তথ্যপ্রযুক্তি

ইন্টারনেটের আস্থা সংকট: তথ্যের যুগে বিভ্রান্তি

Share
Share

ইন্টারনেট যখন প্রথম যাত্রা শুরু করেছিল নব্বইয়ের দশকে, তখন আমাদের সবাইকে এক নতুন আশার আলো দেখিয়েছিল। আমরা ভেবেছিলাম যে পৃথিবীটা সত্যিই একটি “গ্লোবাল ভিলেজ” হতে চলেছে। মানুষ ইন্টারনেট প্রযুক্তির মাধ্যমে একে অপরের সাথে দ্রুত যোগাযোগ স্থাপন করতে পেরেছে, সহজে তথ্যে পাওয়া সম্ভব হয়েছে, এবং জ্ঞান সহজলভ্য হয়েছে। কিন্তু এই অভূতপূর্ব অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে কিছু জটিলতা এবং সমস্যাও দেখা দিয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো ভুয়া তথ্যের বিস্তার এবং সেই সঙ্গে ইন্টারনেটের প্রতি মানুষের আস্থার ক্রমবর্ধমান হ্রাস।

ইন্টারনেটের সূচনা ও প্রথমদিকের আস্থা

নব্বইয়ের দশকে ইন্টারনেটের যাত্রা শুরু হয়েছিল মূলত একে অপরের সথে সহজে তথ্য শেয়ার করার উদ্দ্যেশে এবং বিশ্বাসের ভিত্তিতে। শিক্ষাবিদ, গবেষক, এবং প্রযুক্তিবিদরা তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা শেয়ার করতেন বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে, যেখানে তারা অন্যদের সহযোগিতা করতে পারতেন এবং নিজেদের কাজকে সমৃদ্ধ করতে পারতেন। সেই সময় ইন্টারনেট একটি নির্ভরযোগ্য মাধ্যম ছিল যেখানে সত্যতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল প্রধান বিবেচ্য বিষয়। মানুষ ইন্টারনেটে পাওয়া তথ্যের ওপর ভরসা করত এবং সেই তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিত।

স্বাধীনতার প্রভাব: সুবিধা ও অসুবিধা

ইন্টারনেটের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর স্বাধীনতা। যে কেউ যেকোনো ধরনের তথ্য শেয়ার করতে পারে, যা মানুষকে তাদের স্বাধীন মত প্রকাশের সুযোগ দেয়। এই স্বাধীনতার ফলে মানুষ ইন্টারনেটে সহজেই নিজেদের ভাবনা-চিন্তা প্রকাশ করতে শুরু করে, এবং সোশ্যাল মিডিয়া আসার পর এটি আরও সহজ হয়ে ওঠে। সামাজিক মাধ্যমে মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতা, মতামত এবং জ্ঞান শেয়ার করতে শুরু করে, যা ইন্টারনেটকে একটি বৃহত্তর এবং বৈচিত্র্যময় প্ল্যাটফর্মে পরিণত করে।

তবে, এই স্বাধীনতার যেমন সুবিধা রয়েছে, তেমনি অসুবিধাও রয়েছে। ইন্টারনেটের স্বাধীনতা অনেক সময় নেতিবাচক তথ্য এবং ভূয়া খবরের সঞ্চার করে, যা ধীরে ধীরে ইন্টারনেটের প্রতি মানুষের আস্থার হ্রাস ঘটায়।

ভুয়া তথ্যের প্রভাব ও ইন্টারনেটের আস্থাহানি

ভুয়া তথ্য ইন্টারনেটে একটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়। ইন্টারনেটে যেকেউ যেকোনো ধরনের তথ্য আপলোড করতে পারে, এবং সঠিক উৎস ও যাচাই না থাকায় অনেক সময় এই তথ্যগুলোই মানুষকে বিভ্রান্ত করে। যেমন, বিভিন্ন গুজব, মিথ্যা সংবাদ, এবং অবৈজ্ঞানিক তথ্য ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে, যা মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করে এবং সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে।

বিশ্বস্ত ও প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোও এই সমস্যা থেকে মুক্ত নয়। তারা বহুবার ইন্টারনেটে বিভ্রান্তিমূলক তথ্যের শিকার হয়েছে এবং তাদের ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে, সাধারণ মানুষ ইন্টারনেটের ওপর তাদের বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে এবং তথ্যের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ করতে শুরু করে।

সোশ্যাল মিডিয়া ও আস্থার সংকট

সোশ্যাল মিডিয়ার আগমন ইন্টারনেটকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছে, তবে এটি আস্থার সংকটও তীব্রতর করেছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে ব্যক্তিগত মতামত, অভিজ্ঞতা এবং খবর ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যা অনেক সময় যাচাই-বাছাই ছাড়াই মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে, অনেক সময় সত্য মিথ্যা মিশ্রিত হয়ে যায় এবং মানুষ বিভ্রান্তিতে পড়ে।

এছাড়াও, সামাজিক মাধ্যমগুলোর অ্যালগরিদম ব্যবহারকারীদের পছন্দ অনুযায়ী কনটেন্ট দেখায়, যা অনেক সময় ‘ইকো চেম্বার’ তৈরি করে। এটি একটি অবস্থান যেখানে মানুষ শুধুমাত্র তাদের মতামতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ তথ্য পায় এবং ভিন্নমত সম্পর্কে জানার সুযোগ পায় না। এর ফলে মানুষ আরও বদ্ধমূল ধারণার শিকার হয় এবং তাদের বিশ্বাসের গণ্ডি আরও সংকীর্ণ হয়ে যায়।

‘ইকো চেম্বার’ (Echo Chamber) হলো একটি সামাজিক এবং মানসিক পরিস্থিতি যেখানে মানুষ শুধুমাত্র তাদের মতামত এবং বিশ্বাসের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ তথ্য ও মতামতগুলোই দেখে, শুনে বা গ্রহণ করে। এই পরিস্থিতি তৈরি হয় যখন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিজস্ব বিশ্বাস বা ধারণার বিপরীত কিছু শুনতে বা দেখতে চায় না, এবং তারা কেবলমাত্র তাদের ধারণাগুলোকে সমর্থন করে এমন তথ্য বা মতামত গ্রহণ করে।

ইন্টারনেটের বিশ্বাসযোগ্যতার পুনরুদ্ধার

ইন্টারনেটের বিশ্বাসযোগ্যতা পুনরুদ্ধার করা একটি জটিল কিন্তু জরুরি কাজ। এর জন্য সঠিক তথ্য যাচাইয়ের প্রক্রিয়া এবং ফ্যাক্ট-চেকিং প্ল্যাটফর্মগুলোর ব্যবহার বাড়ানো প্রয়োজন। এছাড়াও, মানুষকে ইন্টারনেট ব্যবহারের সময় তথ্যের উৎস এবং তার সত্যতা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।

বিভিন্ন প্রযুক্তি সংস্থা এবং সামাজিক মাধ্যমগুলোকে এই বিষয়ে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। তারা যেন তাদের প্ল্যাটফর্মে ভুয়া তথ্য ছড়াতে না দেয় এবং ব্যবহারকারীদের সঠিক তথ্য প্রদান করতে পারে। এছাড়াও, শিক্ষাব্যবস্থায় ডিজিটাল লিটারেসি অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন, যাতে নতুন প্রজন্ম ইন্টারনেটের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে এবং সঠিকভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে শেখে।

সত্যতা (ফ্যাক্ট চেক) যাচাইয়ের কিছু সাইট

১. ফ্যাক্টচেক.অর্গ: আনেনবার্গ পাবলিক পলিসি সেন্টারের একটি প্রকল্প, যা প্রধান মার্কিন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বক্তব্যের তথ্যগত সঠিকতা যাচাই করে।

২. পলিটিফ্যাক্ট: টাম্পা বে টাইমস দ্বারা পরিচালিত, এই নিরপেক্ষ সাইটটি রাজনীতিবিদদের দাবির সঠিকতা মূল্যায়ন করতে একটি “সত্য-মিটার” ব্যবহার করে।

৩. স্নোপস: সবচেয়ে পুরানো এবং বৃহত্তম তথ্য যাচাই সাইট, স্নোপস শহুরে কিংবদন্তি, লোককথা, মিথ এবং ভুল তথ্য তদন্ত করে।

৪. রয়টার্স ফ্যাক্ট চেক: রয়টার্স দ্বারা পরিচালিত, এই পরিষেবাটি বিস্তৃত বিষয়ের উপর তথ্য যাচাই করে, যার মধ্যে রাজনৈতিক দাবি এবং ভাইরাল ভুল তথ্য অন্তর্ভুক্ত।

৫. এএফপি ফ্যাক্ট চেক: এজেন্স ফ্রান্স-প্রেস থেকে একটি পরিষেবা, এটি সংবাদ এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত তথ্যের সঠিকতা যাচাই করে।

বাংলা ভাষায় কিছু ফ্যাক্ট চেকের সাইট:

১. রিউমর স্ক্যানার বাংলাদেশ
এটি বাংলাদেশের একটি স্বীকৃত তথ্য যাচাই সংস্থা, যা ২০২০ সালের ১৭ মার্চ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর লক্ষ্য বাংলাদেশে গুজব ও ভুয়া খবর প্রতিরোধ করা এবং জনগণকে সঠিক তথ্য প্রদান করা।

২. এএফপি ফ্যাক্ট চেক বাংলা
এজেন্স ফ্রান্স-প্রেসের (এএফপি) একটি তথ্য যাচাই ইউনিট রয়েছে যা বাংলায় ভুল তথ্য খণ্ডন করে প্রকাশ করে। তাদের বাংলা তথ্য যাচাই কার্যক্রম স্থানীয় ভাষায় অনলাইন সামগ্রী পর্যবেক্ষণের জন্য নিবেদিত একটি দল দ্বারা তত্ত্বাবধান করা হয়।

৩. ফ্যাক্টওয়াচ
এটি ইউনিভার্সিটি অফ লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব) দ্বারা পরিচালিত একটি বাংলা তথ্য যাচাই উদ্যোগ।

৪.যাচাই
এটি আরেকটি বাংলা তথ্য যাচাই প্ল্যাটফর্ম, যা বাংলাদেশে তথ্য যাচাইয়ের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য সংস্থান।

পরিশেষ

ইন্টারনেটের প্রতি আস্থা হ্রাসের প্রক্রিয়া একটি দীর্ঘমেয়াদী এবং জটিল সমস্যা, তবে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এর সমাধান সম্ভব। ইন্টারনেটকে একটি বিশ্বস্ত, নির্ভরযোগ্য এবং নিরাপদ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে পুনরুদ্ধার করতে হলে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। ইন্টারনেটের স্বাধীনতার গুরুত্ব যেমন রয়েছে, তেমনি তার অপব্যবহার রোধ করাও সমানভাবে জরুরি।

যত দ্রুত আমরা এই বিষয়গুলো উপলব্ধি করব, তত দ্রুত আমরা ইন্টারনেটের বিশ্বাসযোগ্যতা পুনরুদ্ধার করতে পারব, এবং সেটি কেবলমাত্র আমাদের বর্তমানের জন্য নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্যও অপরিহার্য। ইন্টারনেট যদি আবার তার বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরে পায়, তবে এটি পুনরায় একটি শক্তিশালী এবং কার্যকর মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে, যা মানুষের জীবনকে আরও উন্নত করতে সক্ষম হবে।

এই প্রবন্ধে আমরা দেখেছি কিভাবে ইন্টারনেট তার আস্থা হারিয়েছে এবং কিভাবে তা পুনরুদ্ধার করা যেতে পারে। ইন্টারনেটের আস্থা পুনরুদ্ধার করা একটি ক্রমাগত প্রক্রিয়া, যা আমাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং সচেতনতার মাধ্যমে সম্ভব হবে।

তথ্যসূত্র

[1] https://scholarcommons.sc.edu/cgi/viewcontent.cgi?article=1144&context=libsci_facpub
[2] https://www.pewresearch.org/internet/2017/10/19/the-future-of-truth-and-misinformation-online/
[3] https://news.miami.edu/stories/2022/01/the-internets-connectivity-brings-positives-and-negatives.html
[4] https://www.pewresearch.org/data-labs/2024/05/17/when-online-content-disappears/
[5] https://cs.stanford.edu/people/eroberts/courses/cs181/projects/2004-05/political-action/credibility.html
[6] https://www.sweor.com/firstimpressions
[7] https://www.forbes.com/advisor/business/software/website-statistics/
[8] https://www.ipsos.com/en/trust-in-the-internet-2022

Share
Written by
ড. মশিউর রহমান -

ড. মশিউর রহমান বিজ্ঞানী.অর্গ এর cofounder যার যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০০৬ সনে। পেশাগত জীবনে কাজ করেছেন প্রযুক্তিবিদ, বিজ্ঞানী ও শিক্ষক হিসাবে আমেরিকা, জাপান, বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুরে। বর্তমানে তিনি কাজ করছেন ডিজিটাল হেল্থকেয়ারে যেখানে তার টিম তথ্যকে ব্যবহার করছেন বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবার জন্য। বিস্তারিত এর জন্য দেখুন: DrMashiur.com

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
তথ্যপ্রযুক্তি

নতুন ফিচার গ্রহণের পূর্বে ব্যবসার লাভ ক্ষতির বিশ্লেষণ

এই প্রবন্ধে নতুন ফিচার ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যবসায়িক লাভ ও ক্ষতির বিশ্লেষণ করা...

তথ্যপ্রযুক্তিপণ্য পরিচিতিপ্রযুক্তি বিষয়ক খবর

ইন্টেল বনাম আর্ম: পরবর্তী প্রজন্মের পিসি কোন প্রোসেসরে চলবে?

গত কয়েক বছরে কম্পিউটার প্রসেসর মার্কেটে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে। ইন্টেল প্রসেসর দীর্ঘদিন...

তথ্যপ্রযুক্তি

কোডিংয়ের গুরুত্ব: শিক্ষার্থী এবং পেশাগত উন্নয়নের জন্য ভবিষ্যতের সাফল্যের পথ

আজকের ডিজিটাল যুগে, কোডিং এমন একটি মৌলিক দক্ষতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা...

তথ্যপ্রযুক্তিনতুন প্রযুক্তি

হ্যাক্ অসম্ভব এমন ইন্টারনেট

কোনো অ্যান্টিভাইরাস সফ্টওয়্যার বা ভাইরাস স্ক্যান প্রোগ্রামিঙই একশো শতাংশ সুরক্ষা দিতে পারে...

তথ্যপ্রযুক্তি

কৃত্রিম কল্পনা

“ফিচার লার্নিং অ্যালগোরিদম্” বা “রিপ্রেসেন্টেশন্ লার্নিং অ্যালগোরিদম্” আসলে ইনপুট হিসাবে দেওয়া তথ্যসমূহ...

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.

যোগাযোগ: biggani.org@জিমেইল.com

Copyright © biggani.org