে সেতু নির্মাণ, ভবন নিরাপত্তা, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন এবং নতুন প্রজন্মের জন্য উদ্দীপক পরিবেশ তৈরি করার কথা। তিনি ছিলেন এমন একজন উদার মানসিকতার প্রকৌশলী, যিনি শিক্ষা ও গবেষণাকে দেশের উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে দেখেছিলেন।
প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা
জামিলুর রেজা চৌধুরীর জন্ম সিলেটে। তাঁর পরিবার ছিল শিক্ষানুরাগী ও সংস্কৃতিমনা। পরিবার থেকেই তিনি পেয়েছিলেন মানসম্মত শিক্ষার গুরুত্বের বীজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করে তিনি প্রকৌশল শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে অধ্যয়ন এবং বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের মাধ্যমে তিনি নিজের জ্ঞানভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেন। তাঁর বিদেশি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণ এবং সেখানকার গবেষণার অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে বাংলাদেশে প্রয়োগ করে তিনি একটি অগ্রসরমান গবেষণা ধারা গড়ে তোলেন।
পেশাগত জীবন ও গবেষণা
বুয়েটে শিক্ষকতা দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা হয়। তিনি দীর্ঘদিন বুয়েটের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং পরবর্তীতে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত থেকে দেশীয় প্রকৌশল গবেষণার মানোন্নয়নে ভূমিকা রাখেন। তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র ছিল অবকাঠামো নির্মাণ, সেতু ও বহুতল ভবনের নিরাপত্তা, ভূমিকম্পঝুঁকি নিরূপণ এবং নির্মাণশিল্পের আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিতকরণ।
তিনি একাধারে ছিলেন পরামর্শক প্রকৌশলী ও পরিকল্পনাকারী। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সেতু ও অবকাঠামো প্রকল্পে তাঁর পরামর্শ ও তত্ত্বাবধান দেশের প্রকৌশল খাতকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের পর্যায়ে উন্নীত করে। পদ্মা সেতুর মতো মেগা-প্রকল্পের নকশা ও পরিকল্পনায়ও তিনি বিভিন্ন পর্যায়ে যুক্ত ছিলেন। ভবন নির্মাণে ভূমিকম্পঝুঁকি কমানোর ক্ষেত্রে তাঁর গবেষণা ও নির্দেশিকা দেশের নগর পরিকল্পনায় সংযোজন করেছে নিরাপদ নির্মাণের মূলনীতি।
শিক্ষা, নেতৃত্ব ও প্রতিষ্ঠান গঠন
শুধু প্রকৌশল গবেষণাতেই নয়, তিনি ছিলেন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরও সফল সংগঠক। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে তিনি দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন আনতে উদ্যোগী হন। তাঁর নেতৃত্বে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় কেবলমাত্র একজন শিক্ষাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সীমাবদ্ধ না থেকে গবেষণা, নীতিমালা প্রণয়ন, এবং সামাজিক উন্নয়নের জ্বালানি হিসেবে কাজ করেছে।
তিনি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহযোগিতা করে বাংলাদেশের শিক্ষার্থী এবং গবেষকদের আন্তর্জাতিক মানের জ্ঞান আহরণে সুযোগ করে দিয়েছেন। এভাবে তিনি সারা জীবনে জ্ঞান বিনিময়, প্রশিক্ষণ, ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানবসম্পদ উন্নয়নে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন।
প্রযুক্তি ও ডিজিটাল রূপান্তরে অবদান
ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী শুধু সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সীমাবদ্ধ থাকেননি; তিনি তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও বিশেষ অবদান রেখেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ডিজিটাল রূপান্তর ও আইসিটি (ICT) শিক্ষার প্রসার ছাড়া দেশের দ্রুত অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই তিনি বাংলাদেশে ইন্টারনেট ও আইসিটি শিক্ষার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
বাংলাদেশের আইসিটি খাতকে এগিয়ে নিতে গঠনমূলক পরামর্শ প্রদান, নীতি নির্ধারণে অবদান রাখা এবং যোগ্যতাসম্পন্ন মানবসম্পদ তৈরিতে তিনি অগ্রণী ছিলেন। তাঁর উদ্যোগের ফলে নতুন প্রজন্মের উদ্যোক্তারা প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবসা, স্টার্টআপ এবং উদ্ভাবনের সুযোগ পাচ্ছেন। এর মাধ্যমে আইসিটি শিল্পে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মঞ্চে একটি নতুন পরিচয় লাভ করেছে।
সমাজে ইতিবাচক প্রভাব
ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর জীবন ও কর্ম কেবলমাত্র প্রকৌশল ও প্রযুক্তির গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়; তিনি বাংলাদেশে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ার ক্ষেত্রে অগ্রণী ছিলেন। তিনি শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসতেন, কারণ তিনি জানতেন শিক্ষার্থীরাই আগামী দিনের নেতৃত্ব দেবে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে অনুসন্ধিৎসু মানসিকতা, গবেষণামুখী চিন্তাভাবনা, এবং দেশীয় সমস্যার সমাধানের উদ্যোগী মনোভাব গড়ে তুলতে তিনি গুরুত্ব দিতেন।
তিনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের স্বপ্ন দেখেছিলেন। গ্রামীণ অবকাঠামো থেকে শুরু করে শহুরে জীবনের পরিবহন ব্যবস্থাপনা, দূষণ নিয়ন্ত্রণ, এবং অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজেও তিনি পরোক্ষভাবে অবদান রাখেন। এভাবে তাঁর পরিকল্পনা ও নেতৃত্ব উন্নয়নের একটি সামগ্রিক মডেল হিসেবে কাজ করে, যেখানে প্রকৌশল, প্রযুক্তি, শিক্ষা এবং মানবকল্যাণ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে।
স্বীকৃতি ও সম্মাননা
ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। তবুও, তিনি সবসময় সাদামাটা জীবনযাপন করতেন, বিনয়ী ছিলেন এবং মানুষের কল্যাণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতেন। তাঁর পাণ্ডিত্য, নেতৃত্ব, এবং দেশপ্রেম নতুন প্রজন্মের কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
উপসংহার
ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন একজন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নির্মাতা ও শিক্ষাবিদ, যাঁর জীবন ও কর্ম বাংলাদেশের উন্নয়নের পরিক্রমায় স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে। অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি প্রসার, এবং গবেষণাকে জাতীয় সমৃদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে একটি দেশ সীমিত সম্পদ সত্ত্বেও উন্নতি করতে পারে।
তাঁর মৃত্যুতে জাতি একজন বিশিষ্ট জ্ঞানতাপসকে হারিয়েছে, কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের শিক্ষা, এবং উদ্ভাবনী দৃষ্টিভঙ্গি অনন্ত অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। আগামী দিনে যখন বাংলাদেশ আরও অগ্রসর হবে, তখন নিশ্চয়ই ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর নামে স্মরণ করবে এক দূরদৃষ্টি সম্পন্ন বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তানায়ককে, যিনি অনুপ্রেরণা দিয়েছেন জ্ঞান ও প্রযুক্তির আলোক শিখা উঁচুতে ধরতে।
Leave a comment